গবেষণা

২০৪৫ সালের মধ্যে ইচ্ছামৃত্যু!

আগামী ২০৪৫ সালের মধ্যে মৃত্যু হবে ‘ঐচ্ছিক’। একই সঙ্গে বার্ধক্য প্রক্রিয়া হবে ‘প্রতিবর্তনযোগ্য’। এমন দাবি করেছেন দুই জেনেটিক প্রকৌশলী। স্পেনের বার্সেলোনায় নিজেদের নতুন বই ‘দ্য ডেথ অব ডেথ’ নিয়ে এক উপস্থাপনায় এই দাবি করেন তারা।

ওই দুই জেনেটিক প্রকৌশলীর মধ্যে একজন হলেন- হোসে লুইস কর্ডেইরো। তার জন্ম ভেনেজুয়েলায়। তার বাবা-মা দু’জনই স্প্যানিশ। অন্যজন হলেন- কেমব্রিজ (যুক্তরাজ্য) গণিতবিদ ডেভিড উড, যিনি অপারেটিং সিস্টেম ‘সিম্বিয়ান’-এর প্রতিষ্ঠাতা।

‘দ্য ডেথ অব ডেথ’ বই প্রকাশনা নিয়ে ওই উপস্থাপনায় তারা দাবি করেন, অমরত্ব একটি বাস্তব এবং বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনাময় বিষয়, যা আমাদের ধারণারও অনেক আগেই আসতে পারে।
কর্ডেইরো এবং উড দাবি করেন, ২০৪৫ সাল ও এর আশেপাশের বছরগুলোতে মানুষ কেবল দুর্ঘটনায় মারা যাবে। প্রাকৃতিক কারণ কিংবা অসুস্থতার কারণে মানুষের মৃত্যু হবে না।

তারা বলেন, “এটি ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ যে বার্ধক্যকে একটি ‘অসুখ’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা শুরু হয়েছে, যাতে করে বিষয়টি নিয়ে জনসাধারণের অর্থায়নে গবেষণা করা হয় এবং এর ‘নিরাময়’-এর পথ প্রসারিত হয়।”

উপস্থাপনায় ওই দুই প্রকৌশলী আরও বলেন, “অন্যান্য নতুন জেনেটিক ম্যানিপুলেশন কৌশলগুলোর মধ্যে ন্যানো প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ। এর প্রক্রিয়ায় থাকবে ‘খারাপ’ জিনকে সুস্থ জিনে রূপান্তরিত করা, শরীর থেকে মৃত কোষগুলোকে নির্মূল করা, ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলো মেরামত করা, স্টেম সেল দিয়ে চিকিৎসা করা এবং গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর ‘থ্রি ডি প্রিন্টিং’ করা।”

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) প্রকৌশলী কর্ডেইরো বলেন, “আমি ‘মৃত্যু না হওয়ার বিষয়টিই বেছে নিয়েছি’ এবং আগামী ৩০ বছরের মধ্যে ‘আজকের চেয়েও কম বয়সী’ হয়ে উঠবো।”

বার্ধক্য হল ক্রোমোজোমে ডিএনএ ‘টেইলস’ এর ফল, যা ‘টেলোমেরেস’ নামে পরিচিত। কেবল লোহিত রক্ত (রেড ব্লাড) এবং লিঙ্গ কোষ ব্যতীত এগুলোর প্রতিটি কোষে ২৩টি করে জোড়া থাকে। ডিএনএ ‘টেইলস’- এ এই কোষগুলো ছোট হয়ে যায়। ফলে মানুষ বৃদ্ধ হয়ে যায়। আর বার্ধক্যের বিপরীত প্রক্রিয়াটি হল টেলোমেরেসকে দীর্ঘায়ু করা।

সময়ের সাথে সাথে টেলোমেরেস ক্ষতিগ্রস্ত এবং ছোট হয়ে যায়। আর এই প্রক্রিয়াটি আরও ত্বরান্বিত হয় যখন শরীরে বিষাক্ত পদার্থ তথা ধূমপান, অ্যালকোহল এবং বায়ু দূষণের মতো উপাদানগুলো প্রবেশ করে। এতে টেলোমেরেসের আয়ু কমে যায় এবং বার্ধক্য ত্বরান্বিত হয়।

কর্ডেইরো এবং উড বিশ্বাস করেন, আগামী ১০ বছরের মধ্যে ক্যান্সারের মতো অসুস্থতা নিরাময়যোগ্য হবে এবং গুগলের মতো বড় আন্তর্জাতিক করপোরেশনগুলো ‘মেডিসিন খাতে বিনিয়োগ করবে’। কারণ তারা বুঝতে শুরু করেছে যে বার্ধক্য নিরাময়যোগ্য করে তোলা সম্ভব।

গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, মাইক্রোসফ্ট ইতোমধ্যেই একটি ‘ক্রিওপ্রিজারভেশন সেন্টার’ স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে। যেখানে একজন বিজ্ঞানী আগামী এক দশকের মধ্যে ক্যান্সার সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করছেন।

ওই দুই প্রকৌশলী ব্যাখ্যা করে বলেন, “সাধারণত ‘মানুষ এটি সম্পর্কে জানে না যে, ক্যান্সার কোষ অমর। যদিও বিষয়টি ১৯৫১ সালে আবিষ্কার হয়, যখন হেনরিয়েটা ল্যাকস সার্ভিকাল ক্যান্সারে মারা যান। সার্জনরা তার টিউমারটি অপসারণ করেন এবং সেটি এখনও ‘জীবিত’।”

কর্ডেইরো ও উড বলেন, অমরত্বের মানে এই নয় যে, এর ফলে পৃথিবী নামের এই গ্রহটি জনাকীর্ণ হয়ে যাবে। তাদের মতে, পৃথিবীতে এখনও অনেক মানুষের জন্য প্রচুর জায়গা রয়েছে। তাছাড়া আগামীতে মহাকাশেও মানুষের বসবাস সম্ভব হবে।

জাপানি এবং কোরিয়ায় ‘কম জন্মহারের’ বিষয়টি উল্লেখ করে কর্ডেইরো বলেন, “জাপান এবং কোরিয়ানরা যদি এভাবে কম সন্তান ধারণের বর্তমান প্রবণতা চালিয়ে যায়, তাহলে তারা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আগামী দুই শতাব্দীর মধ্যে এই গ্রহে কোনও জাপানি বা কোরিয়ান মানুষ থাকবে না।”

“কিন্তু এই নতুন কৌশলের সুবাদে জাপানি এবং কোরিয়ান মানুষেরাও থাকবে। কারণ তারা চিরকাল বেঁচে থাকবে এবং তরুণ থাকবে,” যোগ করেন তিনি।

অ্যান্টি-এজিং ট্রিটমেন্টের তথা বার্ধক্য নিরোধক চিকিৎসার খরচ সর্বশেষ স্মার্টফোনের সাথে তুলনা করা হয়েছে।

কর্ডেইরো বলেছেন, “প্রথমে এটি ব্যয়বহুল হবে। তবে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সময়ের সাথে সাথে খরচ ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে। কারণ এটি এমন কিছু হবে যা সবার উপকারে আসবে।”

তার মতে, যেকোনও প্রযুক্তি নতুন অবস্থায় দুর্বল ও অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়। তবে তা সময়ের সাথে গণতান্ত্রিক তথা সহজপ্রাপ্য ও মূলধারায় পরিণত হয়। সেই সঙ্গে কমে যায় খরচ।

ওই দুই প্রকৌশলী বলেছেন, তারা ইতোমধ্যে তাদের এই কৌশল দুই বছর ধরে ব্যবহার করছেন। তবে তা অবৈধভাবে কলম্বিয়াতে- যেখানে জেনেটিক ম্যানিপুলেশনের বিষয়ে নিয়মকানুন কিছুটা শিথিল।

তাদের প্রথম রোগী এলিজাবেথ প্যারিশ নামের একজন নারী। তিনি বার্ধক্যজনিত লক্ষণগুলো দেখতে শুরু করেছিলেন এবং জানতে চাচ্ছিলেন যে, এটি প্রতিরোধ করার জন্য কী করা যেতে পারে।

যদিও তার চিকিৎসা ‘খুব ঝুঁকিপূর্ণ এবং এমনকি অবৈধ’, উড ব্যাখ্যা করে বলেন, “তবে এই মুহূর্তে তিনি ভাল আছেন। কোনও প্রতিকূল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই এবং তার রক্তে টেলোমেরেসের মাত্রা ‘আগের চেয়ে ২০ বছর কম’।”

সবশেষে উড বলেন, “আমি চাই যে স্পেন এই প্রযুক্তির বিশ্বে একটি জায়গা লাভ করুক এবং দেখিয়ে দিক যে আমরা পাগল নই।”

‘দ্য ডেথ অব ডেথ’ বইটি প্রথমে চারটি ভাষায় প্রকাশিত হওয়ার কথা। সেগুললো হল– স্প্যানিশ, ইংরেজি, পর্তুগিজ এবং কোরিয়ান। এর বিক্রয় থেকে আয়ের সব অর্থই লেখকদের গবেষণায় ব্যয় করা হবে।

এম ইউ/১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

Back to top button