জাতীয়

‘হিজরতের’ নামে ঘরছাড়া ৭ তরুণ, নাটের গুরু চিকিৎসক দুই ‘বড় ভাই’

সাহাদাত হোসেন পরশ

ঢাকা, ১৪ সেপ্টেম্বর – হিজরত করতে কুমিল্লার সাত তরুণ ঘর ছাড়ার পরই প্রশ্ন ওঠে- জিহাদের ডাক দিয়েছিল কারা; কাদের অঙ্গুলি হেলনে ঘর ছেড়েছে তার। উগ্রপন্থি সংগঠনের ছায়াতলে তাদের সমবেত করেছে কোন কোন ‘বড় ভাই’। কত দিন ধরে চলেছে ‘মগজ ধোলাই’? পুলিশি তদন্তে মিলেছে এসব অঙ্কের যোগফল।

ওই সাত তরুণের আরেক সহযোগী আবরারুল ইসলাম ধরা পড়ার পর নতুনভাবে সক্রিয় জঙ্গি নেটওয়ার্ক সম্পর্কে তথ্য পেয়েছে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। আবরারুল কুমিল্লা ইস্পাহানি স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। তার ব্যবহূত একটি মোবাইল ফোনও জব্দ করেছে পুলিশ। জঙ্গিদের ব্যবহূত দুটি অ্যাপস নিয়মিত ব্যবহার করত সে। আবরারুল পুলিশকে প্রথম তথ্য দেয়- জিহাদের ডাক পেয়ে কুমিল্লা থেকে তার বন্ধুরা যাদের কথায় ঘর ছেড়েছে, তাদের দু’জন চিকিৎসক। প্রায় এক বছর থেকে ওই দুই ‘বড় ভাই’কে তারা চেনে। দু’জনই কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে (কুমেক) পড়েছে। আবরারুলের সঙ্গে তার ‘গুরু’ হিসেবে পরিচিত চিকিৎসক শাকির বিন ওয়ালীকে গতকাল মঙ্গলবার রাতে গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার করেছে পুলিশ। কুমেকের আরেক চিকিৎসককেও খোঁজা হচ্ছে। এমনকি উগ্রবাদী আদর্শে বিশ্বাসী শাকিরের স্ত্রী আয়েশা বিনতে মুস্তাফিজকে রাখা হয়েছে নজরদারিতে। সে বরিশাল মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। স্বামীর সঙ্গে জঙ্গি নেটওয়ার্কে তার যোগসূত্র পাওয়ার পর আয়েশার ব্যবহূত মোবাইল ফোনসেট পুলিশ জব্দ করেছে। ওই ফোনে জঙ্গি মতবাদবিষয়ক বিভিন্ন লেখা পাওয়া গেছে। আয়েশা ছাড়াও তার স্বামীর দুটি ও আবরারুলের একটি ফোনসেট জব্দ করে প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এতে তাদের সঙ্গে আনসার আল ইসলামের (সাবেক এবিটি-আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) যোগসূত্র পাওয়া গেছে। আদালতের অনুমতি নিয়ে এসব ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য সিআইডির ল্যাবে পাঠানো হবে। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে গতকাল এসব তথ্য মিলেছে।

এ ব্যাপারে সিটিটিসির প্রধান ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, কুমিল্লা থেকে যারা নিখোঁজ হয়েছিল, তাদের ইমান, তাওহিদ ও জিহাদ সম্পর্কে দীক্ষা দেয় শাকিরসহ আরও একজন। তাদের ওপরে অন্য কেউ থাকতে পারে। বড় প্রস্তুতি নিয়ে তরুণদের ভুল পথে নিয়েছিল চক্রটি। মূলত এরা রিক্রুটকারী। সর্বশেষ যে সাত তরুণ নিখোঁজ হয়েছে, তাদের খোঁজে বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে।

জঙ্গিদের কর্মকাণ্ডের ওপর এক দশকের বেশি খোঁজ রাখেন এমন এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, কুমিল্লা থেকে যে তরুণরা হিজরতের জন্য ঘর ছাড়ে, তাদের ২০২১ সালের শেষ সময়ে টার্গেট করা হয়। কুমেকে পড়াশোনা করা এক যুবক ওই তরুণদের ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করে। জিহাদের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তাদের বোঝানো হতো। ধর্মীয় জ্ঞান ও ফতোয়ার ব্যাপারে বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন হলে কুমিল্লার একজন মুফতির কাছে তাদের নেওয়া হতো। প্রতি দফায় দুই-তিনজনকে নিত। জিহাদের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নেওয়ার পর সপ্তাহ তিনেক আগে একে একে ঘর ছাড়ে সাত তরুণ। আরও ছয়-সাত তরুণও তাদের পথ অনুসরণ করে ঘর ছাড়ার প্রস্তুতি নেয়।
জঙ্গি সংশ্নিষ্টতার অভিযোগ পাওয়ার পরও কেন শাকিরের স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়নি- এমন প্রশ্নে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘তাদের ঘরে দেড় মাস বয়সের শিশু রয়েছে। তাই মানবিক কারণে এখনও গ্রেপ্তার করা হয়নি।’

আরেক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ঘর ছাড়ার পর তরুণরা বেশ কয়েকটি জেলায় গেছে। এর মধ্যে রয়েছে চাঁদপুর ও বরিশাল। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, শাকির ও তার সহযোগীরা এসব ঠিকঠাক করে দিয়েছে। কারণ শাকিরের এক আত্মীয়ের বাড়ি চাঁদপুরে। আর স্ত্রীর সুবাদে বরিশালে কিছুদিন বাস করে সে। দুই জায়গায় নিখোঁজ তরুণদের আস্তানা খুঁজে দেওয়ার ঘটনায় তাঁর ভূমিকা থাকতে পারে।

এখন পর্যন্ত শাকির সম্পর্কে গোয়েন্দারা যেসব তথ্য পেয়েছেন তা হলো- মেডিকেলে পড়াশোনার সময় থেকে শাকির উগ্র মতাদর্শে বিশ্বাসী। ২০১৮ সালে সে একবার গ্রেপ্তার হলেও পরে ছাড়া পায়। খুব কম সময় সে মোবাইলে কথা বলে। যদি কোনো প্রয়োজন হয়, অ্যাপস ব্যবহার করে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অ্যাপস ছাড়া কথা বলে না। কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ তরুণ বাড়ি ফিরে গেছে- এমন তথ্য তার কাছে যাওয়ার পর ৩১ আগস্টের পর নিজের ব্যবহূত একটি পুরোনো ফোনসেট ও সিম সে ফেলে দেয়। নতুন রিক্রুট করা জঙ্গিদের উদ্দেশে বয়ান দিতে মাঝেমধ্যে কুমিল্লা যেত সে। যদিও চিকিৎসক হওয়ার পর শাকির তার মা-বাবা ও স্ত্রীর সঙ্গে পূর্ব হাজীপাড়ার বাসায় থাকত।
এ ছাড়া দেশের প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিতে শাকিরের কোনো বিশ্বাস ছিল না। শরিয়াভিত্তিক চিকিৎসা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করে সে। পুলিশ বলছে, ‘র‌্যামফিট’ নামে একটি পদ্ধতি সে বিশ্বাস করছে।

তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, নিখোঁজ সাত তরুণের মধ্যে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ইমরান বিন রহমান ওরফে শিথিল (১৭), কুমিল্লা সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী হাসিবুল ইসলাম (১৮) ও একই কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী নিহাল আবদুল্লাহকে (১৭) জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করতে তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে শাকির। ওই বৈঠকে আবরারুলও ছিল। এ ছাড়া শাকির তার এক আত্মীয়ের ছেলেকেও উগ্রপন্থায় নিতে প্রলুব্ধ করে। ওই ছেলের বাবা সরকারি কর্মকর্তা। বিষয়টি ওই ছেলের বাবা টের পাওয়ার পর শাকিরকে শাসান। দ্রুত শাকিরকে ওই পথ থেকে সরে আসার তাগিদ দেন। তবে শাকির তা কানে তোলেনি। আত্মীয়ের ছেলেকে জঙ্গিবাদে নিতে না পারলেও অন্য তরুণদের ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। তবে গোয়েন্দাদের বিশ্বাস- তরুণদের মগজ ধোলাইয়ে শাকিরের সঙ্গে আরও কয়েকজন থাকতে পারে। আর শাকিরের বাবা এ কে এম ওয়ালী উল্লাহ চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও সার্জন। তিনি জামায়াত-শিবির ও তাদের সমর্থিত চিকিৎসকদের ফোরাম ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামের (এনডিএফ) সহসভাপতি। এ ছাড়া শাকিরের শ্বশুর জামায়াত মতাদর্শে বিশ্বাসী।

এ কে এম ওয়ালী উল্লাহ বলেন, রোববার বিকেল ৩টার দিকে সিআইডি পরিচয়ে সাদা পোশাকে চার ব্যক্তি বাসায় আসেন। তখন তিনি বাইরে ছিলেন। তাঁরা শাকিরকে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে নিয়ে যান। তাঁরা শুধু বলেছেন, ‘আমরা সিআইডির লোক।’ পরে রামপুরা পুলিশ জানায়, শাকিরকে মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে।
উগ্রপন্থি নেটওয়ার্কে ছেলের জড়ানোর ব্যাপারে ওয়ালী উল্লাহ বলেন, ‘এটা আমার জানা নেই। টেরও পাইনি। সে সপ্তাহখানেক আগে আমার মোবাইল ফোনসেটটি চেয়ে নিয়েছিল।’

সূত্র : সমকাল
এন এ/ ১৪ সেপ্টেম্বর

Back to top button