সিলেট

তিনি সিলেটের একজন প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার

সিলেট, ১৩ সেপ্টেম্বর – ২০০৪ সালে মামুনুর রশীদ বকসের সঙ্গে লুবানা ইয়াসমিনের যখন বিয়ে হয়, তখন তিনি উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী। বিয়ের পর পড়াশোনা আর এগোয়নি। তাঁর স্বামী প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার। বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া। সন্তানদের আরও ভালো পড়াশোনার পরিবেশ দিতে ২০১১ সালে সিলেট শহরে চলে আসেন তাঁরা। স্বামীর উৎসাহে আবার পড়াশোনা শুরু করেন লুবনা। প্রাইভেটে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পাস করেন।

আরেকটা বিষয়েও লুবানার আগ্রহ তৈরি হয়, সেটা হচ্ছে ঠিকাদারি। স্বামীর ঠিকাদারি কাজে গিয়ে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করতেন। আস্তে আস্তে তাঁর মনে ঠিকাদার হওয়ার ইচ্ছা জাগে। স্বামীকে কথাটা জানাতেই নিরুৎসাহিত করলেন, ‘এটা কঠিন কাজ! তুমি পারবে না।’ এ কথায় লুবানার মনে জেদ চাপে। জেদ থেকেই ঠিকাদারি পেশায় যুক্ত হন লুবানা। প্রথমে মানা করলেও পরে কিন্তু ঠিকই মামুনুর রশীদের সহায়তা পেয়েছেন লুবানা।

২০০৯ সালে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ঠিকাদারি কাজ শুরু করেন লুবানা। মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার একটি রাস্তা ও সেতুর কাজ দিয়ে তাঁর ঠিকাদারি পেশায় যাত্রা শুরু। ওই প্রকল্পের ব্যয় ছিল প্রায় ৭০ লাখ টাকা। সিলেট নগরে তাঁর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের করা অনেক কাজের একটি সোবহানীঘাট-মেন্দিবাগ সড়কে সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প। ধীরে ধীরে তাঁর সুনাম বাড়ে। সুবিদবাজার এলাকায় ‘মুমু এন্টারপ্রাইজ’ নামে তাঁর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আছে।

বছরে কোটি টাকার কাজ
প্রতিবছর গড়ে সাত থেকে আটটি কাজ করেন লুবানা ইয়াসমিন। এসব কাজের অর্থমূল্য কয়েক কোটি টাকা। ব্রিজ, কালভার্ট, ইউনিয়ন পরিষদ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো, রাস্তাঘাট নির্মাণসহ নানা ধরনের কাজ তিনি করছেন। প্রায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে এখন সিলেট সিটি করপোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডে পানির সংযোগ লাইনের সংস্কারকাজ করছে তাঁর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

লুবানা ইয়াসমিন জানান, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নিয়মিত কাজ তদারক করেন তিনি। ঠিকাদারি কাজ করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে উটকো ঝামেলায়ও পড়তে হয়। লুবানা বলেন, ‘স্থানীয় প্রভাবশালীরা অযথাই ভোগান্তিতে ফেলতে চান। তবে সবখানেই আমি কাজের গুণগত মান ধরে রাখার চেষ্টা করি। ফলে কাজে কোনো অনিয়ম পায় না বলে নিজ থেকেই এসব প্রভাবশালীরা একসময় সরে যান।’

লুবানা জানান, কাজে সব সময়ই নারীদের প্রধান্য দেন তিনি। তাঁর নিয়োজিত শ্রমিকদের অর্ধেকেরও বেশি থাকে নারী। লুবানা বলেন, ‘ঠিকাদার হিসেবে আমার প্রতিষ্ঠানের একটা সুনাম আছে। দরপত্র অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়েই কাজ শেষ করার চেষ্টা করি। ঠিকাদারিকে আমি সমাজসেবা হিসেবেই বিবেচনা করি। আমার কাজ সমাজ ও দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই আমার কাজের গুণগত মান ধরে রাখার চেষ্টা থাকে নিরন্তর।’

‘এটা তো পুরুষের পেশা!’
‘নারী আবার ঠিকাদার হয় নাকি? এটা তো পুরুষের পেশা!’ শুরুতে এ ধরনের নানা টিপ্পনির মুখে পড়তে হয়েছে। এসব বাধা ঠেলে পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই ঠিকাদারির কাজ করছেন লুবানা ইয়াসমিন। সিলেটের একজন প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার হিসেবে শ্রেষ্ঠ করদাতা হয়েছেন। অন্য নারীদের কাছেও এখন তিনি আদর্শ। সহসভাপতি পদে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সিলে ট উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির।

অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জন করায় ২০২১ সালে সিলেট জেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার পেয়েছেন লুবানা। তিনি বলেন, ‘যখন ঠিকাদারি শুরু করি, তখন আমার আত্মীয়স্বজন সবাই বলেছিলেন, বেশি দূর এগোতে পারব না। কিন্তু নারীরা যে চ্যালেঞ্জিং পেশায়ও সফল হতে পারেন, সেটা নিজেকে দিয়েই বুঝতে পারছি।’

নারীদের উদ্দেশ্যে লুবানা ইয়াসমিন বলেন, ‘আমি চাই, প্রত্যেকটা নারী চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুক। কাজের ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে নারীদের স্পৃহা ও ইতিবাচক মানসিকতা বেশি। নারীরা যেকোনো কাজই যত্নের সঙ্গে করে। ফলে চ্যালেঞ্জ নিলে সাফল্য আসবেই। তবে প্রতিবন্ধকতা এলে কোনো অবস্থাতেই দমে যাওয়া যাবে না।’

সূত্র: প্রথম আলো
এম ইউ/১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

Back to top button