কক্সবাজার, ১১ সেপ্টেম্বর – কক্সবাজারের সরকারিকৃত টেকনাফ ডিগ্রি কলেজে শিক্ষক ও কর্মচারীর এমপিওভুক্তির অনিয়ম, দুর্নীতির সন্ধান পেয়েছে সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমে ভাবতে পারেনি কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়বে। জাতীয়করণকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য শিক্ষক ও কর্মচারীদের পদ সৃজন করতে গিয়ে এমপিওভুক্তির অনিয়ম আবিষ্কার করেছে জনপ্রশসান মন্ত্রণালয়।
এ ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তেও বিভিন্ন সময়ে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ এবং এমপিওভুক্তিতে অনিয়ম দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে।
গত বছর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক গবেষণায়, এমপিওভুক্তি নিয়ে দুর্নীতির প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তবে বছরের পর বছর এমন অনিয়ম দুর্নীতি ধরা পড়লেও এর পেছনের সিন্ডিকেট কখনই ধরা পড়ে না। কারা কোন পর্যায়ে এসব ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগ এবং এমপিওভুক্তির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকার পরও এমপিওভুক্ত ইনডেক্স নম্বর প্রদান করে, এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি শিক্ষা প্রশাসন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমপিও প্রদান প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সময়ে শিক্ষা প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা এমপিওভুক্তি নিয়ে কাজ করে থাকেন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানপ্রধান থেকে শুরু করে উপজেলা, জেলা, আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে কয়েক পর্বে এমপিওর কাগজপত্র যাচাই বাছাই করা হয়। এর পর সর্বশেষ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে এমপিও কমিটির সভায় চূড়ান্ত হয় এমপিও প্রাপ্তির নাম। এভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে পুরনো নথিতে কে অনিয়ম করছেন? তা চিহ্নিত করা কঠিন কাজ। তবে টিআইবির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, অনিয়ম দুর্নীতি চক্রকে খোঁজা কঠিন হলেও তা চিহ্নিত করা উচিত। ভবিষ্যতে অনিয়ম দুর্নীতি বন্ধের উদ্যোগও নিতে হবে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানকে।
এমপিওর দুর্নীতি প্রমাণ হলেও কারা এর পেছনে দায়ী? কেন এদের চিহ্নিত করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না- এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এক সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন, ২৫-৩০ বছর আগে কোনো উপায়ে একজন শিক্ষক এমপিওভুক্ত হয়েছেন। এখন ওই প্রক্রিয়ায় সরকারি কোনো কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন কিনা, সেটা এখন চিহ্নিত করা মুশকিল। এখন প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। আশা করি, ভবিষ্যতে এ নিয়োগ সমস্যায় অভিযোগ থাকবে না।
এ প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দশ-পনেরো বছর আগে কারা এমপিওভুক্তি প্রক্রিয়ায় দায়িত্বপালন করেছেনÑ এটা খোঁজ বা চিহ্নিত করা সরকারি দপ্তরের জন্য দুরূহ। তবে দুর্নীতি রোধ করতে হলে, এর শেকড় উপড়ে ফেলা উচিত। শিক্ষাভবনে শিক্ষকদের নানাবিধ সেবায় অর্থ লগ্নি করতে হয়। এমপিওভুক্তিতে স্তরে স্তরে শিক্ষকদের হয়রানি শিকার হতে হয়। সে জন্য এসব খাতে অর্থ ব্যয় করতে হয়।
জাতীয়করণকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীদের পদ সৃজন করতে গিয়ে নিয়োগ এবং এমপিওভুক্তির অনিয়ম প্রকাশ্যে এলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কাছে এ বিষয়ে তথ্য/প্রমাণসহ সুস্পষ্ট মতামত দেওয়ার জন্য চিঠি পাঠিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
গত মার্চ মাসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এক চিঠিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানায়, সরকারিকৃত টেকনাফ ডিগ্রি কলেজের পদ সৃজনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সুস্পষ্ট সুপারিশ বা মতামত প্রদান করতে হবে। কেননা, ওই কলেজের শিক্ষক ও কর্মচারীসহ ১৪ জনের নিয়োগ এবং এমপিওভুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকার পরও শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে এমপিওভুক্তি করা হয়েছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত আগস্টে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য, প্রমাণসহ সুস্পষ্ট মতামত দেওয়ার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালককে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাউশির মহাপরিচালক প্রফেসর নেহাল আহমেদ বলেন, এমপিওভুক্ত নিয়ে অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এমপিওভুক্তির পুরো প্রক্রিয়াটি এখন অনলাইনে হয়। এনটিআরসিএ মাধ্যমে নিয়োগ হচ্ছে। একটা সময় ছিল কোনোরকমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কমিটির লোকজন নিয়োগ দিয়েছেন, আবার তারা এমপিওভুক্তিও পেয়েছেন। এখন নিয়মনীতি মেনেই এমপিওভুক্তি করতে হয়। এখন যেগুলো অভিযোগ আসছে জাতীয়করণের প্রক্রিয়ায়- এসব প্রতিষ্ঠান অনেক পুরনো এমপিওভুক্ত। তখন কারা এর দায়িত্বে ছিলেন? এ খোঁজা কঠিন।
তবে মাউশির সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, এখনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানপ্রধান, উপজেলা, জেলা এবং অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয়ে এমপিওভুক্তির কার্যক্রম পরিচালনা ধাপে ধাপে করা হয়। এটি জটিল। প্রক্রিয়াগুলোয় অনেক সমস্যাও রয়েছে। সম্পূর্ণ অটোমোশন করা গেলে, অনিয়ম দুর্নীতি কমিয়ে আনতে সহায়ক হবে। এমপিওভুক্তির বিষয়টি এক সময় গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় করা হয়েছিল।
টেকনাফ ডিগ্রি কলেজের সাবেক একজন শিক্ষক জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৪ সালে এমপিওভুক্ত হয়েছে। যাদের বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আপত্তি জানিয়েছেন, তাদের অধিকাংশই ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে এমপিওভুক্ত হয়েছেন। একজন সহগ্রন্থগারিক সেও ২০১১ সালে এমপিওভুক্ত হয়েছেন।
পদসৃজন করতে গিয়ে যাদের এমপিওভুক্তি প্রশ্নবিদ্ধ, তাদের মধ্যে রয়েছেন- শেখ জয়নাল আবেদীন, জয়নাল আবেদীন, মোজাম্মেল হক, মো. রহুল আমিন ভূঁইয়া, মো. আসাদুজ্জামান, মো. মঈন উদ্দিন, নুরুল ইসলাম, মোহাম্মদ সিরাজুল হক, মনোয়ারা বেগম, সাহাব মিয়া, জ্ঞান বালা শীল।
পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) ২০১৯-২০ বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে, প্রতিবছর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যে অনিয়ম দুর্নীতির জন্য আর্থিক জরিমানা আদায়ের সুপারিশ করে থাকে, তার মধ্যে বিধিবহির্ভূত নিয়োগের অভিযোগ ৫৯ শতাংশ, আয়-ব্যয় সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগ ২৫ শতাংশ, জাল সনদ ৫ শতাংশ, প্রাপ্যতার অতিরিক্ত গ্রহণ ৫ শতাংশ, প্যাটার্ন অতিরিক্ত নিয়োগ ২ শতাংশ।
নিয়োগ কিংবা এমপিওভুক্তির অনিয়মের শাস্তি প্রসঙ্গে ডিআইএর যুগ্ম পরিচালক প্রফেসর বিপুল চন্দ্র সরকার বলেন, তদন্তে কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীর নিয়োগ যথাযথ হয়নি, সে সরকারের (এমপিও) বেতন-ভাতা নিয়েছেন। তা হলে ওই ব্যক্তি যতদিন এ সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন পুরো অর্থ রাষ্ট্রকে ফেরত দেওয়ার সুপারিশ করা হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমপিওভুক্ত প্রক্রিয়া কোনো অনিয়ম প্রমাণিত হলে যারা এর জন্য দায়ী, তাদের বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করে ডিআইএ।
উল্লেখ্য, গত বছর টিআইবির এক গবেষণায় বলা হয়, শিক্ষকের এমপিওভুক্তিতে ৫ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূতভাবে আদায় করা হয়েছে। এ টাকা আদায়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জড়িত।
সূত্র: আমাদের সময়
আইএ/ ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২