জাতীয়

মহাখালী ক্যান্সার হাসপাতাল : টাকার বিনিময়ে সিরিয়াল বিক্রি করে দালালরা

শিমুল মাহমুদ

ঢাকা, ৬ সেপ্টেম্বর – মেহেরপুরের সজীব বিশ্বাস রাজধানীর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এসেছেন অসুস্থ মাকে নিয়ে। রাতভর দীর্ঘ যাত্রায় ক্লান্ত। গতকাল সোমবার ভোর ৪টার দিকে হাসপাতালে পৌঁছেন তিনি। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে চুপসে গেলেন।

বহির্বিভাগে টিকিট কাউন্টারের সামনে পানির বোতল দিয়ে সিরিয়াল রেখে গেছে ৪০ জন। সজীব শঙ্কিত, মাকে আজ চিকিৎসক দেখানো হয় কি না?

সকাল ৭টা নাগাদ বোতলের সিরিয়াল পৌঁছে ১২০ জনে। অথচ বহির্বিভাগের টিকিট কাউন্টার খুলবে সকাল ৮টায়।

সাড়ে ৭টার দিকে একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী এসে সিরিয়াল রাখা ব্যক্তিদের লাইনে দাঁড়ানোর কথা বলে বোতলগুলো তাঁর বস্তায় ভরে নেন। এ সময় দেখা যায়, ৪০ জনের পেছনে থাকা সজীব বিশ্বাস লাইনের প্রথমে।

এ ব্যাপারে তিনি বলেন, বোতলের সিরিয়াল কিনেছি ২০০ টাকা দিয়ে। প্রথম দশে থাকলে ২০০ টাকা, দশের পরে সিরিয়াল নিলে ১৫০ টাকা, ২০ জনের পর নিলে ১০০ টাকা।

সিরিয়াল কেনার বিষয়ে সজীব বিশ্বাস বলেন, এখানকার আনসার সদস্য ও আয়ার দায়িত্বে থাকা সবাই কমবেশি সিরিয়াল বিক্রি করেন।

পাশে থাকা গোপালগঞ্জের ফারুক ও হান্নান বলেন, সিরিয়াল না কিনলে ডাক্তার দেখানো যায় না। দুপুর ১টা বাজলে কোনো টিকিটও দেওয়া হয় না।

হাসপাতালটির পশ্চিম ভবনের পরীক্ষাকেন্দ্রের চিত্র আরো হতাশার। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় গেটে তালা দেওয়া। কিন্তু

ভবনের ভেতর আগেই সিরিয়াল দিয়ে রাখা আছে প্রায় ৪০টি বোতল বসিয়ে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা রোগীদের স্বজনরা একটানা দাঁড়িয়ে থাকার ক্লান্তি নিয়ে কেউ বসে পড়েছে মেঝেতে। কেউ বা শুয়ে আছে মাদুর বিছিয়ে। অনেকে আবার পানির বোতল, ইট, জুতা, ডাবের খোসা দিয়ে সিরিয়াল দিয়েছে।

এ সময় দাঁড়িয়ে থাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুজিবর রহমান বলেন, ভেতরে থাকা বোতলের সিরিয়াল আগের দিন দেওয়া হয়েছে। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা জামালপুরের জাহিদুল ইলাম জাহিদকে দেখিয়ে বলেন, ‘উনি পেয়েছেন ভেতরের সিরিয়াল। ’

জাহিদ বলেন, ‘গতকাল ৭ নম্বর সিরিয়াল কিনেছি ২০০ টাকা দিয়ে। প্রথম সিরিয়াল বিক্রি হয়েছে ৫০০ টাকায়। পাশ থেকে কুমিল্লার মুরাদনগরের আব্দুর সাত্তার ও রাজশাহীর মোহাম্মদ হোসেন আলী বলেন, ‘এক বছরের বেশি সময় এ হাসপাতালে আসি। এ চিত্র সব সময়ই থাকে। এখানকার আনসার, আয়া এরা বিক্রি করে। ’

কুমিল্লার মুরাদনগর থেকে ক্যান্সার আক্রান্ত বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে এসেছেন রেশমা আক্তার। তাঁর অভিযোগ, গাড়ি থেকে হাসপাতালের বেড পর্যন্ত নেওয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। একটি হুইলচেয়ার পাওয়া গেলেও ওরা ২০০ টাকার নিচে রাজি হয়নি। অবশেষে একজনের সহযোগিতায় কোলে করে বাবাকে বেডে নেওয়া হয়। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, হাসপাতালের ছয়টি রেডিওথেরাপি মেশিনের সবগুলো নষ্ট।

কিশোরগঞ্জের খাইরুল ইসলাম জীবন এসেছেন হাসপাতাল থেকে বিনা মূল্যে ক্যান্সারের ওষুধ নিতে। কোনোভাবে তা সম্ভব না হওয়ায় হাসপাতালের একজন ওয়ার্ড বয়ের সহযোগিতা নেন। ওয়ার্ড বয় দুই হাজার টাকার নিয়ে তাঁকে বিনা মূল্যে ওষুধের ব্যবস্থা করে দেন।

হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে জানিয়ে আবাসিক চিকিৎসক কামরুল হাসান বলেন, ৫০০ শয্যার হাসপাতাল চলে ৩০০ শয্যার লোকবল দিয়ে। একই সঙ্গে রয়েছে মেশিনারির সমস্যা। তিনি জানান, প্রতিদিন এ হাসপাতালে আউডডোরে ১২০ জনের মতো রোগী দেখেন তাঁরা। কেমোথেরাপি দেওয়া হয় ১২০ থেকে ১৫০ জনের।

এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘বোতল দিয়ে রাখে, এটা হচ্ছে আমাদের সিস্টেম। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো লেনদেন করে না। কেউ যদি কোনো জায়গায় লেনদেন করে, সেটা ব্যক্তি পর্যায়ে এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী এর নিষ্পত্তি করবে। ’

এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোনো তথ্য জানতে চাইলে আবেদন করেন। আমাদের সব কিছু উন্মুক্ত আছে। ’

সূত্র: কালের কন্ঠ
আইএ/ ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

Back to top button