জাতীয়

ভর্তুকির বরাদ্দ পুনর্বিন্যাস করতে যাচ্ছে সরকার

সজীব হোম রায়

ঢাকা, ৪ সেপ্টেম্বর – আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামের ওঠানামা, সার ও এলএনজির বাড়তি দামের কারণে এখন ভর্তুকির হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। সম্প্রতি শুধু জ্বালানি তেলের দামই দুইবার সমন্বয় করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে সারের দাম। এসব কারণে অর্থনীতির শেষ ভরসা কৃষি নিয়েও বাড়ছে দুশ্চিন্তা।

এ অবস্থায় বোরো মৌসুম সামনে রেখে ডিজেলে ভর্তুকি বাড়ানোর চিন্তা করছে সরকার। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বাড়তি দামের কারণে বিদ্যুৎ খাতেও ভর্তুকি কমানো যাচ্ছে না। ফলে বিদ্যুতের দাম আবার বাড়ানোর পথে হাঁটছে সরকার। পরিস্থিতি সামাল দিতে কম গুরুত্বপূর্ণ খাতের ভর্তুকি সমন্বয় করে গুরুত্বপূর্ণ এসব খাতে অর্থ সরবরাহ করা যায় কি না তা খতিয়ে দেখছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে কোন কোন খাতে ভর্তুকি অর্থনীতিতে বিশেষ প্রভাব ফেলছে না সেগুলো চিহ্নিত করার কাজ চলছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। এর বেশির ভাগ যাবে এসব পণ্যের ভর্তুকিতে। গম, পাম অয়েল, সয়াবিন তেল, কয়লা, ভুট্টা ও চাল আমদানিতেও এখন ভর্তুকির অর্থ খরচ হবে।

অর্থ বিভাগের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাজেটে যে হিসাব করে ভর্তুকির বরাদ্দ রাখা হয়েছিল তা বৈশ্বিক অবস্থার কারণে আর ঠিক রাখা যাচ্ছে না। তাই ভর্তুকির বরাদ্দ পুনর্বিন্যাস করার চিন্তা করা হচ্ছে। যার প্রয়োজন কম, তার বেশি থাকলে সেটি অন্য মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হতে পারে। তবে এটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অর্থ বিভাগ থেকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক উইংকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কী পরিমাণ ভর্তুকি প্রয়োজন তা মূল্যায়ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক উইংয়ের মূল্যায়ন পাওয়ার পর ভর্তুকির বরাদ্দ পুনর্বিন্যাস করা হতে পারে।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ ক্ষেত্রে ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে সরকার। তারপর সংশোধিত বাজেটের কাজ শুরু হবে। তখন এগুলো সমন্বয় করা হবে।

ডিজেলে ভর্তুকি বাড়বে

দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৬৫ লাখ টন। এর ৭৩ শতাংশই ডিজেল। সম্প্রতি পাঁচ টাকা কমানোর পর ডিজেলের খুচরা মূল্য এখন ১০৯ টাকা লিটার। কিন্তু এই দাম কৃষির উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

সামনে বোরো মৌসুম। আমনের টাকা কৃষক অনেক সময় বোরোতে বিনিয়োগ করে সার, ডিজেল কেনে এবং সেচ খরচসহ অন্যান্য খরচ মেটায়। কিন্তু অনাবৃষ্টির কারণে আমন ধান রোপণ ব্যাহত হচ্ছে। এতে উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তাই বোরো মৌসুমকে সামনে রেখে সরকার ডিজেলে ভর্তুকি বাড়ানোর কথা চিন্তা করছে। গত ১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে এক কর্মশালায় কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ডিজেলে আরো ভর্তুকি দেওয়ার চিন্তাভাবনা হচ্ছে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) জানায়, ১০৯ টাকায় ডিজেল বিক্রি করে প্রতি লিটারে তাদের ১৯.৬১ টাকা লোকসান হচ্ছে। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত সোমবার এক ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছেন, বিপিসি গত ছয় মাসে জ্বালানি তেল (সব ধরনের) বিক্রি করে আট হাজার ১৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে।

এলএনজি, বিদ্যুৎ ও সারে ভর্তুকি নিয়েও চিন্তায় সরকার

স্পট মার্কেটে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। জাপান ও কোরিয়াভিত্তিক বাজার জেকেএমে স্পট এলএনজি বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৫৮ ডলারে। এক বছর আগেও এটি ১০ ডলারের নিচে ছিল। বাড়তি এ দামের কারণে সরকার গত মাসের শুরু থেকে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ রেখেছে।

অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে সরকার এখন দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে কাতার ও ওমান থেকে ৫৬ কার্গো এলএনজি আমদানি করছে। এ জন্যও ভর্তুকির অর্থ গুনতে হচ্ছে। কিন্তু আবার স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনার প্রয়োজন হলে এ খাতে ভর্তুকি ব্যয় আরো বাড়বে।

জ্বালানি তেল এবং গ্যাসের কারণে বিদ্যুতেও প্রভাব পড়ছে। বিদ্যুতে সরকার গত ৯ মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্রভাড়া দিয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা ভর্তুকির তহবিল থেকে গেছে। ভর্তুকি কমাতে এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে।

চিন্তা বাড়াচ্ছে আরো ছয় পণ্য

বিভিন্ন দেশ থেকে গম, পাম অয়েল, সয়াবিন তেল, কয়লা, ভুট্টা ও চাল আমদানি করে সরকার। বুধবার সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ কমিটি রাশিয়া থেকে পাঁচ লাখ টন গম এবং ভিয়েতনাম ও ভারত থেকে তিন লাখ ৩০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। জিটুজি সমঝোতার আওতায় এই উদ্যোগে মোট খরচ হবে তিন হাজার ৫৯০ কোটি টাকা।

এ ছাড়া মিয়ানমার থেকে আরো দুই লাখ টন চাল আমদানির জন্য একটি স্মারক চুক্তি (এমওইউ) সই করেছে বাংলাদেশ। এই ছয় পণ্য আমদানিতে সরকারকে গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭৬ হাজার ৭৯৪ কোটি ২৭ লাখ ১০ হাজার টাকা বেশি ব্যয় করতে হবে। এ টাকার বেশির ভাগ যাবে ভর্তুকি খাত থেকে।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, এখনই ক্যাপাসিটি চার্জের বিষয়টি নিয়ে বিদ্যুেকন্দ্রগুলোর সঙ্গে সরকারের বসা উচিত। অযথা এ খাতে সরকারের পয়সা খরচ হচ্ছে। এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এ ছাড়া জ্বালানি তেলের মতো সারেও আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার বা কমানো উচিত।

মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘রেমিট্যান্স খাতে এখন প্রণোদনা দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। কারণ হুন্ডির মাধ্যমে পাঠালে প্রণোদনার চেয়ে বেশি অর্থ পাওয়া যাচ্ছে। তাই যারা ভালো তারা বৈধ পথে এমনিতেই পাঠাবে। ’ এ খাতের মতো যেসব খাত কম গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোর টাকা গুরুত্বপূর্ণ খাতে দেওয়া যেতে পারে মনে করেন তিনি।

সূত্র: কালের কন্ঠ
আইএ/ ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২

Back to top button