অনুবাদ

মেঘের কোলে রোদের হাসি

চমন নাহাল

মানবীয় অনুভূতির গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করা কঠিন। যাদের মুখাবয়ব সদা হাস্যোজ্জ্বল শান্ত ও প্রফুল্ল, তাদের অস্তিত্বে যেমন সরীসৃপের মতো জড়িয়ে থাকতে পারে অসীম দুঃখ, তেমনি নিষ্প্রভ ও আপাতদৃষ্টিতে ডাহা মূর্খ ব্যক্তি হতে পারে পরম সুখী। মানুষের জীবনযাপন এক অদ্ভুত একঘেয়ে ব্যাপার, সে ক্ষেত্রে এমনকি কয়েক মুহূর্তের সুখানুভূতি অন্তত কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করা উচিত।

সম্প্রতি সুদূর পার্বত্য এলাকায় প্রাইভেট গেস্টহাউসে অবস্থানকালে আমার এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা হয়েছে। জনৈক বন্ধু এই গেস্টহাউসটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছিল, এখানে অনেক সেবা-সুবিধা রয়েছে, যা অন্যান্য গেস্টহাউসে বিজ্ঞাপনে প্রচার করলেও সচরাচর মেলে না। এটি লোকালয়ের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত; যেখান থেকে ডাকঘর, বাজার এবং বাসস্ট্যান্ড নিকটবর্তী হলেও জায়গাটি বেশ কোলাহলমুক্ত। গেস্টহাউসের বাইরে প্রাকৃতিক দৃশ্য মনোরম। এখানকার রান্নাবান্নাও চমৎকার। সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও অতিথি সেবায় নিয়োজিত রয়েছে এক আকর্ষণীয় গৃহকর্ত্রী, এমন ভদ্রমহিলা কদাচিৎ কোনো গেস্টহাউসে দেখা যায়।

খোঁজ নিয়ে দেখলাম, যা বর্ণনা করা হয়েছে জায়গাটি ঠিক তেমনি। বিশেষ করে গৃহকর্ত্রী, তার স্বামী এবং তাদের নাবালিকা কন্যাটি আমার কাছে প্রীতিকর মনে হয়েছে।

গৃহকর্ত্রী দক্ষিণ ভারতীয়, কিন্তু তার স্বামী উত্তর ভারতের। ভদ্রমহিলা দেখতে শ্যামবর্ণা হলেও মুখশ্রী সুন্দর, হাসিমাখা ও মায়াবী। স্বামী কৃষ্ণকায় দীর্ঘদেহী অত্যন্ত ভদ্র আচরণবিশিষ্ট, উত্তরাঞ্চলীয় সাধারণ মানুষের মতো তেমন মেজাজি নয়।

আমি এসে পৌঁছামাত্র গৃহকর্ত্রী মিসেস ভান্ডারী আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করল, মালপত্র ঘরে রাখার জন্য কর্মচারীকে নির্দেশ দিয়ে জলদি এক কাপ সুস্বাদু কফি আমার হাতে তুলে দিল। আলাপচারিতায় জিজ্ঞাসা করল, আমি কোথা থেকে ও কেন এখানে এসেছি।

এই পরিবারের আতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ হলাম। মনে হলো, এদের সঙ্গে আমার বহুদিনের পরিচয়।

ওদের দু’জনের সঙ্গে কথা বলার সময় লক্ষ্য করলাম, গদি আঁটা লম্বা বেঞ্চির পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি নাবালিকা। প্রায় আট বছর বয়সী মেয়েটি দেখতে মায়ের মতোই সুন্দর ও সুশ্রী। ঘনভানে ছাঁটা মাথার চুল চীনা কায়দায় কপালের ওপর ছড়িয়ে আছে। জিন্সের প্যান্ট, হাফহাতা ঢিলেঢালা রঙিন জামা পরিহিত মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছিল অরণ্যের খুদে রাজরানী। আমাকে দেখে সে কেমন যেন ভয় পেল, এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করল।

আমি না হেসে পারলাম না। দেখলাম, মেয়েটি আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার নাম কী?’ ইশারা করলাম কাছে আসার জন্য।

মেয়েটি মুহূর্তে সচেতন হলো, মাথা ঝুঁকিয়ে যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।

আমি আবার ডাকলাম, ‘কাছে এসো লক্ষ্মীটি আমার!’

লজ্জারাঙা মুখে সে মাথা নেড়ে মুহূর্তে দৌড়ে চলে গেল। দেখে মনে হলো ওর দু’চোখ অশ্রুসজল।

আমি মিস্টার ভান্ডারী ও মিসেস ভান্ডারীর দিকে চোখ ফেরাতেই ঘরের মধ্যে কঠিন নীরবতা নেমে এলো। দেখলাম, ওদের দু’জনেরই ভ্রু কুঞ্চিত এবং মুখাবয়বে বেদনার ছাপ। মিস্টার ভান্ডারী স্ত্রীর হাত চেপে ধরল এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে আমাকে বলল, ‘আমরা দুঃখিত, মিস্টার ধান্ডা। দেখুন, আমাদের মেয়েটি কানে শুনতে পারে না; কথাও বলতে পারে না। তাই ও আপনার কাছে আসেনি।’

ব্যাপারটা শুনে আমি হাঁ করে শ্বাস নিলাম। দুঃখে আনমনে বিড়বিড় করতে লাগলাম, এতটা বিভ্রান্ত হলাম যে কী বলব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বাচ্চাটির দিকে অযাচিতভাবে এগিয়ে যাওয়া, যে আমার কথার উত্তর দিতে পারবে না, ভেবে লজ্জিত বোধ করলাম। মনে হলো, আমি মেয়েটি ও তার অসহায় পিতা-মাতার সঙ্গে সঠিক আচরণ করিনি।

এরপর আর বুঝতে দেরি হলো না, বেচারা পিতা-মাতাকে প্রায় প্রতিদিনই এ রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। প্রতিদিনই দু-একজন অতিথি চলে যায়, আবার কেউ না কেউ আসে। প্রথম দিনেই কিংবা পরবর্তী কোনো একসময়ে তারা মেয়েটিকে দেখে এগিয়ে যায়। মেয়েটির রূপ ও লাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে চায়। আবার কেউ কেউ সস্নেহে তার মাথায় হাত রাখে। এবং প্রতিবারই মেয়েটি মলিন মুখে তাকায়, এরপর নীরবে চোখের আড়ালে চলে যায়। পিতা-মাতার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ে। অতিথিদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। মেয়েটির এ অবস্থার কারণ ব্যাখ্যা করতে হয়। অনুসন্ধিৎসু অতিথিদের কেউ কেউ জানতে চায়, কোন দুর্ঘটনায় এমনটি হয়েছে। অনেকে আবার প্রশ্ন করে, পরিবারের আর কেউ এমন প্রতিবন্ধী আছে কি-না অথবা মেয়েটির যথাযথ চিকিৎসা করা হচ্ছে কি-না।

এত সব কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে পিতা-মাতা যেমন বিব্রত হয়, তেমনি মানসিক যন্ত্রণাবোধ করে। যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে মর্মাহত করেছে, তা হলো এমতাবস্থায় মেয়েটির একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। তার চোখ ও মুখে আতঙ্ক ও বেদনার ছায়া। কারণ সে বুঝতে পারে, তাকে নিয়েই এসব জল্পনা-কল্পনা। গেস্টহাউসে ঘুরে বেড়ানো আর ভৃত্যদের সঙ্গে খেলাধুলা করে তার সময় কাটে। সে কোনো স্কুলে যায় না। আশপাশে তেমন কোনো স্কুল নেই যে তাকে প্রয়োজনীয় শিক্ষাদান করতে পারে। পিতা-মাতা নিজেরা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, মেয়েটি কানে শোনে না। কেউ না জেনে তার কানের কাছে জোরে চিৎকার করলে সে কিছুই বলতে পারে না। কেবল নির্বোধ প্রাণীর মতো অস্ম্ফুট স্বরে তার আনন্দ-বেদনার কথা ব্যক্ত করে। অথবা এ্যা..এ্যা..কিংবা আ..আ..শব্দ করে। কখনও আবার হাত নেড়ে তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে, যা কেউ বোঝে না। কী এক মনঃকষ্ট তার চোখেমুখে ফুটে ওঠে।

বারংবার এমন অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে মেয়েটিকে রেহাই দিতে আমি ভান্ডারী দম্পতিকে একটি কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দিলাম। উদ্বিগ্ন পিতা-মাতা সচেষ্ট হতে রাজি হলো। স্থির করলাম, একটি চিঠি টাইপ করে এবং তা খামে ভরে গেস্টহাউসে আগত প্রত্যেক অতিথির হাতে দেবো। চিঠির বিষয় হবে :’আমাদের কন্যাসন্তানটি মূক ও বধির। তার সঙ্গে কেউ কথা বলতে গেলে বা তাকে আদর করতে গেলে, সে বিচলিত বোধ করতে পারে। কারণ সে কানে শোনে না, কথাও বলতে পারে না। অনুগ্রহ করে তাকে সময় দেবেন, যখন সে স্বেচ্ছায় আপনার কাছে এগিয়ে আসবে এবং পরিচিত হবে। অশেষ ধন্যবাদ।’

এমন একটি চিঠি স্বল্প কয়েক রাত্রির জন্য আগত অতিথিদের মনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করতে পারে, এমনকি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। সর্বোপরি গেস্টহাউসের সুনামের কথা ভেবে মিসেস ভান্ডারী এ ব্যাপারে ততটা আগ্রহী ছিল না। অচেনা-অজানা অতিথিদের সামনে মেয়েটির অযথা বিড়ম্বনা ও অসহায়ত্বের কথা বিবেচনা করে মিসেস ভান্ডারী যা হোক, অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হলো।

তবে কৌশলটি অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে, এমনকি আমাদের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। চিঠি পড়ার পর দু-একজন অতিথি অবশ্য পিতা-মাতাকে সহানুভূতিমূলক বিভিন্ন প্রশ্ন করত। তবুও যা হোক, মেয়েটি অন্তত যন্ত্রণা থেকে নিস্কৃতি পেয়েছে। এরপর মেয়েটি নিজেই অনেক অতিথির কাছে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসত। ভান্ডারী দম্পতি দেখে স্বস্তি বোধ করল। চিন্তা করল, সাময়িক হলেও ওদের কষ্টের কিছুটা অন্তত নিরসন হয়েছে।

এরই মধ্যে আমি স্থির করলাম, নিকটবর্তী পাহাড়ের পাদদেশে সংক্ষিপ্ত প্রমোদ ভ্রমণে যাব, যেখানে অনেক গিরিগুহা আছে। আগের দিন সন্ধ্যাবেলা গেস্টহাউস থেকে লাঞ্চ বক্স নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কথা বলতে এসে দেখি মিস্টার ভান্ডারী খুব ব্যস্ত। শুনলাম একজন অতিথি আসছে। সে বেশ কিছুদিন থাকবে। তার জন্য ঘরদোর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে। যে কোনো মুহূর্তে সে মেইল ট্রেনে এসে পৌঁছাবে।

সত্যি, কিছুক্ষণের মধ্যে সেই অতিথি কুলির কাঁধে মালপত্রসহ এসে উপস্থিত হলো। প্রায় পঁচিশ বছর বয়স্ক এক তরুণ। দেহে ঢিলেঢালা পোশাক, দীর্ঘপথ ভ্রমণে ক্লান্ত, অবিন্যস্ত মাথার চুল, তার গলার পরিহিত টাই, পায়ে জুতা। কিন্তু তার হাসিমাখা মুখ, চোখের সুদীপ্ত চাহনি যে কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো।

মিস্টার ভান্ডারী এগিয়ে এসে সাদরে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনিই তো মিস্টার ডেভিড?’

নবাগত অতিথি তার মুখের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে মাথা নাড়ল।

‘আপনার আঠারো নম্বর কক্ষ। দয়া করে ভেতরে চলে যান।’

এবারও তরুণ অতিথি মিস্টার ভান্ডারীর দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে মাথা নেড়ে অভিবাদন জানাল। প্রাপ্য ভাড়ার চেয়ে কিছুু অতিরিক্ত ভাড়া দেওয়ায় কুলি সহাস্যে মাথা নুইয়ে মিস্টার ডেভিডকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বিদায় নিলো। আমার দিকে বন্ধুভাবাপন্ন দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে সে মিস্টার ভান্ডারীর প্রদত্ত গেস্ট রেজিস্ট্রেশন খাতাটি পূরণ করল।

এমন সময় মিস্টার ডেভিড লক্ষ্য করল, তার নামে খামের ভেতর টাইপ করা একটি চিঠি। সে খামটি খুলল। সে মুহূর্তে মিসেস ভান্ডারী ঘরে এসে উপস্থিত। স্বামীর কাছে নতুন অতিথি এসেছে জেনে এগিয়ে এসে তার সঙ্গে হাত মেলাল।

‘আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো, মিস্টার ডেভিড?’ মিসেস ভান্ডারী সবিনয়ে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞাসা করল।

আগত অতিথি মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বোঝাল, ‘যেমন সুবিধা বোধ করিনি, তেমনি কোনো অসুবিধাও বোধ করিনি।’

‘আপনি কি এখন গরম জলে স্নান করবেন, নাকি আপনাকে আগে এক কাপ চা দেবো।’ নবাগত অতিথি ঠোঁট ভাঁজ করে কাঁধ ঝুঁকিয়ে বোঝাল, ‘যা খুশি, তার কোনো আপত্তি নেই।’

ভান্ডারী দম্পতি অতিথির মেজাজ ও উদ্ধতভাব অনুমান করে বিচলিত বোধ করল, কারণ সে তাদের বিনম্র প্রশ্নের কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনই বোধ করছে না।

এরই মধ্যে নবাগত অতিথি টাইপ করা চিঠি পড়তে শুরু করেছে। চিঠি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎসুক নয়নে সে চারদিকে তাকাতে থাকে। ছোট্টখুকি প্রমোদনী সে সময় বারান্দায় খেলায় মত্ত। আমরা দেখলাম, সে একটি ফুলের ঝাড়ের কাছে বসে খেলছে। নবীন অতিথি আমাদের দিকে চেয়ে হাসতে হাসতে দ্রুত প্রমোদনীর কাছে ছুটে গেল।

‘এ দেখছি অদ্ভুত ব্যাপার,’ মিসেস ভান্ডারী চিৎকার করে প্রতিবাদ করল, ‘এত নিষ্ঠুর এই লোকটি!’

‘এভাবে আমাদের অনুরোধকে উপেক্ষা করা তার উচিত হয়নি,’ মিস্টার ভান্ডারী মন্তব্য করল।

আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। ভাবলাম গেস্টহাউসে আগত অতিথিদের কাছে অবলা মেয়েটিকে বিব্রত হওয়া থেকে সুরক্ষার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে চলেছে।

অল্প কিছুক্ষণ পরে আমরা বারান্দার কাছে গেলাম। আশঙ্কা করেছিলাম, হয়তো মাতা-পিতা ও কন্যার বেদনাহত মুখ দেখতে হবে।

কিন্তু যে দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ল, তা কল্পনাতীত। দেখলাম, আমাদের অতিথি মাটিতে ঘাসের ওপর উপবিষ্ট এবং তার কোলে বসে প্রমোদনী হাসিমুখে রঙ-বেরঙের ফুল দেখছে।

হঠাৎ বন্দুকের আওয়াজের মতো প্রমোদনীর কণ্ঠনিঃসৃত কর্কশ হাসি বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। পিতা-মাতা উভয়ে আনন্দ ও আশ্চর্যে অভিভূত হয়ে একে অপরের দিকে তাকাতে লাগল।

‘আমাদের মেয়েটিকে বহু বছর এমন হাসতে দেখিনি!’ মিসেস ভান্ডারী বলল।

অস্বাভাবিক, দেখলাম ওরা দু’জন হাতে হাত ধরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি আসতেই প্রমোদনী দৌড়ে তার মায়ের কাছে এলো এবং জড়িয়ে ধরে খুশিতে নাচতে লাগল। অতিথিকে লক্ষ্য করে ম্যা…ম্যা…অবোধ্য অস্ম্ফুট শব্দ উচ্চারণ করতে লাগল।

মনে হলো কেউ নয়, একমাত্র মিস্টার ডেভিডই আমাদের এই দুর্দশা থেকে উদ্ধার করতে পারে।

সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারলাম যে সে নিজেও মূক ও বধির।

তার অদ্ভুত সন্দেহজনক নীরবতা, চিঠি পাওয়ার পর প্রমোদনীর কাছে এগিয়ে যাওয়া- সবকিছু আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল। বিষয়টি অনুধাবন করতে আমাদের কিছুটা সময় লেগেছে মাত্র। যা হোক, পিতা-মাতা উভয়ে একেক সময় একেক রকম অসংলগ্ন মন্তব্য করার জন্য মিস্টার ডেভিডের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করল। কিছু মৌখিকভাবে আর কিছু ইশারা-ইঙ্গিতে তাদের দুঃখ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। পিতা-মাতার বক্তব্য বিষয় বুঝতে যুবকের কোনো অসুবিধা হলো না। সে ঠোঁট নড়া দেখেই ওদের কথা বুঝতে পেরে ইশারায় গেস্টহাউসের আতিথেয়তা ও ব্যবস্থাপনার প্রশংসা করল। কোনো জটিল ও বিস্তৃত বিষয়াদি বোঝাতে সে কাগজ ও কলম ব্যবহার করে থাকে।

পরের দিন অনেক কিছু জানতে পারলাম। মিসেস ভান্ডারী অনর্গল কথা বলে চলেছে। এত কথা যে কখনও বলত না। প্রমোদনীর জন্য যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হবে মিস্টার ডেভিড সে সম্পর্কে ভান্ডারী দম্পতির কাছে তার সংক্ষিপ্তসার ও রূপরেখা বর্ণনা করেছে। মিস্টার ডেভিড বলেছে, এমন বিকলাঙ্গদের জন্য স্কুল আছে, যা সাধারণ মানুষের জন্য খুব ব্যয়বহুল। সে বিদেশে এমনি একটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভ করেছে এবং দেশে ফিরে এসেছে সে রকম একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে মানুষের সেবা করবে। অসীম কৃতজ্ঞতায় আবেগাপ্লুত কণ্ঠে মিসেস ভান্ডারী জানাল, সেই স্কুলের প্রথম শিক্ষার্থী হবে আমাদের প্রমোদনী। অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে মিস্টার ডেভিড আশ্বাস দিয়েছে যে প্রমোদনী একদিন আমাদের মতোই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে সক্ষম হবে। মিসেস ভান্ডারী শিশুর মতো আনন্দে উল্লসিত হলো। খুশিতে আমাদের খাবার টেবিলে বেশি করে ফলের রস, মাখন ও মধু পরিবেশন করল।

মিসেস ভান্ডারীকে দেখে মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ও সৌভাগ্যবতী মা।

লেখক পরিচিতি:

বরেণ্য কথাশিল্পী চমন নাহাল ২ আগস্ট ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে অধুনা পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত শিয়ালকোটে জন্মগ্রহণ করেন। ভারতবর্ষে ইংরেজি ভাষার সাহিত্য-শিল্পীদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তার সর্বাধিক জনপ্রিয় উপন্যাস ‘আজাদী’ ভারতের সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার লাভ করে। তার অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘মাই ট্রু ফেসেস’, ‘ইনটু অ্যানাদার ডন’, ‘দ্য ইংলিশ কুইন্স’ এবং গল্পগুচ্ছ ‘দ্য ওয়্যারড ডান্স অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’। এ ছাড়া তার রচিত ‘ডি এইচ লরেন্স :অ্যান ইস্টার্ন ভিউ’ এবং ‘দ্য ন্যারেটিভ প্যাটার্ন ইন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে’স ফিকশন’ আন্তর্জাতিক পাঠকমহলে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে। তিনি আমেরিকার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে ফুলব্রাইট ফেলো হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। চমন নাহাল ২৯ নভেম্বর ২০১৩ সালে ইহলোক ত্যাগ করেন। প্রকাশিত গল্পটি তার রচিত ‘দ্য সিলভার লাইনিং’-এর বঙ্গানুবাদ।

ভাষান্তর: নীতিন রায়
আডি/ ০৯ অক্টোবর

Back to top button