ঢালিউড

বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকের মুক্তি নিয়ে ধোঁয়াশা

ঢাকা, ০৩ সেপ্টেম্বর – জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনীভিত্তিক চলচ্চিত্র (বায়োপিক) ‘মুজিব :দ্য মেকিং অব এ নেশন’ এই সেপ্টেম্বরে মুক্তি পাওয়ার কথা থাকলেও তা আর হচ্ছে না। চলচ্চিত্রে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রটির উপস্থাপন নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। এ নিয়ে সরকারের উচ্চ মহলেও রয়েছে অসন্তুষ্টি। চূড়ান্ত সম্পাদনার পর এটি মুক্তি দেওয়া হবে, নাকি নতুন কোনো সিদ্ধান্ত আসবে- তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

চলচ্চিত্রটির সম্পাদনা কাজ চলার সময় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক ব্যক্তি বিভিন্ন অংশের কাজ দেখেছেন। তবে কাজের মান দেখে তাঁরা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তথ্য সচিব মকবুল হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ওপর নির্মিত হতে যাওয়া চলচ্চিত্রটি খুব গুরুত্ব দিয়ে করা হচ্ছে। আমরা আশা করেছিলাম, সেপ্টেম্বরে এটির কাজ শেষ হবে। এই সময়ের মধ্যে পুরো কাজ শেষ হবে কিনা, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, বায়োপিকের কোনো অংশ আমার দেখার সুযোগ হয়নি। তাই এটি কেমন হয়েছে, সে বিষয়ে মন্তব্য করতে পারছি না।

কান চলচ্চিত্র উৎসবের বাণিজ্যিক শাখা মার্শে দ্যু ফিল্মের অংশ হিসেবে ভারতীয় প্যাভিলিয়নে গত ১৯ মে ‘মুজিব :দ্য মেকিং অব এ নেশন’-এর ট্রেলার প্রকাশ হয়। দেড় মিনিটের ওই ট্রেলারে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রটি দেখে হতাশ অনেকেই। প্রশ্ন ওঠে- এ কোন বঙ্গবন্ধুকে দেখালেন ভারতীয় নির্মাতা শ্যাম বেনেগাল! ট্রেলারে ভিজুয়াল ইফেক্টস, বঙ্গবন্ধুর মেকআপ-গেটআপ ইত্যাদি নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। সে সময় ছবিটির পরিচালক শ্যাম বেনেগাল ও মূল চরিত্র আরিফিন শুভ অল্প সময়ের ট্রেলারে হতাশ না হয়ে ভালো কিছুর জন্য অপেক্ষা করার আশ্বাস দেন। এখন প্রত্যাশিত সময়ে ছবিটির মুক্তি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হওয়ায় সংশ্নিষ্টদের মধ্যে আগের শঙ্কাই নতুন করে জাগছে।

বায়োপিকের কাজ শুরু হয়েছে ২০২০ সালের শুরুর দিকে। গত মার্চে এটি মুক্তির সময় নির্ধারিত ছিল। সেটি পিছিয়ে সেপ্টেম্বর করা হয়; তাও হচ্ছে না। বায়োপিকের নির্বাহী প্রযোজক ও বাংলাদেশ ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের (বিএফডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুজহাত ইয়াসমিন বলেন, ট্রেলার প্রকাশের পর যেসব বিষয়ে সমালোচনা হয়েছে, তা জোরালোভাবে আমলে নিয়ে আবারও সম্পাদনার কাজ চলছে। তিনি বলেন, সেপ্টেম্বরে মুক্তির কথা ছিল। তবে ট্রেলার প্রকাশের পর কয়েক জায়গায় ভুল ও ভিএফএক্সের (ভিজুয়াল ইফেক্টস) কাজের দুর্বলতা ধরা পড়ে। সেটার পরিমার্জন চলছে। তাই মুক্তি সেপ্টেম্বর থেকে পেছাচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম ও কর্মময় জীবনের অধিকারী। তাঁর জীবন ও কর্ম তুলে ধরতে বাংলাদেশ ও ভারত যৌথভাবে এ বায়োপিক তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। এতে শেখ মুজিবের পারিবারিক জীবনের অনেক অজানা অধ্যায়ও উঠে আসার কথা জানিয়েছেন সংশ্নিষ্টরা।

সিনেমাটির নির্বাহী প্রযোজক নুজহাত জানান, এটি নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৭০ কোটি রুপির চুক্তি হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮৩ কোটি টাকা। বাজেটের ৬০ শতাংশ অর্থ বাংলাদেশের দেওয়ার কথা; বাকি ৪০ শতাংশ অর্থ দেবে ভারত।

দেড় মিনিটের ট্রেলার: বায়োপিকটির প্রকাশিত দেড় মিনিটের ট্রেলারে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের যে অংশটুকু দেখানো হয়েছে, তাতে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের চোখে চশমা দেখা গেছে। বাস্তবে চশমা ডায়াসের ওপরে ছিল। অন্যদিকে ট্রেলারে যেসব দৃশ্য দেখানো হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের দুই ধরনের পতাকা দেখানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পতাকার মাঝামাঝি (লাল বৃত্তের মধ্যে) দেশের মানচিত্র আঁকা ছিল। পরে মানচিত্র বাদ দিয়ে শুধু লাল-সবুজের পতাকা চূড়ান্ত হয়েছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ঘটনায় বাংলাদেশের বর্তমান পতাকা সামঞ্জস্যহীন দৃশ্যের অবতারণা করেছে। এ ছাড়া ১৪ সেকেন্ডে যুদ্ধবিমানের যে ভিজুয়াল ইফেক্টস, তার মান নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে।

বায়োগ্রাফির যে দিকটার সবচেয়ে বেশি দুর্বলতা নজরে এসেছে- ভিএফএক্সের কাজ ও অসংগতিগুলো নতুন করে ভারতে সম্পাদনা করা হচ্ছে। এ তথ্য জানিয়েছেন চলচ্চিত্রটির সহকারী নির্মাতা ও কাস্টিং ডিরেক্টর বাহাউদ্দিন খেলন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে সেপ্টেম্বরে মুক্তির তারিখ এক রকম ঠিক হয়েছিল। তবে আমরা যখন ট্রেলার প্রকাশ করি, তখন অনেক ভুলত্রুটি ধরা পড়ে। এখন সবকিছু আবার দেখা হচ্ছে। ইনশাআল্লাহ, এর পর আর কোনো দুর্বলতা থাকবে না। ছবিটি মুক্তির পর বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়াবে।

বাহাউদ্দিন আরও বলেন, ছবিটি সরকারের ঊর্ধ্বতন একটা টিম দেখেছে। চূড়ান্ত কারেকশন হয়ে এলে দেশের সিনেমা বোদ্ধাদের একটি টিম ও বিজ্ঞ ব্যক্তিদের দেখানো হবে। তাঁদের মতামতও নেওয়া হবে। তাঁদের কাছ থেকে ইতিবাচক বার্তা পেলেই বায়োপিক চূড়ান্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেখানো হবে। তাঁর অনুমোদনের পরই মুক্তি পাবে ‘মুজিব :দ্য মেকিং অব এ নেশন’।

জানতে চাইলে তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক তৈরি একটি বিশাল কাজ। পরিকল্পনা নিয়ে এটি শুধু করে ফেললেই হবে না। তাই আমি তথ্যমন্ত্রী থাকাকালে এ বিষয়ে দেশের শীর্ষ চলচ্চিত্র পরিচালক ও চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের নিয়ে একাধিক বৈঠক করেছি। সেসব বৈঠকে বিদেশি কোনো পরিচালককে দিয়ে বায়োপিক পরিচালনার বিপক্ষে মত আসে।

প্রখ্যাত নির্মাতা ও নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু জানান, ছবিটি প্রথম তাঁরই নির্মাণ করার কথা ছিল। পরে শ্যাম বেনেগালকে চূড়ান্ত করা হয়। তাঁর মতে, বাংলাদেশের কোনো নির্মাতা যদি বায়োপিকটি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত থাকতেন, তাহলে আরও ভালো হতো।

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিম বলেন, ভারতের নির্মাতারা ভালো হলেও তাঁরা কীভাবে বুঝবেন- বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমাদের আবেগটা ঠিক কোথায়? এই সিনেমা বানানোর আগে বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে, যেটা বাংলাদেশের মানুষ ছাড়া সম্ভব নয়। তবে আমি চাইব, জাতির পিতার বায়োপিক যেন যথাযথভাবে আমাদের সামনে হাজির হয়।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি সোহানুর রহমান সোহানও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন। তাঁর মতে, ছবিটিতে বাংলাদেশের নির্মাতাদের একটি টিম থাকলে ভালো হতো। শুধু ট্রেলার দেখে আন্দাজ করা যায় না, সিনেমাটি কেমন হবে। তিনি বলেন, শ্যাম বেনেগাল একজন বিজ্ঞ নির্মাতা। গান্ধী, নেহরু বা সুভাষ বোসকে নিয়েও কাজ করেছেন। আশা করি, বায়েপিকের চূড়ান্ত কপি যখন আসবে, তখন উপযুক্তভাবেই আসবে।

সূত্র: সমকাল
আইএ/ ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

Back to top button