পরিবেশ

বিশ্বজুড়ে বন্যা, খরা, দাবদাহ ও দাবানল: সামনে আরও বড় বিপদ

মাহবুবুল আলম তারেক

গত কয়েক বছর ধরেই বিশ্বব্যাপী দাবদাহ তথা তীব্র তাপপ্রবাহ, আকস্মিক বন্যা, খরা, দাবানল, ঝড়, জলোচ্ছাস সহ চরম আবহাওয়ার ঘটনা বেড়েই চলেছে। আর চলতি বছরে ইতিমধ্যেই বিশ্বজুড়ে একই সঙ্গে নেমে এসেছে বন্যা, খরা, দাবদাহ এবং দাবানলের মতো মারাত্মক সব প্রাকৃতিক বিপর্যয়।

চলতি মাসে চীন গত ৬০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হয়েছে। প্রায় পুরো ইউরোপ মহাদেশ বিধ্বংসী দাবানলের কবলে পড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশে বন্যার তাণ্ডব চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও একপ্রান্তে বন্যা তো আরেক প্রান্তে চলছে খরা। মধ্য এশিয়ার দেশ কিরগিজস্তান এবং তুর্কমেনিস্তানেও তীব্র তাপপ্রবাহ দেখা গেছে। আগস্ট মাসে ব্রাজিলের অ্যামাজন বনে গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ দাবানলের ঘটনা ঘটেছে।

বিশ্বজুড়ে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়কর ঘটনাগুলোর অনেকগুলো শতাব্দীর না হলেও গত কয়েক দশকের রেকর্ড ভেঙেছে।

কম বৃষ্টি এবং অতিরিক্ত তাপদাহের কারণে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের বড় বড় নদীগুলো সব শুকিয়ে যাচ্ছে। অনেক নদীর পানি এতটাই কমে গেছে যে, দেখলে মনে হবে যেন বড় কোনো খাল।

ভারতে এবছর ২২০ দিনেরও বেশি সময় ধরে তীব্র তাপপ্রবাহ চলেছে। যেখানে গত বছর মাত্র ৩৬ দিন ছিল এমন তাপপ্রবাহ। একদিকে ভারতের কয়েকটি প্রদেশ বন্যায় বিপর্যস্ত, অন্যদিকে উত্তর প্রদেশ এবং বিহার পড়েছে খরার কবলে।

এবারের বর্ষা মৌসুমে পাকিস্তানে স্বাভাবিকের চেয়ে ৬০% বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। যার ফলে দেশটিতে দেখা দিয়েছে ব্যাপক বন্যা ও ভুমিধস এবং সেখানে ইতিমধ্যেই মৃত্যুর সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে গেছে। পাকিস্তানের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ এই বন্যায় দেশটির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা পানিতে সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে। এই অস্বাভাবিক বন্যার আগে পাকিস্তান দাবদাহেও পুড়েছে। গত মে মাসে পাকিস্তানে তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছিল।

আফগানিস্তানও ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে এবং ইতিমধ্যেই দেশটিতে কয়েকশত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গত জুনের শেষে বাংলাদেশেও আকস্মিকভাবে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে পুরো উত্তর-পূর্বাঞ্চল তলিয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশে এবার বর্ষাকালে অর্থাৎ জুলাই ও আগস্টে গত চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। শুধু তাই নয়, এ দুই মাসে দেশে দাবদাহের মতো পরিস্থিতিও দেখা গেছে।

চীন একই সঙ্গে আকস্মিক বন্যা, খরা এবং তীব্র তাপপ্রবাহের কবলে পড়েছে এবছর। দেশটির ৮টি প্রদেশের তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আড়াই শতাধিক শহরের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করেছে। এরপর গত শনিবার থেকে চীনের সিচুয়ান প্রদেশে চোখ রাঙাচ্ছে অতিবৃষ্টি। আগামী কয়েক দিনেও সেখানে ভারী বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। ফলে দেখা দিয়েছে বন্যার আশঙ্কা।

দক্ষিণ কোরিয়ায়ও ব্যাপক বন্যা হয়েছে এবছর। গত মাসে মাত্র কয়েকদিনেই দেশটিতে প্রায় এক মাসের সমান বৃষ্টিপাত হয়। কোরীয় উপদ্বীপের গড় তাপমাত্রা ১৯১২ সালের চেয়ে ১.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে।

গত ১০ আগস্ট বিশ্বের শুষ্কতম স্থান যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার মৃত্যু উপত্যকায় এক হাজার বছরের মধ্যে চতুর্থবার এবং গত একশ বছরের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো বন্যা হয়েছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টির জেরেই বানভাসি হয় ক্যালিফোর্নিয়ার মৃত্যু উপত্যকা, যা এক নজিরবিহীন ঘটনা। এছাড়া দেশটির একপ্রান্ত ডুবেছে বন্যায় তো অন্যপ্রান্ত পুড়ছে দাবানলে।

যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলে নজিরবিহীন খরায় দেশটির বৃহত্তম জলাধারগুলো শুকিয়ে গেছে। টেক্সাস থেকে উত্তর ডাকোটা এবং ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত দেশটির ১৫টি রাজ্যে খরায় নষ্ট হয়ে গেছে কৃষকদের ফসল। দেশটির মোট কৃষি উৎপাদনের অর্ধেকই হয় ওই অঞ্চলে। অন্যদিকে, কেনটাকির পর এবার বন্যায় ডুবেছে মিসিসিপি অঙ্গরাজ্য।

ওদিকে, গত ৫০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ খরার কবলে পড়েছে ইউরোপ। ইউরোপের অন্তত ১৯টি দেশে দাবানলের আগুনে পুড়ে গেছে লাখ লাখ হেক্টর বনভুমি। চরম তাপপ্রবাহে মৃত্যু হয়েছে হাজার হাজার মানুষের।

আন্তর্জাতিক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং গবেষকরা এইসব চরম আবহাওয়ার ঘটনা বেড়ে চলার জন্য মানব প্রজাতির অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের ফলে সৃষ্ট বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলোর ৭১ শতাংশের জন্যই মনুষ্যসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনই দায়ী।

চলতি বছরে এভাবে একসঙ্গে একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসার ফলে অর্থনীতির ওপরও চরম আঘাত আসতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তীব্র তাপপ্রবাহ এবং খরার কারণে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তিন অর্থনীতি- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং চীনের প্রবৃদ্ধি ইতিমধ্যেই স্থবির হয়ে পড়েছে।

করোনা মহামারীর পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ইতিমধ্যেই মন্থর হয়ে এসেছিল এবং দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস উঠছিল জনগণের। তার মধ্যেই বিশ্ব অর্থনীতির ওপর এই নজিরবিহীন তাপপ্রবাহ এবং খরার আঘাত পরিস্থিতিকে আরও শোচনীয় করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

অক্সফোর্ড ইকোনমিক্সের গ্লোবাল ম্যাক্রো রিসার্চের পরিচালক বেন মে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, চলতি বছরের খরার প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পড়বে বিশ্ব।

ওদিকে, আগামী কয়েক দশকে বিশ্বে এমন তীব্র তাপপ্রবাহ নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে উঠবে বলে সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড এবং ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে কমিউনিকেশনস আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট নামের জার্নালে। সেখানে গবেষকরা বলেছেন, আগামী কয়েক দশকে বিশ্বে দাবদাহ প্রতি বছরের নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠতে পারে। আর পৃথিবীর মধ্য-অক্ষাংশ এবং গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের ওপর এর প্রভাব পড়বে সবচেয়ে বেশি।

গবেষণার প্রধান লেখকদের একজন এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু গবেষক লুকাস ভার্গাস জেপেটেলো বলেছেন, একটা বিষয় খুবই পরিষ্কার যে, চরমমাত্রার তাপপ্রবাহের ঘটনা আগামী দিনে ঘন ঘন ঘটতে থাকবে এবং মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে তুলবে। বিশেষকরে, চলতি শতকের শেষদিকে ঘন ঘন চরমমাত্রার তাপপ্রবাহের কারণে পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধে বসবাসকারী শত শত কোটি মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়বে।

জেপেটেলোর নেতৃত্বে হার্ভার্ড এবং ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষক দল তাদের গবেষণায় ঐতিহাসিক জলবায়ু তথ্যভাণ্ডার ব্যবহার করেন এবং ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা কেমন হতে পারে তা অনুমান করার জন্য একটি সম্ভাব্য সূত্র তৈরি করতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং কার্বন নির্গমনের ভবিষ্যত অনুমানগুলোর সঙ্গে সেই তথ্যরাজির সমন্বয় করেন। এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের গবেষণাকে সর্বোচ্চ নির্ভুল করার চেষ্টা করেন।

বিশেষকরে, হিট ইনডেক্স তথা বৈশ্বিক তাপ সূচকে পরিবর্তনের একটি নির্ভুল পূর্বাভাস দেওয়ার চেষ্টা করেন তারা। তাপ সূচক হলো, বায়ুর তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার সংমিশ্রণ তথা যেভাবে তাপের প্রভাব মানবদেহে অনুভূত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিসের মতে, তাপ সূচক তাপমাত্রা ৩৯.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছালে সেটা ‘বিপজ্জনক’ আর ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছালে সেটা ‘চরম বিপজ্জনক’ বলে বিবেচিত হয়।

তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, এমনকি আমরা যদি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বাড়ার হার শিল্পবিপ্লবের আগের গড় তাপমাত্রার উপরে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেও সীমাবদ্ধ রাখতে পারি, তবুও চলতি শতকের মধ্যেই বিশ্বজুড়ে তাপসুচক তাপামাত্রা বিপজ্জনক মাত্রা তথা ৩৯.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাবে।

বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, ২১০০ সালের মধ্যেই পশ্চিম ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং জাপানে প্রতিবছর তিন থেকে ১০ বার তাপসূচক তাপমাত্রা বিপজ্জনক মাত্রা অতিক্রম করবে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল এবং এর আশেপাশের দেশগুলো সহ অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাঞ্চলে বছরের অর্ধেক সময়জুড়েই তাপমাত্রা বিপজ্জনক মাত্রা অতিক্রম করবে। আর বছরের অন্তত ১৫দিন তাপমাত্রা চরম বিপজ্জনক মাত্রা অতিক্রম করবে। ওই সময়টাতে কৃষকদের মতো ঘরের বাইরে কাজ করা মানুষদের নিরাপদ থাকাটা সবচেয়ে কঠিন হয়ে উঠবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক ইউনিভার্সিটির জলবায়ু গবেষক লুক পারসন্সের মতে, সেসময়কার বাস্তব পরিস্থিতি হয়তো এই গবেষণায় যেমনটা ইঙ্গিত মিলেছে, তার চেয়েও অনেক বেশি ভয়াবহ হতে পারে। কারণ, সাধারণত ছায়ায় থাকা একটি থার্মোমিটার দিয়ে আবহাওয়া স্টেশন থেকে বায়ুর তাপমাত্রা মেপে তাপ সূচকের তাপমাত্রা পরিমাপ করা হয়। কিন্তু আমরা যদি গ্রীষ্মের মধ্যদুপুরে সূর্যের দহনও বিবেচনায় রাখি তাহলে সেসময়কার তাপ সূচক তাপমাত্রা আরও কয়েক ডিগ্রি বেশি হতে পারে। যা পরিস্থিতিকে সত্যিই খুব ভয়ঙ্কর করে তুলতে পারে।

বিজ্ঞানীদের মতে, এই আসন্ন বিপদের মাত্রা কিছুটা হলেও কমিয়ে আনার একমাত্র উপায় হলো, বিশ্ব অর্থনীতিতে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া এবং যত দ্রুত সম্ভব একেবারে শুন্যে নামিয়ে আনা। কিন্তু এখনো পর্যন্ত বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মধ্যে সেই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তবে, ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হলো, বাংলাদেশ সহ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের যেসব দেশ এই চরম তাপপ্রবাহের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে সেসব দেশের বেশিরভাগই খুব গরীব দেশ। অথচ এই বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য তারাই সবচেয়ে কম দায়ী।

এম ইউ/০২ সেপ্টেম্বর ২০২২

Back to top button