জাতীয়

বিদেশে চিকিৎসায় বছরে ব্যয় ৩০ হাজার কোটি টাকা

ঢাকা, ৩১ আগস্ট – কয়েক বছরের ব্যবধানে দেশে অসংক্রামক রোগ ব্যাপক বেড়েছে। কিন্তু দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখতে না পেরে অনেকে বিদেশে গিয়ে এসব রোগের চিকিৎসা নিচ্ছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, গড়ে প্রতিবছর পাঁচ লাখ মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে। এতে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে।

এর বড় অংশই যায় ভারতে।
বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমসিএ) ও বাংলাদেশ সোসাইটি অব প্রাইভেট হসপিটালস সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। গত বছর যেসব মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতে দেশের বাইরে গেছে, তাদের শুধু চিকিৎসা বাবদ ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রতিটি রোগীর ভ্রমণ, থাকা, খাওয়া ও আনুষঙ্গিক ব্যয় রয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য বুলেটিনের তথ্য বলছে, দেশে রোগে ভুগে মারা যাওয়া মানুষের ৬৭ শতাংশই অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে হৃদরোগই প্রধান। অসংক্রামক রোগে মারা যাওয়া ৩০ শতাংশই হৃদরোগে আক্রান্ত। এর পরই আছে অপুষ্টি ও মাতৃত্বকালীন রোগে মৃত্যুর সংখ্যা, ২৬ শতাংশ। ক্যান্সারে মারা যায় ১২ শতাংশ। দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগে ১০ শতাংশ, জখমে (ইনজুরি) ৭ শতাংশ, ডায়াবেটিসে ৩ শতাংশ এবং অনান্য অসংক্রামক রোগে মারা যাচ্ছে প্রায় ১২ শতাংশ মানুষ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে অদক্ষতা ও আস্থার সংকটে বিদেশে যাচ্ছে রোগীরা। ভারত ছাড়া মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে যাচ্ছে চিকিৎসার জন্য।

‘কি রিজনস ফর মেডিক্যাল ট্রাভেল ফ্রম বাংলাদেশ টু ইন্ডিয়া’ শীর্ষক গবেষণার তথ্যে দেখা গেছে, বাংলাদেশের কোন শ্রেণি-পেশার মানুষ চিকিৎসার জন্য ভারতে বেশি যাচ্ছে তা-ও উঠে এসেছে গবেষণায়। এতে দেখা যায় ব্যবসায়ী, বেসরকারি চাকরিজীবী, ছাত্র-শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা ও শ্রমিকরা বেশি যাচ্ছেন ভারতে। গবেষণাপত্রে বলা হয়, এই মানুষদের বেশির ভাগই বলেছে, ডাক্তার ও নার্সিংসেবা ভালো পায় বলে তারা সেখানে যায়। দেশে কেন চিকিৎসা করাচ্ছেন না—এমন প্রশ্নে তাঁরা বলেছেন, আস্থা কম পান। কারণগুলোর মধ্যে এর পরই আছে অপর্যাপ্ত হাসপাতাল, রোগীর নিরাপত্তা এবং সবার পরে খরচের বিষয়টি।

ভারতে মেডিক্যাল ট্যুরিজমের ৫৫ শতাংশই বাংলাদেশি। গত তিন বছরে মেডিক্যাল ট্যুরিজমে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৮৩ শতাংশ। দেশটিতে মূলত হৃদরোগ, চোখের রোগ, ক্যান্সার, কিডনি, ফ্র্যাকচার, মেরুদণ্ড, পাকস্থলী ও ডায়াবেটিসের চিকিৎসা নিতেই যাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। ভারতের কলকাতা, নয়াদিল্লি, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, হায়দরাবাদ ও মুম্বাই শহরে বেশি যাচ্ছে বাংলাদেশিরা।

আলোক হেলথকেয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান হোসেনও বলেন, আস্থার অভাবে লাখ লাখ রোগী দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে। যাদের সুযোগ আছে তারা বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব জাতীয় অর্থনীতিতে পড়ছে। তিনি বলেন, ‘এটি আমাদের স্বাস্থ্য খাতের জন্য শুধু হুমকিই নয়, লজ্জাজনকও। ’

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের প্রতিবেদনের তথ্য মতে, খরচের কথা মাথায় রেখে দেশের ১৬.৪ শতাংশ পরিবার, অর্থাৎ তিন কোটির বেশি মানুষ হাসপাতাল, ক্লিনিক বা কোনো চিকিৎসকের কাছে যায় না। প্রয়োজন থাকলেও তারা সেবা নেয় না।

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার জন্য মোট যে ব্যয় হয় তার প্রায় ৭০ শতাংশই আসে নাগরিকদের নিজের পকেট থেকে। এটা সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। গত কয়েক দশকের ব্যবধানে স্বাস্থ্য ব্যয়ে ব্যক্তি খরচ দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।

গত কয়েক দশকে মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য, মোট প্রজনন হার এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃতি পেয়েছে। দেশে পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু অসংক্রামক রোগ, বিশেষ করে হৃদরোগ, কিডনি, স্নায়ুরোগ, ডায়াবেটিস, লিভার ও ক্যান্সারের মতো রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। হৃদরোগে আক্রন্ত মানুষের সংখ্যা দেশে প্রায় ৩০ লাখ। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা অর্ধকোটি ছাড়িয়েছে। বাড়ছে উচ্চ রক্তচাপের রোগী।

গত কয়েক বছরে দেশের বেসরকারি হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশ সোসাইটি অব প্রাইভেট হসপিটালসের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী বলেন, বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৬৫৪টি এবং এসব হাসপাতালে মোট শয্যাসংখ্যা ৫১ হাজার ৩১৬টি।

আর বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে পাঁচ হাজার ৫৫টি। বেসরকারি হাসাপাতালে মোট শয্যাসংখ্যা এক লাখ পাঁচ হাজার ১৮৩টি। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। বিদেশে যাওয়া রোগীদের আস্থায় আনতে পারলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বড় অংশ সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। ’

এ বিষয়ে ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এ এম শামীম বলেন, দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ স্বাস্থ্যসেবা বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হচ্ছে। বিশেষায়িত চিকিৎসার প্রায় ৯০ শতাংশই হচ্ছে বেসরকারি মাধ্যমে। একটা সময় ছিল যখন সব ধরনের পরীক্ষার জন্য যন্ত্রপাতি পাওয়া যেত না, রোগ নিরীক্ষণের জন্য বিদেশে যেতে হতো। যেসব পরীক্ষার জন্য একসময় প্রচুর টাকা খরচ হতো, সেসব পরীক্ষা এখন দেশে প্রতিদিন শত শত হয়। এর পরও বছরে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ বিদেশে চিকিৎসার জন্য যায়। তিনি বলেন, ‘দেখুন করোনার সময় কিন্তু দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলো সক্ষমতা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। গত দুই বছরে এসব মানুষ বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে পারেনি, দেশে চিকিৎসা নিয়েছে। আশা করছি, এখনো তারা দেশের মানসম্মত চিকিৎসার প্রতি আস্থা রাখছেন। ’

সূত্র: কালের কন্ঠ
আইএ/ ৩১ আগস্ট ২০২২

Back to top button