জানা-অজানা

যেভাবে মার্কিন ডলার হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাধারণ মুদ্রা

মানি, মুদ্রা বা অর্থকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। কমোডিটি মানি, রিপ্রেজেন্টেটিভ মানি এবং ফিয়াট মানি। কমোডিটি ইংরেজি শব্দের অর্থ হলো পণ্য। যে অর্থের অন্তর্নিহিত মূল্য আছে, সে ধরনের মানিকে বলা হয় কমোডিটি মানি। যেমন সোনা ও রুপার নিজস্ব মূল্য আছে।

আর তাই প্রাচীনকালে সোনা ও রুপাকে সরাসরি পণ্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এজন্য এই দুটি মুদ্রাকে কমোডিটি মানি বলা হতো। কাগুজে নোটের আগে ইতিহাসের অনেকটা সময় পর্যন্ত বাণিজ্যিক লেনদেনের জন্য কমোডিটি মানির প্রচলন ছিল।

তখন নির্দিষ্ট পরিমাণ কাগুজে মুদ্রার পরিবর্তে নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা পাওয়া যেত। এই অর্থকে বলা হয় রিপ্রেজেন্টেটিভ মানি অথবা কমোডিটি-বেজড মানি। কারণ, এই কাগুজে মুদ্রার সঙ্গে সোনার সরাসরি সংযোগ ছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেনসহ বেশির ভাগ দেশ অনেকটা বাধ্য হয়েই ‘স্বর্ণমান’ থেকে সরে আসে। তখন থেকে এসব দেশের মুদ্রা সোনার মানের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। মুদ্রার মানকে বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। তখন সোনার মান আর নির্দিষ্ট থাকেনি। চাহিদা আর জোগানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। পণ্যের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট নয়, এমন মুদ্রাকে বলা হয় ফিয়াট মানি।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটেন ছিল বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি। তাদের স্বর্ণের মজুত ছিল সবচেয়ে বেশি। তখন লন্ডন ছিল বিশ্ব ব্যাংকিংয়ের কেন্দ্র। ব্রিটিশ মুদ্রা পাউন্ড স্টার্লিং ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বহুল ও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো। ১৮৭০ দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়। বিংশ শতাব্দীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ইউরোপীয় দেশগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক সংগ্রামে লেগে যায়। অন্যদিকে যুদ্ধের ব্যয় বহন করার জন্য দেশগুলো তাদের স্বর্ণ মজুতের বিপরীতে যে পরিমাণ মুদ্রা ছাপানো যেত, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে কাগুজে নোট ছাপাতে শুরু করে।

আর এদিকে যুদ্ধের প্রথম তিন বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরতে রেখে; ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর কাছে সামরিক সরঞ্জাম ও রসদপত্র রপ্তানি করে নিজেদের অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। এই সময়ও যুক্তরাষ্ট্র তার রপ্তানিকৃত দ্রব্যাদির বিনিময়ে সোনা ছাড়া অন্যকিছু গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। আর এই নীতির ফলে তাদের স্বর্ণ মজুত ফুলেফেঁপে ওঠে। ১৯৪৭ সালে বিশ্বের মোট মজুতকৃত সোনার ৭০% মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তগত ছিল।

মার্কিন ডলারের প্রাসঙ্গিক কথা :

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি মুদ্রার নাম হলো মার্কিন ডলার (মুদ্রা প্রতীক: $; ব্যাংক কোড: USD)। এর সাংকেতিক চিহ্ন $, তবে অন্যান্য দেশের ডলার নামের মুদ্রা থেকে আলাদা করার জন্য আন্তর্জাতিক দলিলাদিতে মার্কিন ডলারকে US$ লেখা হয়। এর এক শতাংশের নাম সেন্ট। ১ ডলার ১০০ সেন্ট এর সমতুল্য। কাগুজে নোটের নকশা অনুযায়ী একে চলতি ভাষায় ‘গ্রিন বাক হিসেবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।

মার্কিন কংগ্রেস ১৭৮৫ সালে এটি প্রবর্তন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘হার্ড কারেন্সি’ হিসেবে পরিগণিত হয়। এটি বর্তমান-বিশ্বের সর্বাধিক প্রচলিত মুদ্রা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও আরও কিছু দেশ ডলারকে সরকারি মুদ্রা হিসাবে ব্যবহার করে। তবে সেগুলোর মূল্যমান আলাদা। মার্কিন ডলারের আন্তর্জাতিক ব্যবহার দু’ধরনের। প্রথমত এটি আন্তর্জাতিক দেনা-পাওনা মেটানোর মুদ্রা। দ্বিতীয়ত এটি বহুল প্রচলিত একটি ‘রিজার্ভ কারেন্সি’। তবে ইউরো প্রচলনের পর থেকে মার্কিন ডলারের প্রভাব ধীরে ধীরে কিছুটা কমতে শুরু করে।

১৯৯৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্ববাজারে চালু থাকা $৩৮০ বিলিয়ন (৩৮ হাজার কোটি) ডলারের দুই-তৃতীয়াংশই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে। ২০০৫ সাল নাগাদের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে $৭৬০ বিলিয়নে (৭৬ হাজার কোটি) পৌঁছেছে। এর অর্ধেকই রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে।

মার্কিন ডলার যেভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাধারণ মুদ্রা হলো কোনো একটি দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে সেই দেশের স্থানীয় মুদ্রার ব্যবহার প্রচলিত থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেমন ‘টাকা’ এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে গ্রহণযোগ্য। দেশের ভেতরে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে আমরা তাই টাকা ব্যবহার করি। কিন্তু যখন অন্য দেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করি; অথবা কোনো দেশে ঘুরতে যাই তখন আর দেশীয় মুদ্রা, টাকা ব্যবহার করতে পারি না। পছন্দের দেশে বাণিজ্য, ভ্রমণ বা চিকিৎসার প্রয়োজনে যেতে হলে; পাসপোর্টে তখন মার্কিন ডলার ইনডোর্স করে নিতে হয়।

তারপর ডলারকে, সেই দেশের মুদ্রায় কনভার্ট বা রূপান্তর করে, নিজেদের দরকারি কাজটা করে থাকি। অন্যদেশ থেকে কেউ বাংলাদেশে আসলেও একইভাবে উল্লিখিত কাজ সম্পন্ন করে। তবে ব্যবসার ক্ষেত্রে ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রচলিত প্রথায় যাবতীয় কাজ সম্পন্ন হয়।

অন্যদিকে দেশের তৈরি পোশাক যখন আমরা ইউরোপে রপ্তানি করি তখন আমরা অর্জন করি ইউরো। কিন্তু ইউরো দিয়ে দেশের বাজারে কেনাকাটা করা বা মিল-কারখানার শ্রমিকের বেতন পরিশোধ করা সম্ভব না। আবার একজন ইউরোপীয় ক্রেতার পক্ষেও বাংলাদেশি টাকা অর্জন করা সবসময় সম্ভব না। এর ফলে আন্তর্জাতিক লেনদেনে মুদ্রার ভিন্নতা একটি বড় সমস্যা হয়ে যায়।

এই সমস্যা দূর করতে আগেকার দিনে আন্তর্জাতিক লেনদেনে ব্যবহার করা হতো সোনা (অথবা রুপা)। বিভিন্ন দেশের মুদ্রা ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায়, সোনা ছিল আন্তর্জাতিক লেনদেনের সাধারণ মুদ্রা। কোনো দেশ পণ্য রপ্তানি করলে সেই দেশের কোষাগারে স্বর্ণের পরিমাণ বেড়ে যেত।

আবার আমদানি করার সময় কোষাগার থেকে স্বর্ণের পরিমাণ কমে যেত। অর্থাৎ,স্বর্ণই ছিল বিশ্বব্যাপী বা আন্তর্জাতিকভাবে একক মুদ্রা।আর বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন মুদ্রার মান স্বর্ণের বিপরীতে নির্ধারিত হতো। এভাবেই চলছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত।

কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে বাণিজ্যের জন্যে একটি সাধারণ মুদ্রা প্রয়োজন, যা হবে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য। বর্তমানে সেই গ্রহণযোগ্য সাধারণ মুদ্রার রাজ-আসন ব্রেটন উডসের কল্যাণে ঐতিহাসিকভাবেই দখল করে আছে মার্কিন ডলার।

মার্কিন ডলার যেভাবে বিশ্বব্যাপী ‘অপরিহার্য’ হয়ে উঠল :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপীয় দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ঋণী হয়ে প্রচুর স্বর্ণ হারিয়ে ফেলে। ফলে তাদের পক্ষে নিজ নিজ মুদ্রার বিপরীতে সোনা মজুত করে রাখা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস চুক্তির মধ্য-দিয়ে নতুন নিয়ম জারি করা হলো। একমাত্র মার্কিন ডলারের বিপরীতে সোনা মজুত থাকবে। বাকি সকল মুদ্রা ডলারের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখবে।

এরপর থেকে দুইটি ভিন্ন দেশ বাণিজ্য করত ডলারে। কারণ, তাদের হাতে প্রয়োজনীয় স্বর্ণ নেই এবং যেহেতু ডলারের বিপরীতেই স্বর্ণ মজুত আছে; চাইলেই ডলার ভেঙে তার বিপরীতে স্বর্ণ পাওয়া সম্ভব। এক কথায় ব্রেটন উডস চুক্তির পরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলার হয়ে উঠল নতুন স্বর্ণ।

তবে পরবর্তীতে আমেরিকা তার প্রতিশ্রুতি রাখেনি,তারা চুক্তিতে উল্লিখিত পরিমাণের অতিরিক্ত ডলার তারা ছাপাতে থাকে। এই ব্যাপারে অভিযোগ উঠলে ১৯৭১ সালে সবাইকে অবাক করে দিয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন, ডলারের বিপরীতে সোনার মজুত ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করে। এভাবে বিশ্বব্যাপী গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড অধ্যায় শেষ হয়। আর এই হলো বিশ্বব্যাপী মার্কিন ডলারের একক ও অভিন্ন মুদ্রা হয়ে ওঠার গল্প।

রিজার্ভ মুদ্রা বা বৈশ্বিক মুদ্রা :

এটি হচ্ছে এমন একটি মুদ্রা যেটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত এবং যে মুদ্রাকে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো সঞ্চয় করে রাখে। এর ফলে মার্কিন ডলার পরিণত হয় বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রায়।

এম ইউ

Back to top button