ঢাকা, ৩০ আগস্ট – ক্যাডার-নন ক্যাডার কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্বে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। আটকে আছে নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়নও।
ওয়াসার বাইরে সারা দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কাজ। এর জন্য বিসিএস জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ক্যাডার গঠন করা হয়।
কিন্তু প্রতিষ্ঠানটিতে ক্যাডার কর্মকর্তা আছেন ২৫ জন। আর নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ৯০ জন। তাঁরা গত ১৫ জুন ক্যাডারভুক্ত হয়েছেন। কিন্তু ক্যাডারভুক্তির প্রজ্ঞাপনে তাঁদের প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে আসার দিন থেকে (২০০৪-২০০৬) জ্যেষ্ঠতা দেওয়ায় ক্যাডার কর্মকর্তারা তাঁদের জুনিয়র (কনিষ্ঠ) হয়ে গেছেন। এতে দায়িত্ব ও পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছেন ক্যাডার কর্মকর্তারা।
নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন জটিলতার কারণে সহকারী প্রকৌশলীর শতাধিক পদ শূন্য থাকার পরও ৩২তম বিসিএসের পর কোনো নিয়োগ হয়নি। গত আটটি বিসিএসের নিয়োগের জন্য কোনো চাহিদাও দেওয়া হয়নি। অবশেষে ৪১তম বিসিএসে ৩৬ জন নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এ অবস্থায় ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বিসিএস পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের ক্যাডারভুক্তির প্রজ্ঞাপন সংশোধনের দাবি জানিয়ে গত জুনে প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি পাঠায়। এ পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকার বিভাগ নতুন ক্যাডারভুক্তদের পদোন্নতি দেওয়ার জন্য ১৭ আগস্ট একটি সভা করেছে। আজ মঙ্গলবার আবার সভা ডাকা হয়েছে। ফলে ক্যাডার, নন-ক্যাডারদের দ্বন্দ্ব আরো জোরালো হয়েছে।
অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এখানকার নির্বাহী প্রকৌশলীর ৭৬টি পদের সব কটি এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর ১৪টি পদের মধ্যে ১০টি শূন্য আছে। এসব পদে চলতি দায়িত্ব পালন করছেন দুই গ্রুপের সহকারী প্রকৌশলীরা। এতে সহকারী প্রকৌশলীর শতাধিক পদ শূন্য হয়ে আছে। আবার সহকারী প্রকৌশলীরা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলী পদে চলতি দায়িত্ব পালন করায় মন্ত্রণালয় ও বিভাগে যথাযথ মূল্যায়ন পাচ্ছেন না। আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজও করতে পারছেন না।
টেকসই উন্নয়নের (এসডিজি-৬) অন্যতম লক্ষ্যমাত্রা নিরাপদ পানীয় জল ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের লেজে-গোবরে অবস্থার কারণে তা অর্জনে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে।
বিসিএস পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল (বিসিএস) ক্যাডারের ২৫ জন কর্মকর্তা পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ করেছেন। এর পরও প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে আসা ও নন-ক্যাডার ৯০ কর্মকর্তার চাপে তাঁদের পদোন্নতি হয়নি দীর্ঘদিন ধরে। ক্যাডার কর্মকর্তারা সংখ্যায় কম হওয়ায় স্বাধীনভাবে কাজও করতে পারছেন না। নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রভাবের কারণে বিসিএস ক্যাডার নিয়োগ কার্যক্রমও আটকে আছে। এতে স্থবির হয়ে পড়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।
অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলেন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর একটি ক্যাডার বিভাগ। কিন্তু ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদগুলো দখলে রেখেছেন নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা। ২৮, ৩০, ৩১ ও ৩২তম বিসিএসের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ক্যাডারের ২৫ জন কর্মকর্তা যোগদান করেন; কিন্তু ১০ বছর আগে চাকরিতে যোগদান করলেও তাঁদের কোনো পদোন্নতি হয়নি। শুরু থেকে সহকারী প্রকৌশলী পদেই কাজ করছেন তাঁরা। সিনিয়র স্কেল পরীক্ষায় পাঁচ বছর আগে পাস করার পরও বেশির ভাগ কর্মকর্তার সিনিয়র স্কেলের বেতনও হয়নি। পদোন্নতির জন্য জ্যেষ্ঠতার তালিকাও করা হয়নি। অথচ তাঁরা প্রত্যেকে সিনিয়র স্কেল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী, উত্তীর্ণ কর্মকর্তারা নবম থেকে ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি পাওয়ার কথা; কিন্তু পাঁচ বছরেও তাঁরা পদোন্নতি পাননি।
ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি হয়নি, কিন্তু পঞ্চম গ্রেডের যোগ্যতা অর্জন
ক্যাডার কর্মকর্তাদের ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি আটকে আছে। এরই মধ্যে তাঁরা পঞ্চম গ্রেডের নির্বাহী প্রকৌশলী পদে পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করে বসে আছেন; কিন্তু নির্বাহী প্রকৌশলী পদেও তাঁদের পদোন্নতি হচ্ছে না। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইফুর রহমান গত বছর তাঁদের পদোন্নতির সুপারিশ করেন। এ ছাড়া ক্যাডার কর্মকর্তাদের ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি দিতে সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী পদ সৃষ্টির জন্য একাধিকবার মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়। ওই পদ এখনো সৃষ্টি হয়নি।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে ক্যাডার-নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি নিয়ে কিছু জটিলতা আছে। মামলাও চলছে। এখন উভয় পক্ষের সম্মতিতে সমাধান করা হচ্ছে। তবে একদিনে সব সমস্যা সমাধান হবে না। তিনি বলেন, ‘উভয় পক্ষ যেন ন্যায্যতার ভিত্তিতে কাজ করতে পারে এ জন্য চেষ্টা করছি। ’
নন-ক্যাডারদের পদোন্নতির তোড়জোড়
নন-ক্যাডার থেকে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে এখন চাকরিতে আছেন ৮৪ জন। তাঁদের সহকারী প্রকৌশলী পদ থেকে সরাসরি নির্বাহী প্রকৌশলী (গ্রেড-৫) পদে পদোন্নতি দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। গত ১৭ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগের সম্মেলনকক্ষে একটি সভা হয়েছে। জ্যেষ্ঠতার তালিকা না থাকায় ওই বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আগামীকাল মঙ্গলবার আবার সভা ডাকা হয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করবেন স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী।
নন-ক্যাডার থেকে আসা কর্মকর্তারা ক্যাডার কর্মকর্তাদের মতো বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে আসেননি। তাঁদের ছয় মাসের বনিয়াদি প্রশিক্ষণ নেই। কোনো বিভাগীয় ও সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা দেননি। ক্যাডারে তাঁদের চাকরি স্থায়ী হয়নি। পদোন্নতির জন্য জ্যেষ্ঠতার তালিকাও নেই। এ অবস্থায় তাঁদের পদোন্নতির তোড়জোড় নিয়ে অসন্তুষ্ট ক্যাডার কর্মকর্তারা।
আদালতে মামলা
নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের ক্যাডারভুক্তির প্রজ্ঞাপনকে চ্যালেঞ্জ শেরপুর জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) মুহাম্মদ ছামিউল হক হাইকোর্টে মামলা করেছেন। গত ৬ জুলাই ক্যাডারভুক্তির প্রজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, সম্প্রতি প্রকল্প ও নন-ক্যাডার থেকে আসা কর্মকর্তাদের পদোন্নতির বিষয়ে বৈঠক হয়েছে। এ জন্য একটি কমিটিকে কর্মকর্তাদের গ্রেডেশন তালিকা করতে বলা হয়েছিল। তারা প্রতিবেদন দেয়নি। তাই গ্রেডেশন তালিকা ঠিক করতে আবার কমিটি করা হয়েছে। এ কমিটি তালিকা দেওয়ার পর পদোন্নতির ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নতুন ক্যাডারভুক্তরা প্রধান প্রকৌশলীরও সিনিয়র হয়ে গেছেন
প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে আসা নন-ক্যাডার ৯০ কর্মকর্তাকে ক্যাডারভুক্ত সহকারী প্রকৌশলী করা হয় গত ৩০ মে; কিন্তু স্থানীয় সরকার বিভাগ গত ১৫ জুন তাঁদের রাজস্ব খাতে যোগদানের তারিখ থেকে ক্যাডারভুক্ত করে আদেশ জারি করেছে। এতে ৩০ জন কর্মকর্তার বিসিএস জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ক্যাডারভুক্তির তারিখ ধরা হয়েছে ২০০৪ ও ২০০৬ সাল।
২০০৭ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের বর্তমান প্রধান প্রকৌশলীসহ ১২ জন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা (বিসিএস ক্যাডার) অধিদপ্তরে যোগ দেন। তাঁদের মধ্যে দুজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও চারজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে কর্মরত আছেন।
কিন্তু স্থানীয় সরকার বিভাগের ১৫ জুনের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান প্রকৌশলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীরা এখন নন-ক্যাডার থেকে আসা সহকারী প্রকৌশলীদের জুনিয়র হয়ে গেছেন। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী গ্রেড-১ পদের কর্মকর্তা। নন-ক্যাডার থেকে আসা সহকারী প্রকৌশলীরা নবম গ্রেডের কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমান বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারব না। এটা মন্ত্রণালয়ের বিষয়। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাই ভালো বলতে পারবেন। ’
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ঢাকা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মুহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া বলেন, নতুন ক্যাডার কর্মকর্তাদের ক্যাডারভুক্তির তারিখ ২০০৪ ও ২০০৬ সালে ধরায় আইনগত জটিলতা তৈরি হয়েছে। এ কারণে জ্যেষ্ঠতার তালিকাও করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ক্যাডার পদের কর্মকর্তারা পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ করেছেন। এর পরও তাঁদের পদোন্নতি হয়নি। সার্বিক জটিলতার কারণে অধিদপ্তরে নতুন নিয়োগও হচ্ছে না।
পদের আশায় বেড়েছে জটিলতা
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর পদ একটি, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর পদ তিনটি, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর পদ ১৪টি, নির্বাহী প্রকৌশলীর পদ ৭৬টি। অধিদপ্তরে এখন ৪২টি প্রকল্প চলমান আছে।
সদ্য ক্যাডারভুক্ত হওয়া জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম সার্কেলের চলতি দায়িত্বে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জহীর উদ্দিন দেওয়ান বলেন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর একটি ক্যাডার বিভাগ; কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে অনেক কর্মকর্তা ক্যাডারভুক্ত না হওয়ায় পদোন্নতি হয়নি। ফলে সহকারী প্রকৌশলীর পদে থেকে এখন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এতে অন্য বিভাগের কাছে মূল্যায়নও পাওয়া যায় না। কাজ করতে গেলে আত্মবিশ্বাস থাকে না। তিনি বলেন, দেশে অন্য কোনো বিভাগে এমন জটিলতা আছে কি না সন্দেহ।
সূত্র: কালের কন্ঠ
আইএ/ ৩০ আগস্ট ২০২২