জাতীয়

মানবেতর জীবনযাপন নৌযান শ্রমিকদের

বরিশাল, ২৭ আগস্ট – ‘দুঃখ-কষ্টের কতা কারে কমু? আমাগো যা ব্যাতন, হেইয়া দিয়া খামু না পরমু? চাউল কেনলে তরহারি অয় না, তরহারি কেনলে চাউল অয় না। মোগো তো খাইয়া লইয়া বাঁচতে অইবে। জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, লঞ্চের ভাড়া বাড়ে, বেতন আর বাড়ে না।’ চোখের পানি মুছতে মুছতে কথাগুলো বলেন লস্কর আবদুল হামিদ ও আল আমিন। লঞ্চের সিঁড়ি টানাটানি করে যাত্রীদের ওঠানামায় সহযোগিতার দায়িত্ব পালন করেন তাঁরা। তাঁদের মাসিক বেতন পাঁচ হাজার টাকা। দৈনিক যা দেড়শ টাকার কিছু বেশি। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির বাজারে এই টাকায় একজন শ্রমিক পরিবার-পরিজন নিয়ে কীভাবে চলেন, তা জানতে চাইলে দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ছেড়ে দেন তাঁরা।
প্রায় একই অবস্থা নৌপথের অন্যতম এই যানের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও। ঢাকা-বরিশাল রুটের পারাবত-১১ লঞ্চের মাস্টার শেখ কামরুজ্জামান ২০০৬ সাল থেকে এই দায়িত্ব পালন করছেন। এখনও তাঁর বেতন ১৫ হাজার টাকা। স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে সংসার চালানো তাঁর কাছে সাঁতরে সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার মতো। তিনি বলেন, এই টাকায় পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকাই কষ্টকর। এর পর দুই ছেলের লেখাপড়ার খরচ। জীবনের চাকা আর ঘুরছে না। এর পরও নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। মালিকরা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাড়া বাড়িয়েছেন; কিন্তু আমাদের মানবেতর জীবনের কথা ভাবছেন না।
মেঘদূত লঞ্চের মাস্টার আবুল বাশার এবং পারিজাত লঞ্চের মাস্টার শহিদুল ইসলাম নিয়োগপত্র ছাড়াই চাকরি করছেন বছরের পর বছর ধরে। তাঁরা বলেন, বেতন পাই ১৫ হাজার টাকা। এতে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির বাজারে ছয়-সাতজনের সংসার কীভাবে চলে? এভাবে আর পারছি না, বেতন না বাড়ালে বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে।
সরকার এবং নৌযান মালিকরা ২০১৬ সালে সর্বশেষ এ খাতের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পুনর্নির্ধারণ করেছিলেন। এর পর কয়েক দফা বেড়েছে দ্রব্যমূল্য ও ভাড়া। কিন্তু শ্রমিকদের পাতে পড়েনি কিছু। এ অবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে বেতন-ভাতা পুনর্নির্ধারণের দাবি জানিয়ে আসছেন যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌযান শ্রমিকরা। সরকার ও মালিক পক্ষ এতে কর্ণপাত না করায় এখন বড় আন্দোলনের দিকে যাচ্ছেন তাঁরা। আগামী মাসের প্রথম দিকে লাগাতার ধর্মঘট শুরুর আভাস দিয়েছে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন।
আটটি নৌযান সংগঠনের জোট বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাকা-বরিশাল নৌপথের মানামী লঞ্চের ড্রাইভার আবু সাঈদ বলেন, লঞ্চে যাত্রী ভাড়া এবং পণ্যবাহী নৌযানের ভাড়া বাড়লেও আমাদের বেতন বাড়ছে না। এক বছর ধরে এ বিষয়ে সরকার ও মালিক পক্ষের সঙ্গে দেনদরবার করলেও পাত্তা দিচ্ছে না কেউ। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আরেক মাস্টার আবদুর রহমান বলেন, যে বেতন-ভাতা পাই, তাতে খেয়েপরে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। এর পরও দফায় দফায় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। এভাবে আর চলতে পারে না।
বাংলাদেশ নৌযান ফেডারেশনের অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ লঞ্চ লেবার অ্যাসোসিয়েশনের বরিশাল জেলা শাখা গত ২৪ আগস্ট বরিশাল নগরীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। এতে জেলা সভাপতি মাস্টার শেখ আবুল হাসেম বলেন, ২০১৬ সালের পর নৌযান শ্রমিকদের বেতন না বাড়লেও দ্রব্যমূল্য বেড়েছে কয়েক ধাপে। লঞ্চে যাত্রী এবং পণ্যবাহী নৌযানের ভাড়াও বেড়েছে দু’দফায়। এ অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন শ্রমিকরা। সমকালকে তিনি বলেন, চলতি মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন বেতন ২০ হাজার টাকা করাসহ ১০ দাবি না মানলে আগামী মাসের শুরুতে লাগাতার কর্মবিরতিতে যাব।
বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি শাহ আলম ভূঁইয়া বলেন, আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্যের কারণে ছয় বছর আগে নির্ধারিত বেতন-ভাতা দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। চরম অর্থনৈতিক দুরবস্থায় পড়ায় শ্রমিকদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে ক্ষোভ ও হতাশা। চলতি বছরের ১৩ মার্চ নৌযান শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ ১০ দফা শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের বরাবরে পাঠিয়েছি। তবে এর সুফল পাইনি। এ অবস্থায় দাবি আদায়ে আন্দোলনের বিকল্প নেই। বাধ্য হয়ে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা হতে পারে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌযান চলাচল ও যাত্রী পরিবহন সংস্থার সভাপতি মাহাবুব উদ্দিন আহম্মেদ মালিকদের সঙ্গে আলোচনা না করে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে ৪২ শতাংশ; কিন্তু ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ৩০-২২ শতাংশ। এতে মালিকরাও ভালো নেই। তাই বেতন-ভাতা বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।
সুরভী শিপিং লাইন্সের পরিচালক রেজিন উল কবির বলেন, নৌযান শ্রমিকদের দাবি যৌক্তিক। তবে বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনায় এখনই তাদের বেতন বাড়ানো সম্ভব নয়। আমরা শ্রমিকদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দিয়েছি। আশাকরি তারা অযৌক্তিক কোনো দাবি তুলবেন না।

সূত্র: সমকাল
আইএ/ ২৭ আগস্ট ২০২২

Back to top button