ঢাকা

অরক্ষিত পান্থকুঞ্জ পার্ক

ঢাকা, ২৭ আগস্ট – ত্রিভূজাকৃতির পার্কটিতে সকাল-বিকেল হাঁটাচলা বা ব্যায়াম করতেন আশপাশের মহল্লার প্রবীণরা। তপ্ত রোদে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিতেন পথচারীরা। সবুজের ছোঁয়ায় কাটাতেন সময়। কিন্তু এখন আর সেই পরিবেশ নেই পার্কটিতে। পুরো পার্ক জঙ্গলে ছেয়ে গেছে। ভেতরে বড় বড় গর্তে জমেছে পানি। এতে বংশবিস্তার করছে মশা। জঙ্গলে বসছে মাদকাসক্তদের আড্ডা। সন্ধ্যার পর চুরি-ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন পথচারীরা।

এই চিত্র রাজধানীর কারওয়ান বাজার সংলগ্ন পান্থকুঞ্জ পার্কের। স্থানীদের অভিযোগ, আধুনিকায়নের নামে পার্কটির পরিবেশ নষ্ট করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। সাড়ে তিন বছর আগে প্রথমে পার্কের চারপাশ টিন দিয়ে ঘিরে দেয় ডিএসসিসি। কিন্তু প্রকল্পের কাজ বন্ধ হওয়ায় এখন পুরো পার্ক জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। প্রবেশাধিকার হারিয়েছেন শিশু-কিশোর ও বৃদ্ধরা। তাদের হাঁটাচলা ও খেলাধুলার জন্য ওই এলাকায় বিকল্প কোনো জায়গাও নেই।

তবে ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পান্থকুঞ্জ পার্কে অবকাঠামো উন্নয়নে নানা পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু নকশা চূড়ান্তের পর ডিএসসিসি জানতে পারে, পার্কটির একাংশের ওপর দিয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যাবে। এজন্য দু-তিনটি খুঁটি পার্কের সীমানায় বসবে। এমন তথ্য পাওয়ার পর কাজ বন্ধ করে দেয় ডিএসসিসি। এভাবেই সাড়ে তিন বছর চলে যায়। এখন পার্কের ভেতরে জন্মানো আগাছা পরিষ্কারের উদ্যোগ নিয়েছে ডিএসসিসি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৮ সালে পার্কটি ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছিল ডিএসসিসি। পরিকল্পনা ছিল এক বছরের মাথায় অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শেষ হবে। এরপর পার্কটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। এজন্য ‘জলসবুজে ঢাকা’ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১৯ কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। পরে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার পার্কটিতে মাটি খোঁড়াখুঁড়ি ছাড়া তেমন কোনো কাজ করেননি।
কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ ও সোনারগাঁও হোটেল সড়কের সংযোগস্থলে ত্রিভূজ আকৃতির পান্থকুঞ্জ পার্ক। বুধবার (১৭ আগস্ট) সরেজমিনে দেখা যায়, পার্কের চারপাশ থেকে টিনের বেড়া খুলে ফেলা হয়েছে। ভেতরের বড় আগাছাগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে। পার্কের ভেতর খোঁড়া অংশে বৃষ্টির পানি জমে আছে। পোকামাকড়, মশার লার্ভা গিজগিজ করছে। পথচারী এবং ভাসমান মানুষ পার্কের ভেতর মল-মূত্র ত্যাগ করছে। পার্কের ভেতর হাঁটাচলা বা ঘোরাঘুরির কোনো পরিবেশ নেই।

পার্কের উত্তর পাশে খোলা অংশে কয়েকজন কিশোরকে ক্রিকেট খেলতে দেখা গেছে। এছাড়া পার্কের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে স্টিলের কাঠামোয় ময়লা রাখার ঘর (এসটিএস) এবং পাবলিক টয়লেট।
পান্থকুঞ্জ পার্ক সংলগ্ন কাঁঠালবাগান ঢাল। এই এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা হাবিবুল ইসলাম। সোনারগাঁও সড়কে একটি টাইলসের দোকান রয়েছে তার। আলাপকালে হাবিবুল ইসলাম বলেন, পার্কটির অবকাঠামো উন্নয়নের নামে বছরের পর বছর পরিবেশ নষ্ট করে রাখা হয়েছে। মহল্লার কেউ পার্কটি ব্যবহার করতে পারছে না। অথচ আগেই ভালো ছিল। নারী-পুরুষ বা শিশু-বৃদ্ধ সবাই পার্কে যাওয়ার সুযোগ পেতেন। সেই ব্যবস্থাপনা এখন নেই। অবিলম্বে পার্কটি সংস্কার করতে হবে।
বাংলামোটর মোড় থেকেও পার্কটি খুব কাছে। বাংলামোটরের স্থানীয় বাসিন্দা মাজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই এলাকায় বিকল্প আর কোনো পার্ক নেই। ফলে এই পার্কটিতে সকাল-বিকেল মহল্লার অনেকেই বেড়াতে যেতেন। এখন পার্কটির পাশ দিয়ে চলাচলের সময় অস্বস্তি লাগে। সেখানে ছিনতাইকারীদেরও দৌরাত্ম্য বেড়েছে।

এই পার্কের উন্নয়নকাজের পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন স্থপতি রফিক আজম। আলাপকালে তিনি বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য পার্কটি অব্যবহৃত অবস্থায় ফেলে রাখার সুযোগ নেই। পার্কের যে অংশে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের খুঁটি বসবে, সে অংশটুকু বাদ দিয়ে বাকি অংশ ব্যবহার উপযোগী করার চেষ্টা চলছে। এজন্য পার্কের আগের নকশায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।
জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান প্রকৌশলী সালেহ আহম্মেদ বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সরকারের একটা মেগা প্রকল্প। তারা এই পার্কের ওপর দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে যেতে চায় এবং ওঠা-নামার পথ তৈরি করতে চায়। তাদের এই সুযোগ দেওয়া হলে পার্কটির অস্তিত্ব থাকবে না। পার্ক সংলগ্ন নবনির্মিত এসটিএস, পাবলিক টয়লেট ভাঙা পড়বে। তাই তাদের পার্কের ওপর দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ করতে ‘না’ করা হয়েছে। যদিও তারা প্রকল্প বাস্তবায়নে চাপ দিয়ে যাচ্ছেন।

পান্থকুঞ্জ পার্কটি মুক্তাঙ্গনের আদলে সাজাতে ডিএসসিসি পরিকল্পনা নিচ্ছে জানিয়ে সালেহ আহম্মেদ বলেন, এই পার্কে শিশুদের জন্য আলাদা জোন, চারপাশে হাঁটাচলার পথসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা হবে। এজন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে নকশা জমা দিতে বলা হয়েছিল। তারা নকশা জমা দিয়েছে। আশা করি শিগগির আমরা পার্কটির অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ শুরু করতে পারবো।

গত ২০ জুলাই জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘রাজধানীর উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবায়নে করণীয়’ শীর্ষক নগর সংলাপে অংশ নিয়েছিলেন ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস।

ওই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, বিভিন্ন সেবা সংস্থার সমন্বয়হীন কার্যক্রম আমাদের জন্য একেকটা বিষফোড়া। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য পান্থকুঞ্জ পার্ক দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ওদিক থেকে এসে আবার এদিক হয়ে কাঁটাবন দিয়ে বলে যাবে! কেন যাবে? এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে তো ঢাকার মধ্যে নামার কথা নয়। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকার এক অদূর প্রান্ত থেকে আরেক অদূর প্রান্তে সরাসরি চলে যাবে। ঢাকার ওপরে আগ্রাসন আর চলতে দেওয়া হবে না। এখন আমরা পান্থকুঞ্জ পার্কটি ব্যবহার উপযোগী করার চেষ্টা করছি।

সূত্র: জাগোনিউজ
আইএ/ ২৭ আগস্ট ২০২২

Back to top button