ইউরোপ

গোসল বাদ, ‘ইট অর হিট’ পরিস্থিতিতে ইউরোপীয়রা

লন্ডন, ২৬ আগস্ট – কাপড় ইস্ত্রি হবে না, ওভেনের ব্যবহার সীমিত এবং কর্মস্থলে গোসল– এভাবেই ইউরোপীয়রা বিদ্যুতের ব্যবহার কমানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু তবু বিদ্যুতের বিল বেড়েই চলেছে।

তথ্য জানাচ্ছে, গ্যাস ও বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য বৃদ্ধির ফলে ইউরোপের কোটি মানুষ তাদের আয়ের রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুতের পেছনে ব্যয় করছেন।

ইংল্যান্ডের পূর্বাঞ্চলে গ্রিমসি শহরে ফিলিপ কিটলি নিজের বাড়িতে শীতল করার ফ্যান চালু করেন না। যদিও এই গ্রীষ্মের পুরো ব্রিটেনজুড়ে রেকর্ড মাত্রায় তাপদাহ দেখা দিয়েছে।

তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আসলে তিনি এই ব্যয় করতে সমর্থ নন।

কিটলি বলেন, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে এবং এরপরও প্রত্যাশা করা হচ্ছে সংকটের আগে যে অর্থ দেওয়া হতো তা দিয়ে মানুষ বেঁচে থাকবে। আমি উষ্ণতা বজায় রাখা কিংবা খাবার খাওয়া, এই দুটির যে কোনও একটি করতে পারছি।

অপর ইউরোপীয় দেশের নাগরিকরাও স্বেচ্ছায় গ্যাস, বিদ্যুতের ব্যবহার কমানোর চেষ্টা করছেন। কারণ ইউক্রেন যুদ্ধ, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং করোনাভাইরাস মহামারি পরবর্তী সময়ে জ্বালানির মূল্য আকাশছোঁয়া।

গত ১২ মাসে ইউরোপীয় গ্যাসের মূল্য বেড়েছে ৫৫০ শতাংশ। শুক্রবার ব্রিটেনের জ্বালানি নিয়ন্ত্রক ওফজেম বলেছে, অক্টোবর থেকে ব্রিটিশ ভোক্তাদের জ্বালানি ব্যয় বাড়বে ৮০ শতাংশ। এর ফলে দেশটির প্রতিটি বাড়িতে জ্বালানির পেছনে বার্ষিক ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে ৩ হাজার ৫৪৯ পাউন্ড ((৩ লাখ ৯৯ হাজার ২৪৪ টাকা)।

ইউরোপীয় সরকারগুলো জনগণকে সহযোগিতায় দ্রুত এগিয়ে এসেছে। কিন্তু তথ্য দেখিয়ে দিচ্ছে যে, এসব সহযোগিতা বাসা-বাড়িতে খুব পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে না।

সরকারি তথ্য পর্যালোচনা করে কার্বন ব্রিফ বলছে, এই শীতে ব্রিটিশরা গড়ে তাদের আয়ের ১০ শতাংশ ব্যয় করবেন গ্যাস, জ্বালানি ও উষ্ণতার জন্য অন্যান্য জ্বালানির পেছনে। এর মধ্যে থাকবে গাড়ির ফুয়েল, মূলত পেট্রোল ও ডিজেল। যা ২০২১ সালের তুলনায় দ্বিগুণ।

এতে করে চলমান জ্বালানি সংকট ১৯৭০ ও ১৯৮০ দশকের তুলনায় আরও বেশি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। তেল উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা এবং ১৯৭৯ সালে ইরানের বিপ্লবের ফলে পশ্চিমা দেশগুলোর পেট্রোল স্টেশনে লম্বা লাইন তৈরি করেছিল। ওই সময় সংকটের চূড়ায় ১৯৮২ সালে যুক্তরাজ্যের মানুষ তাদের আয়ের ৯.৩ শতাংশ জ্বালানির পেছনে ব্যয় করেছিলেন।

যুক্তরাজ্যের দাতব্য সংস্থা ন্যাশনাল এনার্জি অ্যাকশন (এনইএ) ধারণা করছে, অক্টোবরে যখন ব্রিটেনের জ্বালানির মূল্য বাড়বে তখন ৮৫ লাখ পরিবার জ্বালানি দারিদ্র্যের মুখে পড়বে। ২০২১ সালের অক্টোবরে এই সংখ্যা ছিল ৪৫ লাখ।

যদি আয় কম থাকে এবং জ্বালানির পেছনে আয়ের ১০ শতাংশ বা বেশি করতে হয়, সেই পরিস্থিতিতিকে পারিবারিক জ্বালানি দারিদ্র্য বলা হয়। এই সংজ্ঞা বেসরকারিভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ব্যবহার করা হয়।

এনইএ’র পলিসি ও অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর পিটারি স্মিথ বলেন, আমরা জ্বালানির ব্যয়ের যে বৃদ্ধি দেখছি তা একেবারে নজিরবিহীন। আমরা মনে করি নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর সেই ঐতিহাসিক প্রবণতাগুলো অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে তাদের আয়ের চেয়ে জ্বালানিতে ব্যয়ের বিষয়টি এখন খুব স্পষ্ট।

ইট ও হিট

এপ্রিলে কাউন্সিল উপদেষ্টার চাকরি হারান কিটলি। এরপর থেকে তিনি সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় প্রতিমাসে পাওয়া ৬০০ পাউন্ড (প্রায় ৬৭ হাজার টাকা) দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি বলছেন, এর অর্ধেক চলে যায় ভাড়ায়। বাকিটা দিয়ে জরুরি প্রয়োজন পুরোপুরি মিটে না।

তিনি এখন প্রতিদিন একবেলা খাবার খান এবং বিদ্যুতের ব্যবহার সর্বনিম্ন করার পরও তার আয়ের ১৫ শতাংশের বেশি জ্বালানিতে ব্যয় করতে হচ্ছে।

ফিনান্সিয়াল ফেয়ারনেস ট্রাস্টের পরিচালিত এক গবেষণা অনুসারে, যুক্তরাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ পরিবার কুকারে রান্না বা ওভেনের ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছে। এক-তৃতীয়াংশ পরিবার গোসলের সংখ্যা কমিয়েছে এবং অর্ধেক তাদের বাড়ির তাপমাত্রা কমিয়ে এনেছে।

সংস্থাটিতে যুক্ত ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির সিনিয়র গবেষণা সহযোগী জ্যামি ইভান্স বলেন, ব্যয় কম রাখার জন্য মানুষ অনেক চেষ্টা করছেন। কিন্তু তা বেড়েই চলেছে। তাই আমরা সরকারের পক্ষ থেকে আরও বেশি পদক্ষেপ দেখতে চাই।

ডন হোয়াইট নামের এক রোগীর আশঙ্কা ব্রিটেনে চক্রাকারে বাড়তে থাকা জ্বালানির ব্যয়ের কারণে তিনি আর জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারবেন না। ৫৯ বছর বয়সী এই ব্যক্তি বলেন, সপ্তাহে পাঁচবারে ২০ ঘণ্টা ডায়ালাইসিস মেশিন ছাড়া আমি বেঁচে থাকতে পারব না।

ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ)-এর সরবরাহকৃত মূল্যস্ফীতি সমন্বয় করা সূচক অনুসারে, ২০২২ সালে শুরুতে ইউরোপীয় অর্থনীতির দেশগুলোতে পরিবার প্রতি গ্যাসের পেছনে ব্যয় ১৯৭০, ১৯৮০ ও ২০০০ দশকের সংকটকে ছাড়িয়ে গেছে।

বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় ইউরোপের পরিস্থিতি নাজক।

কর্মস্থলে গোসল

তুর্কিশ স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুসারে, এক বছর আগের তুলনায় তুরস্কে জুলাই মাসে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৬৭ শতাংশ।

ইস্তাম্বুলে বসবাসকারী সৈয়দা বেল জানান, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য এখন তিনি মাসে মাত্র তিনবার ওভেন ব্যবহার করেন। জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য তার স্বামী বাসে যাচ্ছেন অফিস। যদিও এভাবে অফিস যেতে তার তিন ঘণ্টা সময় বেশি লাগে।

আইইএ তথ্য দেখিয়ে দিচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ইতালি ও জার্মানির পরিবারগুলোর গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি।

ইতালির একটি পরিবারের জ্বালানির ব্যয় (মূলত গ্যাস ও বিদ্যুৎ) ২০২২ সালের জুলাই মাসে পারিবারিক খরচের ৫ শতাংশে পৌঁছেছে। ২০১৯ সালে যা ছিল ৩.৫ শতাংশ। ওইসিডি তথ্য অনুসারে, জুলাইয়ের এই হার ১৯৯৫ সালের পর সর্বোচ্চ।

ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতি জার্মানিতে ২০২১ সালের তুলনায় পরিবারের গ্যাসের ব্যয় বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।

ফ্রাঙ্কফুর্টের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর নিডাতে বসবাসকারী এরকান এরডেন একটি খনিজ পানির কারখানায় মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। তিনি বলেন, কাজ শেষে কারখানাতেই আমি এখন গোসল করি এবং কর্মস্থলেই চুল-দাড়ি-গোঁফ কাটি।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
এম ইউ/২৬ আগস্ট ২০২২

Back to top button