বগুড়া

পুলিশ কর্মকর্তার ক্ষোভে পুড়ছে গ্রামবাসী

বগুড়া, ২৫ আগস্ট – বগুড়ায় বিরোধপূর্ণ জমির জন্য একটি গ্রামের প্রায় সব মানুষের জীবনকে নরক বানিয়েছেন এক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং তাঁর স্বজনরা। মসজিদ ও মন্দিরের নামে প্রায় সাত দশক আগে লিখে দেওয়া ১১ একর জমি গ্রামবাসীর প্রতিরোধের মুখে দখল করতে ব্যর্থ হয় ওই পুলিশ কর্মকর্তার শ্বশুরপক্ষ। এরপর একে একে আটটি মামলা দিয়ে গ্রামবাসীর অনেকের জীবন তছনছ করে দিয়েছেন তাঁরা। অন্য জেলায় মামলা দিয়েও গ্রামবাসীকে হয়রানি করা হচ্ছে। মামলায় বহু নারী-পুরুষকে আসামি ও গ্রেপ্তার করায় এলাকাটি এখন কার্যত আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা অভিযোগ নাকচ করলেও তাঁর স্বজনরা স্বীকার করেছেন, আদালতের মাধ্যমে জমি দখল করা অনিশ্চিত হতে পারে মনে করে তাঁরা পেশিশক্তির পথ বেছে নিয়েছেন। একাধিকবার এলাকায় গিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া যায়।
বগুড়া সদর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার দোবাড়িয়া গ্রামের এ জমির ইজারার আয় থেকে স্থানীয় দুটি মসজিদ ও একটি মন্দিরের উন্নয়ন ও পরিচালনার ব্যয়ভার বহন করা হয়। গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দারা জানান, এই জায়গা এক সময় জমিদারদের ছিল। ৭০ বছর ধরে কবলা দলিল মূলেই এসব জমি ভোগদখল করে আসছিল মসজিদ ও মন্দির পরিচালনা কমিটি। জমির খাজনা দেওয়ার দায়িত্ব ছিল গ্রামের শিক্ষিত ব্যক্তি ময়েজ উদ্দিনের ওপর।
অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘদিন খাজনা বাকি রেখে ওই জমি নিলামে তুলে ময়েজ উদ্দিন প্রথমে তাঁর স্বজনদের এবং পরে নিজের নামে লিখে নেন। ২০০৫ সালে ময়েজ উদ্দিনের মৃত্যুর পর ওই জমির মালিকানা চলে আসে তাঁর নাতনি সাদিকা নাসিম বানুর নামে। গ্রামবাসী নিলামের বিষয়টি জানার পর জমির মালিকানা নিয়ে একটি মামলা করেন যা এখনও চলছে।
এর মধ্যেই দৃশ্যপটে আসেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে ঢাকায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিটে কর্মরত আখিউল ইসলাম। তিনি সাদিকার ছোট বোন মানতাসা আলমের স্বামী। গ্রামবাসী জানান, আখিউলের স্ত্রী প্রায় আড়াই বছর আগে ৮-১০ জন যুবককে নিয়ে দোবাড়িয়া গ্রামে গিয়ে বিরোধপূর্ণ পুকুরে মাছ ধরতে গেলে গ্রামবাসী বাধা দেন। মানতাসা তাঁর স্বামীর ক্ষমতা দেখিয়ে এক যুবককে মারধর করলে এক পর্যায়ে তিনিও পাল্টা হামলার শিকার হন। স্ত্রী মারধরের শিকার হওয়ায় ক্ষুব্ধ হন আখিউল।
আখিউল তখন দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট-হাকিমপুর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। এ ঘটনায় আখিউলের বড় শ্যালিকা বাদী হয়ে গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। তাতে ৯ জনকে আসামি করা হয়। মামলার কারণে পুলিশি ধরপাকড় চলতে থাকে। এ ঘটনার কয়েক দিন পর দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট থানায় একটি ডাকাতি মামলায় আসামি করা হয়েছে মানতাসার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া দোবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা হান্নু মণ্ডলকে। আবার ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঘোড়াঘাট থানার একটি মাদক মামলায় আসামি করা হয় ওই গ্রামের বাসিন্দা ও বিরোধপূর্ণ জমি-পুকুরের লিজ গ্রহীতা আলীউর রেজাকে।
গত ৩ আগস্ট বগুড়া সদর থানায় সহিংসতা ও বাড়িঘর ভাঙচুরের এবং চাঁদাবাজির দুটি মামলা করা হয়। এর একটি মামলায় আসামি করা হয় গ্রামের ২২ নারী-পুরুষকে এবং অপরটিতে আরও ২৯ জনকে। মামলার পরপর রাতেই পুলিশ গ্রেপ্তার অভিযানে নেমে পড়ে। ওই দিন রাতে ও পরদিন ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে।
গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত আটটি মামলা করা হয়েছে। সবই চাঁদাবাজি, ভাঙচুর, মারধর, মাদক, ডাকাতি এবং নাশকতার মামলা। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার আর সন্ত্রাসীদের ভয়ে গ্রামটি জনশূন্য হয়ে পড়েছে। গ্রামের ৭০ বছর বয়স্ক ফজলুর রহমান বলেন, পুলিশ কর্মকর্তা আখিউল ও তাঁর শ্বশুরপক্ষ মিথ্যা মামলা দিয়ে নির্যাতন ও জুলুম করছেন। গ্রামবাসীর অভিযোগ, বগুড়া সদর থানার ওসি সেলিম রেজা আখিউলের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহায়তা করছেন।
অভিযুক্তদের ভাষ্য :জমির দলিল সূত্রে মালিক দাবিদার সাদিকা বানু বলেন, এই জমি ও পুকুর তাঁর নানা ওয়ারিশ মূলে তাঁর নামে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন। কিন্তু মসজিদ ও মন্দিরের দোহাই দিয়ে কিছু ব্যক্তি ওই জমি ও পুকুর অবৈধভাবে দখল করে খাচ্ছেন। তবে আখিউলের ভায়রা ইশতিয়াক হায়দার বলেন, আদালতের রায়ে জমি দখল পেতে দীর্ঘদিন লাগবে। তাই ফৌজদারি মামলা দিয়ে প্রতিপক্ষকে বশে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
গ্রামের মসজিদ কমিটির সভাপতি আলী হাসান সাবলু বলেন, ওই জমির মালিক মসজিদ কমিটি। এর দলিলপত্র আছে। এই জমির আয় থেকে মসজিদ ও মন্দিরের খরচ বহন করা হচ্ছে ৭০ বছর ধরে।
অভিযোগ অস্বীকার করে আখিউল বলেন, জমি উদ্ধারের ঘটনায় তাঁর সম্পৃক্ততা নেই। তিনি হয়রানিমূলক মামলার বিষয়ে কিছু জানেন না। তাঁর স্ত্রীকে কেউ লাঞ্ছিত করেছে কিনা তাও তিনি জানেন না। বগুড়া সদর থানার ওসি সেলিম রেজা দাবি করেন, কারও প্ররোচনায় হয়রানির জন্য কারও বিরুদ্ধে মামলা হয়নি।

সূত্র: সমকাল
আইএ/ ২৫ আগস্ট ২০২২

Back to top button