জাতীয়

শাহজালাল বিমানবন্দরে যাত্রী দুর্ভোগ চরমে

মুসা আহমেদ

ঢাকা, ২৩ আগস্ট – ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাগেজ হ্যান্ডলিংয়ে অব্যস্থাপনা দিন দিন বাড়ছে। লাগেজ পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এতে দুর্ভোগে পড়ছেন যাত্রীরা। কিন্তু এ সমস্যা সমাধানে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।

এদিকে বিমানবন্দর থেকে লাগেজ নিয়ে বের হওয়ার সময় আরেক দফা হয়রানির শিক্ষার হচ্ছেন যাত্রীরা। তাদের অভিযোগ, টার্মিনাল-১ ও ২ এর ‘ক্যানোপিই’ গ্রিল দিয়ে আটকানো। ফলে ট্রলিতে মালামাল নিয়ে টার্মিনালের বাইরে যেতে পারছেন না যাত্রীরা। তাই বাধ্য হয়ে মাথায় লাগেজ নিয়ে বের হচ্ছেন তারা। এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়ছেন বয়স্ক, নারী-শিশু এবং অসুস্থ যাত্রীরা।

একসঙ্গে চার-পাঁচটি ফ্লাইট অবতরণ করলে লাগেজ হ্যান্ডলিংয়ে অসুবিধা হয়। সময় বেশি লাগে। তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে এ সমস্যা আর থাকবে না।

যাত্রীদের অভিযোগ, বিশ্বের সব বিমানবন্দরেই ট্রলি নিয়ে বিমানবন্দর এরিয়ার যে কোনো প্রান্তে মালামাল বহন করতে পারেন যাত্রীরা। কিন্তু হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সেই সুযোগ নেই। নিজের মালামাল নিজেকেই মাথায় নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে। সম্প্রতি হজযাত্রীদের এই ভোগান্তিতে বেশি পড়তে হয়েছে।

তবে বিমানবন্দর থেকে ট্রলি নিয়ে বের হওয়ার সুযোগ বন্ধের বিষয়ে ঠুনকো যুক্তি দেয় কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি, কিছু যাত্রী ট্রলি নিয়ে বিমানবন্দরের বাইরে চলে যান। এতে বিমানবন্দরের ভেতর ট্রলি সংকট দেখা দেয়। তাই টার্মিনালের বাইরে ট্রলি নিয়ে বের হওয়ার সুযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। লাগেজ সরবরাহ ব্যবস্থাপনা আরও জোরদার করতে তৎপরতা চালানো হচ্ছে।

jagonews24

বিমানবন্দরে যখন একসঙ্গে একাধিক ফ্লাইট আসে, তখন দায়িত্বে থাকা কর্মীদের হিমশিম খেতে হয়। লাগেজ ডেলিভারি দিতে বেশি সময় লাগে। এতে যাত্রী এবং বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো ক্ষুব্ধ হয়।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের সব কটি বিমানবন্দরে এককভাবে হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এর মধ্যে প্রতিদিন প্রায় ২৭টি এয়ারলাইন্সের ১৪০ থেকে ১৫০টি ফ্লাইট ওঠানামা করে। এসব ফ্লাইটে দিনে প্রায় ২২ হাজার যাত্রী যাতায়াত করেন। ২৪ ঘণ্টায় শিফট ভিত্তিতে বিমানবন্দরে বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কর্মীরা কাজ করেন। কিন্তু গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কর্মীদের শিফট পরিবর্তনের সময় সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়। শিফটের সময় শেষ হলে লাগেজ ফেলে চলে যান কর্মীরা। নতুন শিফটের কর্মীরা না আসা পর্যন্ত কার্যক্রম বন্ধ থাকে। এছাড়া পর্যাপ্ত ট্রলি না থাকায় প্রায়ই ভোগান্তিতে পড়ছেন যাত্রীরা।

২৬ জুলাই বেলা ১১টা। তুর্কি এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ইতালির রোম থেকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার বাসিন্দা আজমল হোসেন। ইমিগ্রেশন শেষ করে যান লাগেজ আনতে। বেল্টে গিয়ে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর তিনি লাগেজ পান। পরে ট্রলিতে মালামাল নিয়ে যান টার্মিনাল-২ এর ফটকে। কিন্তু ফটক ক্যানোপিই গ্রিল দিয়ে আটকানো। তাই মালামাল কাঁধে নিয়েই বিমানবন্দর থেকে বের হন তিনি।

jagonews24

আলাপকালে আজমল হোসেন জানান, বাড়ি যাওয়ার জন্য যে গাড়িটি তিনি ভাড়া করেছেন, সেটি বিমানবন্দরের পার্কিংয়ে ছিল। কিন্তু পার্কিং পর্যন্ত ট্রলি নিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় রাখেনি কর্তৃপক্ষ। মালামাল নিজেই কাঁধে নিয়ে বিমানবন্দর থেকে বের হতে হচ্ছে। এটা যাত্রী বা প্রবাসীদের হয়রানি ছাড়া কিছুই নয়।

একইদিন সকাল ৯টায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে ঢাকা আসেন চট্টগ্রামের নাজমুল আলম। কিন্তু তার লাগেজ পেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টার বেশি। এতে করে তিনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার ফ্লাইট মিস করেন। পরে ঢাকা থেকে বাসে চট্টগ্রাম যান তিনি।

বাড়ি যাওয়ার জন্য যে গাড়িটি তিনি ভাড়া করেছেন, সেটি বিমানবন্দরের পার্কিংয়ে ছিল। কিন্তু পার্কিং পর্যন্ত ট্রলি নিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় রাখেনি কর্তৃপক্ষ। মালামাল নিজেই কাঁধে নিয়ে বিমানবন্দর থেকে বের হতে হচ্ছে। এটা যাত্রী বা প্রবাসীদের হয়রানি ছাড়া কিছুই নয়।

নাজমুল আলম জানান, এদিন ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটের টিকিট কেটে রেখেছিলেন। লাগেজ পেতে দেরি হওয়ায় ফ্লাইট মিস করেছি। এতে টাকা গচ্চা যাওয়ার পাশাপাশি ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।

jagonews24

গত ১৮ জুন দুপুর ১২টায় তার্কি এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ইস্তাম্বুল থেকে ঢাকা আসেন বাবুল চৌধুরী। কিন্তু লাগেজ পান বিকেল ৩টায়। লাগেজের জন্য দীর্ঘ তিন ঘণ্টা তাকে বিমানবন্দরে অপেক্ষা করতে হয়েছে। তার মতো এই ফ্লাইটের আরও তিন শতাধিক যাত্রীকে এমন ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। এ নিয়ে লাগেজ হ্যান্ডলিংয়ের সঙ্গে জড়িত কর্মচারীদের সঙ্গে যাত্রীদের বাগবিতণ্ডা হয়েছে।

ওইদিন সরেজমিনে দেখা গেছে, লাগেজ পেতে দেরি হওয়ার কারণ জানাতে ‘হ্যান্ড মাইকিং’ করছিলেন গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে থাকা এক কর্মী। তখন তাদের ওপর চড়াও হন যাত্রীরা। এমন পরিস্থিতিতে বিমানবন্দরের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা ছুটে আসেন। তারা জানান, তার্কি এয়ারলাইন্সের যে বক্সে লাগেজ রাখা হয়েছিল, সেটি খুলছে না। তাই লাগেজ পেতে দেরি হচ্ছে।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাগেজ পেতে সব সময়ই এমন হয়রানির শিকার হতে হয় বলে জানিয়েছেন তুর্কির প্রবাসী আমিন উদ্দিন। তিনি বলেন, বিমানবন্দরের অদক্ষতার কারণে প্রায়ই যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা খুবই খারাপ।

গত ৮ জুন সকাল ৮টার ফ্লাইটে ঢাকা আসেন প্রবাসী কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, সৌদির জেদ্দা বিমানবন্দর থেকে ঢাকা আসতে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগছে। শাহজালালে লাগেজ পেতে সময় লাগছে দুই ঘণ্টা। অথচ বাইরে আমার পরিবারের লোকজন ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছে। তাদের বসার জায়গা নেই, একটু পানি খাওয়ার ব্যবস্থাও নেই। একটা বিমানবন্দরে বছরের পর বছর এমন অব্যবস্থাপনা চলতে পারে না।

গত ১ আগস্ট থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, সৌদি এয়ারলাইন্স ও ফ্লাইনাস এয়ারলাইন্সে দেশে ফিরতে শুরু করেন হাজিরা। তারা যথাসময়ে লাগেজ পেলেও ট্রলি নিয়ে ক্যানোপিই গ্রিল দিয়ে মালামাল নিয়ে বের হতে পারেননি। বিশেষ করে যারা বাসে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাবেন, তাদের মাথায় করেই মালামাল নিয়ে বিমানবন্দর থেকে বের হতে হয়েছে।

গত ৪ আগস্ট ইকবাল মাহমুদ নামে এক হজযাত্রী বলেন, হজ ফ্লাইট নামার পরপরই টার্মিনাল-১ ও ২ এ গাড়ির চাপ বেড়ে যায়। ৪৫ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেও তার গাড়িটি টার্মিনালে ঢুকতে পারেনি। আবার টার্মিনালের ক্যানোপিই গ্রিল দিয়ে আটকে থাকায় ট্রলি নিয়েও বের হওয়া সম্ভব নয়। তাই মালামাল মাথায় নিয়েই তাকে বের হতে হয়েছে।

গত ১৬ জুন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মাসিক সমন্বয় সভায় লাগেজ ডেলিভারির অনিয়ম নিয়ে আলোচনা হয়। মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী হ্যান্ডলিং কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজনে জনবল ও ইকুইপমেন্ট বাড়াতে নির্দেশনা দেন। লাগেজ হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে সর্বশেষ সময়সীমা ৬০ মিনিটের নিচে রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

গত ৩ জুলাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সরকারি সফর শেষে পর্তুগাল থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে বিমানবন্দরের লাগেজ বেল্ট এলাকায় অপেক্ষমাণ যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের অভিযোগ শোনেন। যাত্রীদের দেরিতে লাগেজ পাওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের কথা বলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীকে ফোন করে বিষয়টি অবহিত করেছিলেন। কিন্তু তারপরও এই কাজে তেমন কোনো উন্নতি হয়নি বলে জানিয়েছেন যাত্রীরা।

জানতে চাইলে বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) তাহেরা খন্দকার বলেন, বিমান শৃঙ্খলার সঙ্গে বিমানববন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করে। তবে লাগেজ নিয়ে যাত্রীদের অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি আমলে নিয়ে এই কাজ আরও দ্রুত করার জন্য বিমানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হবে।

তিনি বলেন, একসঙ্গে চার-পাঁচটি ফ্লাইট অবতরণ করলে লাগেজ হ্যান্ডলিংয়ে অসুবিধা হয়। সময় বেশি লাগে। তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে এই সমস্যা আর থাকবে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের এক কর্মকর্তা বলেন, বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো হ্যান্ডলিংয়ের জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে চার্জ দেয়। এটি বিমানের আয়ের অন্যতম বড় খাত। কিন্তু এই খাতে পর্যাপ্ত জনবল ও সরঞ্জাম নেই। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য তদারকি টিম নেই।

তিনি বলেন, বিমানবন্দরে যখন একসঙ্গে একাধিক ফ্লাইট আসে, তখন দায়িত্বে থাকা কর্মীদের হিমশিম খেতে হয়। লাগেজ ডেলিভারি দিতে বেশি সময় লাগে। এতে যাত্রী এবং বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো ক্ষুব্ধ হয়। কারণ, লাগেজ বিড়ম্বনায় এয়ারলাইন্সগুলোকে ইমেজ সংকটে পড়তে হচ্ছে।

সূত্র: জাগো নিউজ
এম ইউ/২৩ আগস্ট ২০২২

Back to top button