জাতীয়

ড. মোমেন এখন টক অব দ্য কান্ট্রি

ঢাকা, ২০ আগস্ট – সপ্তাহ না ঘুরতেই ফের টক অব দ্য কান্ট্রি হলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। ‘শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ভারতের কাছে সুপারিশ করেছেন’-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম শহরের জেএম সেন হলে জন্মাষ্টমী উৎসবের অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, দুই দেশেরই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। এটি সম্ভব- যদি শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থন দেয় ভারত। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্য বৃহস্পতিবার রাতেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। মন্ত্রীর এ বক্তব্য দেশ ও জাতির জন্য লজ্জাজনক বলে আখ্যা দেন সাধারণ ফেসবুকাররা। যদিও বরাবরের মতোই সাংবাদিকদের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে ড. মোমেন বলেছেন, দেশকে অস্থিতিশীল করতে কিছু সাংবাদিক এটা প্রচার করেছেন। এরপর গতকাল শুক্রবার ওই বক্তব্যের ব্যাখ্যা প্রদানের পাশাপাশি সাংবাদিকদেরও দোষারোপ করেছেন মন্ত্রী।

শুক্রবার দুপুরে বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের পক্ষে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমি ভারতকে বলেছি- কিছু কিছু লোক সময় সময় অনেক উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলে। আপনার দেশেও কিছু দুষ্টু লোক আছে, আমার দেশেও দুষ্টু লোক আছে। তারা তিলকে তাল করে।
আপনার সরকারের একটা দায়িত্ব হবে এবং আমার সরকারেরও দায়িত্ব আছে যে তিলকে তাল করার সুযোগ সৃষ্টি করতে না দেওয়া। আমরা যদি এটা করি তাহলে সমপ্রীতি থাকবে। আমাদের মধ্যে কোনো ধরনের অস্থিরতা থাকবে না। আমি বলেছি, আমরা চাই শেখ হাসিনার স্থিতিশীলতা থাকুক। আমরা কোনো ধরনের উচ্ছৃঙ্খল পরিবেশ চাই না। এই ব্যাপারে আপনারা সাহায্য করলে আমরা খুব খুশি হবো। কিছু সাংবাদিক দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায় বলেই এসব সংবাদ প্রচার করছে।
ড. মোমেন বলেন, আমরা খুব ভাগ্যবান। গতকাল আমি যে বিষয়টা বলেছি, শেখ হাসিনা- উনি আছেন বলেই আমাদের দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। উনি আছেন বলেই বাংলাদেশে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি আছে। আমি বলেছি, বঙ্গবন্ধু একটি দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন- অসামপ্রদায়িক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুললে সবার মঙ্গল হয়। আর এদেশে যত নাগরিক আছে, সে যেকোনো ধর্মের হোক, তার সমান অধিকার, সে বাঙালি, আমাদের বাংলাদেশের নাগরিক।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমি বলেছি, শেখ হাসিনা যদি সরকারে থাকেন, তাহলে স্থিতিশীলতা থাকে। আর স্থিতিশীলতা থাকলেই আমাদের উন্নয়নের যে মশাল…। উন্নয়ন শুধু ভারতে গিয়ে আমি যেটা বলেছি, আসামের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, শেখ হাসিনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন? উনি বললেন, শেখ হাসিনার সেই জিরো টলারেন্স টু টেরোরিজম- এটা ঘোষণার পরে, আর দ্বিতীয়ত, উনি বলেছেন, বাংলাদেশ ক্যাননট বি এ হাব ফর টেরোরিস্ট (বাংলাদেশ সন্ত্রাসীদের আস্তানা হতে পারে না)। এর পরে আসাম, মেঘালয়- সবগুলো জেলায় আর সন্ত্রাসী তৎপরতা নাই। সন্ত্রাসী তৎপরতা না থাকায় তাদের দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। উনি বললেন, আমার এখানে বহু হাসপাতাল, বহু ইনভেস্টমেন্ট আসছে। যেহেতু আমাদের এই আসামে কোনো সন্ত্রাসী নেই। ড. মোমেন আরও বলেন, আমি ভারত সরকারকে বললাম, আপনার মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, শেখ হাসিনা থাকায় স্থিতিশীলতা এসেছে। স্থিতিশীলতা হওয়ায় আমাদের দেশেরও মঙ্গল হচ্ছে, আপনার দেশেরও মঙ্গল হচ্ছে। আমরা আপনার দেশে আসছি, ব্যবসা-বাণিজ্যও ভালো হচ্ছে। সুতরাং স্থিতিশীলতা সবচেয়ে ইম্পর্টেন্ট। রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা খুব দরকার। তাতে আপনার দেশেরও মঙ্গল হবে, আমার দেশেরও মঙ্গল। আমরা চাই, অত্র এলাকায় স্থিতিশীলতা। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা চাই না এবং সেটা যদি আমরা করতে পারি এই সোনালী অধ্যায় যথার্থ হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্য তার ‘ব্যক্তিগত’ দাবি করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে থাকা ও আসার জন্য ভারতকে কখনো অনুরোধ করেনি, শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে কাউকে দায়িত্ব দেয়া হয়নি। এটি কারো ব্যক্তিগত অভিমত হতে পারে।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৃহস্পতিবারের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অনলাইন জগতে সমালোচনার ঝড় ওঠে। মানবজমিন অনলাইনে খবর আকারে ওই বক্তব্য প্রকাশিত হলে দেশ ও দেশের বাইরে থাকা পাঠকরা নানা মন্তব্য করেন।

সুমন দত্ত নামে একজন পাঠক লিখেছেন, ‘বিনা ভোটে নির্বাচিত এই সরকার কোন দেশের জোরে ক্ষমতায় টিকে আছে- এটা সবাই জানে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেই ধারাবাহিকতায় এই কথাগুলো বলেছেন। তা না হলে কবে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়ে ক্ষমতায় অন্য কেউ এসে যেত। সমপ্রতি বিএনপি তাদের একাধিক প্রতিনিধিদল ভারতে পাঠিয়ে নিজেদের পক্ষে কাজ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। সেটা দেখেই তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। আর বেসামাল হয়ে এসব আজেবাজে বকছে।’

সোনা মিয়া লিখেছেন, ‘এদেশে কোন দল ক্ষমতায় থাকবে কোন দল থাকবে না সেটা কি ভারত নির্ধারণ করবে নাকি এদেশের জনগণ? লজ্জা একটা স্বাধীন দেশের মন্ত্রী আরেক দেশের কাছে গিয়ে ধরনা দেন তাদের যেন ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়া হয়। তাহলে বোঝা যায় এদের দেশের জনগণের উপর আস্থা নেই।’

আজিজ নামে একজন পাঠক লিখেছেন, জনগণের মন জয় করে, তাদের রায় নিয়ে আওয়ামী লীগ আরও পঞ্চাশ বছর ক্ষমতায় থাকুক, জনতা মেনে নেবে। বিদেশিদের কাছে ধরনা দেয়া, দেশের সম্মানের জন্য কি ইতিবাচক হলো’।

মো. জহিরুল ইসলাম মন্তব্য করেছেন, ‘মন্ত্রী মহোদয় অপ্রিয় কিন্তু সত্য কথাটি বলেছেন। বিগত দিনগুলোতে আমরা আমাদের ন্যায্য হিস্যা আদায় দূরে থাক, ক্ষমতার লোভে চাওয়ার সাহসই করতে পারিনি।’

মাহমুদ লিখেছেন, আওয়ামী লীগের মধ্যে যদি সামান্যতম দেশপ্রেম অবশিষ্ট থাকে, আমি আশা করবো তারা মোমেন সাহেবকে অবিলম্বে বরখাস্ত করবে। তার এই বক্তব্য শুধু রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে শেষ করে দিয়েছে তা নয়, দেশকেও ছোট করেছেন। তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগের প্রধান শত্রু হিসাবে জাতির কাছে উপস্থাপন করছেন। তিনি তো দেশের হয়ে বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন, বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীদের সঙ্গে মিটিং করছেন। একমাত্র আল্লাহ্‌ই জানেন তিনি কোথায় কি বলে আসছেন।

এর আগে বেশকিছু বিতর্কিত মন্তব্য করে সমালোচনার মুখে পড়েন একে আব্দুল মোমেন। গেল সপ্তাহেই সিলেটে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে একটি মন্তব্যের জেরে বেকায়দায় পড়েন মন্ত্রী, দেশের মানুষ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের তুলনায় বেহেশতে আছে- এমন মন্তব্য করে ব্যাপক সমালোচনায় পড়েন তিনি। পরদিন নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যায় সাংবাদিকদের উদ্দেশে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তিনি কথার কথা বলেছেন। সেটা নিয়ে সাংবাদিকেরা তাকে বিপাকে ফেলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি বলেছি, অন্য দেশের তুলনায় আমরা অনেক ভালো আছি। তাদের তুলনায় আমরা বেহেশতে আছি, এই কথা বলেছিলাম। কিন্তু আপনারা এক্কেবারে উল্টা।

পরদিন আরেক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমি তো ট্রু সেন্সে বেহেশ্‌ত বলিনি। কথার কথা। কিন্তু আপনারা সবাই আমারে খায়া ফেললেন।’ এর ঠিক দুইদিন আগে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের জমা করা অর্থের বিষয়ে বাংলাদেশ সুনির্দিষ্ট তথ্য চায়নি বলে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যকে মিথ্যা বলেও দাবি করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, এভাবে মিথ্যা কথা বলে পার পাওয়া উচিত নয়।’ একজন বিদেশি কূটনীতিককে সরাসরি মিথ্যুক বলে ওই সময়ও সমালোচনার শিকার হন মন্ত্রী। বাংলাদেশ নয়, যুক্তরাষ্ট্রের বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে প্রশ্ন করতে গণমাধ্যমকর্মীদের পরামর্শ দিয়ে আলোচনার জন্ম দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বাংলাদেশের নির্বাচন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বললে তার প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের উদ্দেশে বার্তা পাঠান আব্দুল মোমেন। বার্তায় তিনি লিখেন, ‘আপনারা অনুগ্রহ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে প্রশ্ন করবেন, কেন তারা তাদের নিজ দেশে এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে পারেন না?

দ্বিতীয়ত, প্রতিবছর প্রায় এক লাখ মার্কিন নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রে নিখোঁজ হয়। এমনকি শিশুরা তাদের হিস্পানিক মা-বাবার সঙ্গে পুনর্মিলন থেকে বঞ্চিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন করুন, বাংলাদেশ সম্পর্কে নয়।’ এর আগে গত এপ্রিলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিনকেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ব্যক্তিগত বিষয়ের অবতারণা করে সমালোচনার জন্ম দেন ড. মোমেন।

‘রাষ্ট্রহীন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় পেয়েছিলেন’ এমন তথ্য উল্লেখ করে ড. মোমেন বলেন, ওই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র তাকে আশ্রয় দেয়ার পাশাপাশি একটি বাড়ি দিয়েছিল। সঙ্গে চাকরিও। এ কারণে তিনি দেশটির প্রতি কৃতজ্ঞ। সোমবার ওয়াশিংটনে এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তার ওই বক্তব্য প্রচারের পর নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। মন্ত্রী কবে, কেন রাষ্ট্রহীন ছিলেন এই প্রশ্ন তোলেন অনেকে। যদিও এই প্রশ্নের জবাব তিনি দেননি।

সূত্র: মানবজমিন
আইএ/ ২০ আগস্ট ২০২২

Back to top button