জাতীয়

ক্ষমতায় গেলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কী পদক্ষেপ নেবে, জানালো বিএনপি

ঢাকা, ১৩ আগস্ট – বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, আত্মঘাতী চুক্তি ও অপরিণামদর্শী পরিকল্পনাকে দায়ী করেছে বিএনপি। আগামীতে ক্ষমতায় গেলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবারহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কম্পানির চুক্তি বাতিলসহ ১২ দফা পদক্ষেপ তুলে ধরেছে বিএনপি।

আজ শনিবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে চিত্র তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীর এ কথা বলেন।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, সরকারের লাগামহীন দুর্নীতি আর হরিলুটের খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে।

এখন শহরে দুই-তিন ঘণ্টা ও গ্রামাঞ্চলে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা লোড শেডিং জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। একদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন ঊধর্বগতিতে মানুষের জীবন নাভিশ্বাস উঠেছে, বিদ্যুতের লোড শেডিংজনিত জনদুর্ভোগ মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে যুক্ত হয়েছে। মানুষ দিশাহারা হয়ে উঠেছে, তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।
ব্যর্থতার জন্য সরকারের পদত্যাগের কথা পুনর্ব্যক্ত করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা বিদ্যুৎ খাতের এই বিপর্যয়, রিজার্ভের সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক নৈরাজ্য ও দ্রব্যমূল্যের ঊধর্বগতিতে জনগণের নাভিশ্বাসের দায় নিয়ে বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকারকে অনতিবিলম্বে পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছি। তা না হলে দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণই এই সরকারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করবে। ’

ক্ষমতায় গেলে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বাতিল করা হবে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমরা বিদ্যুতের এই সমস্যার সমাধান করব। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবারহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনসহ সকল কালা কানুন বাতিল করব। রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কম্পানির সঙ্গে সব চুক্তি বাতিল করা হবে। স্বচ্ছ প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও অন্যান্য কাজ সম্পাদন করা হবে ‘

‘চাহিদা অনুযায়ী পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের জন্য মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। উৎপাদনের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন অতিদ্রুত স্থাপন করা হবে। বাপেক্স ও অন্যান্য সরকারি সংস্থার মাধ্যমে দেশীয় খনিজ ও গ্যাস উত্তোলনের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। একই সাথে দেশীয় প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহকে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে তুলতে উপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে’, উল্লেখ করেন তিনি।

এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরে সম্ভাবনাময় গ্যাস/পেট্রোলিয়াম ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ উত্তোলনে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সকল দুর্নীতি-অনিয়মের সাথে জড়িতদের শাস্তি, জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা কমিয়ে ক্রমান্বয়ে মোট উৎপাদনের ৫০ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তিনির্ভর জ্বালানি নীতি গ্রহণ, বেইস লোড পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে স্বল্প ব্যয়ে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন গড়ে তোলা, বৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রগুলোর সংস্কার এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ঘোষিত ভিশন-২০৩০-এ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার কথা তুলে ধরেন বিএনপি মহাসচিব।

এ সময় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ১৯টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট চালুর দুই-তিন বছর পরই বন্ধ হওয়ার কথা থাকলেও প্রয়োজন ছাড়াই এখনো চালু আছে। বেশ কিছু রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি ট্যাক্স বাবদ বিপুল অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ ছাড়াই সরকারকে এ পর্যন্ত ৯০ হাজার কোটি টাকার গচ্চা দিতে হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব ব্যবসায়ীদের পকেটেই গেছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। গত ১২ বছরে ক্যাপাসিটি ট্যাক্স বাবদ গেছে ৮ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি। গত তিন বছরেই গেছে ৫৪ হাজার কোটি টাকা।

তিনি বলেন, বিদ্যুতের চাহিদা সঠিকভাবে নির্ধারণ না করে চাহিদার অনেক বেশি পাওয়ার প্লান্টের সাথে চুক্তি করে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ীদের অর্থ লুট করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এই সরকারের নীতি একটাই, তা হচ্ছে জনগণের সম্পদ লুট করে নিজের সম্পদ বৃদ্ধি করা এবং বিদেশে সেই সম্পদ পাচার করা।

মির্জা ফখরুল বলেন, বর্তমানে দেশে মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাত্র ৪৩ শতাংশ বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়। অবশিষ্ট ৫৭ শতাংশ অলস বিদ্যুৎ বসিয়ে রেখে কেন্দ্রের ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎ না কিনে গত অর্থবছরে বিল পরিশোধ করা হয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা, তার আগে বছর করা হয়েছে ১৪ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে এই খাতে ব্যয় হয়েছে ২১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ বেড়ে হয়েছে ১৮ শতাংশ। ক্রমেই ক্যাপাসিটি চার্জের বিল বেড়েই যাচ্ছে।

তিনি বলেন, এখানেই শেষ নয়। বর্তমানে বাড়তি উৎপাদন ক্ষমতার মধ্যে আরো বিদ্যুৎকেন্দ্র আসছে। এতে অলস খরচ আরো বাড়বে। বর্তমানে ১৩ হাজার ৩৮৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৫টি কেন্দ্র নির্মাণাধীন। ২০২৬ সালের মধ্যে এসব কেন্দ্র উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে তিন হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসতে পারে। নির্মাণাধীন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে বেসরকারি খাতে রয়েছে ৯ হাজার মেগাওয়াট। এই কেন্দ্রগুলোর উল্লেখযোগ্য গ্যাসভিত্তিক। এখনই গ্যাস সংকটে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। আগামী চার বছরে আরো ১৩ হাজার মেগাওয়াটের কেন্দ্র উৎপাদনে এলে বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়বে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ না কিনেও অতিরিক্ত টাকা পরিশোধের অঙ্ক অনেক গুণ বেড়ে যাবে।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান জবাবদিহিহীন সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে অলস বিদ্যুকেন্দ্র রেখেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। আর বসিয়ে বসিয়ে তাদেরকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করে যাচ্ছে। এ অর্থ জনগণের অর্থ। এই ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে গিয়ে বিদ্যুৎ খাত দেউলিয়া হচ্ছে। সরকার টাকা চুরির স্বার্থে মাল্টিফাইন্যান্সিং ইনস্টিটিউটের কম সুদের ঋণ উপেক্ষা করে বর্তমানে পারস্পরিক স্বার্থে উচ্চ সুদের ‘বাইলেটারাল লোন’ পেতে ‘বেশি আগ্রহী’ বলে এর সমালোচনা করে বিএনপি।

ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ভারত থেকে বিদ্যুৎ কিনতে দিতে হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ। ভারত থেকে বর্তমানে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। এ জন্য গত তিন অর্থবছরে প্রায় পাঁচ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে। আদানি গ্রুপের এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির কথা রয়েছে। বাংলাদেশে যখন প্রায় ৬০ শতাংশ ওভার ক্যাপাসিটি রয়েছে ঠিক সে সময় ভারত থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ আমদানি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।

‘১৬০০ মেগাওয়াটের আদানি গোড্ডা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ১৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ বছরে প্রায় ১১.০১ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করবে। এই বিদ্যুৎ আমদানির ৪০ শতাংশ যায় ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধে। বিদ্যুৎ কম এলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। চুক্তির ২৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে আদানি গ্রুপকে এক লক্ষ কোটি টাকারও বেশি পরিশোধ করতে হবে, যা দিয়ে তিনটি পদ্মা সেতু, ৯টি কর্ণফুলী টানেল কিংবা দুটি মেট্রো রেল নির্মাণের জন্য যথেষ্ট।

তিনি বলেন, আদানির এই কম্পানিকে প্রায় তিন বছরে মোট ভাড়া দেওয়া হয়েছে ৫৩ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। আর পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতিসহ খরচ পড়েছে ৩০ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। এ কেন্দ্রটি থেকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কোনো উপকার হচ্ছে না এবং হবে না। তাই এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি বিরাট বোঝা হয়ে আছে, যা ভবিষ্যতে আরো বাড়বে।

সূত্র: কালের কণ্ঠ
এম ইউ/১৩ আগস্ট ২০২২

Back to top button