জাতীয়

এলএনজির অভাবে বোঝা হতে পারে তিন বিদ্যুৎকেন্দ্র

ঢাকা, ০৫ আগস্ট – তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক (এলএনজি) তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে সামিট পাওয়ার, ইউনিক গ্রুপ ও ভারতের রিলায়েন্স। এ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। এই তিনটি কেন্দ্রও ক্যাপাসিটি চার্জ পাওয়ার তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ব্যয়ের বোঝা আরো বাড়বে।

চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে না থাকলেও শুধু সক্ষমতার জন্য নির্দিষ্ট হারে যে অর্থ পরিশোধ করতে হয়, সেটাই ক্যাপাসিটি চার্জ বলে পরিচিত। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) গত ১১ বছরে (২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর) বেসরকারি খাতে ৯০ হাজার কোটি টাকা শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে।

বেসরকারি খাতে এলএনজিভিত্তিক তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে। সামিট পাওয়ার, ইউনিক গ্রুপ ও ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপ পৃথকভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণ করছে। এরই মধ্যে চলতি মাসের শেষ দিকে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে। অন্যটির উৎপাদন আগামী বছরের মার্চ নাগাদ শুরুর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

জ্বালানি খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গ্যাসসংকটে এখনই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে গ্যাসের উৎপাদন আরো কমার শঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় নির্ধারিত সময়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে যাওয়া নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রস্তুত হওয়ার পর গ্যাসের অভাবে চালু করতে না পারলেও এগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, ‘এলএনজিভিত্তিক যে তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে, সেগুলোতে এলএনজি সরবরাহ নিশ্চিত না করেই করা হচ্ছে। এখন সেই এলএনজি কোথা থেকে আসবে। এলএনজির অভাবে এ তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে হয়তো বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হবে। এটা একটা মারাত্মক ভয়ের ব্যাপার। সামনে এই কেন্দ্রগুলো আমাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। ’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি ও গবেষণা শাখা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘এলএনজিভিত্তিক এই তিন কেন্দ্র উৎপাদনে এলে গ্যাসসংকটের কারণে কিছুটা সমস্যা তৈরি হতে পারে। এমন সংকট যে চলে আসবে তা তো আগে জানারও কোনো উপায় ছিল না। তবে এই কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসতে আসতে দেশীয় কূপগুলো থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের উৎপাদন বাড়বে। ’

পিডিবির তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। এখন চাহিদা প্রায় সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট। বসিয়ে রাখা সক্ষমতার বিপরীতে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসেই (জুলাই-মার্চ) বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে মোট ১৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে সরকারকে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের একটা ভিশন ছিল ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের অর্থনীতি যেভাবে এগোবে তাতে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বাড়বে। কিন্তু সেভাবে বিদ্যুিভত্তিক উৎপাদন বা শিল্প-কারখানা হয়নি। ফলে পরিকল্পনা সঠিক হয়নি। সরকারও সেটা বুঝতে পারছে। এখন পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।

এ বিষয়ে অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, ‘তেলভিত্তিক যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে না, অথবা সারা বছরে অল্প পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে, অথচ ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে শত শত কোটি টাকা নিচ্ছে। সেগুলোকে দ্রুত বন্ধ করে দিতে হবে। ’

কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, ‘বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ক্যাপাসিটি চার্জ একটা স্বীকৃত পদ্ধতি। কিন্তু বাংলাদেশে যা হয়েছে তা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে লাভবান করার জন্য করা হয়েছে। প্রথমত, ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেশি ধরা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, অপ্রয়োজনে চুক্তি করা হয়েছে। ’

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিজ অফিসকক্ষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস বলেন, ‘এটি কেবল বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী এই ব্যবস্থা আছে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ৬৫ শতাংশ ব্যয় হয় জ্বালানিতে এবং ৩৫ শতাংশ ব্যয় হয় বিনিয়োগজনিত। ’

বিদ্যুৎ আমদানিতেও ক্যাপাসিটি চার্জ

ভারত থেকে বর্তমানে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। এ জন্য গত তিন অর্থবছরে প্রায় পাঁচ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে। ভারতের আদানি পাওয়ার ঝাড়খণ্ড প্রদেশের গোড্ডা জেলায় এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের একটি তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে, যার বেশির ভাগই বাংলাদেশে রপ্তানি হবে। এ কেন্দ্রটি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে। এখান থেকে বিদ্যুৎ বাংলাদেশে নিয়ে আসার সঞ্চালন লাইনটির কাজ ডিসেম্বরের আগে শেষ হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। ফলে বিদ্যুৎ পাওয়ার আগেই ওই কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া শুরু হবে। চুক্তি অনুসারে ২৫ বছরে কম্পানিটি ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে আদানি গ্রুপ প্রায় এক লাখ কোটি টাকা পাবে।

প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা পেয়েছে ১২ কম্পানি

পিডিবির তথ্য বলছে, ১১ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে যে ৯০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে, তার ৬০ হাজার কোটি টাকাই পেয়েছে ১২টি কম্পানি। এর মধ্যে আবার চারটি কম্পানিই পেয়েছে প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা।

সূত্র: কালের কণ্ঠ
এম ইউ/০৫ আগস্ট ২০২২

Back to top button