জাতীয়

আড়াই ঘণ্টা চলন্ত বাসে ডাকাতি, হাইওয়ে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

এনায়েত করিম বিজয়

টাঙ্গাইল, ০৪ আগস্ট – কুষ্টিয়া থেকে ছেড়ে আসা নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল এক্সপ্রেসের চলন্ত বাসটি আড়াই ঘণ্টা নিয়ন্ত্রণে ছিল ডাকাতদের। বাসটি আড়াই ঘণ্টা ধরে ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের নাটিয়াপাড়া, মধুপুর ও সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন সড়কে ঘুরিয়েছে ডাকাতরা। পরে মধুপুর উপজেলার রক্তিপাড়ায় বালুর স্তূপে বাসটি উল্টে দিয়ে পালিয়ে যায় তারা। এত সময় ধরে বাসটি বিভিন্ন সড়কে ঘোরালেও হাইওয়ে পুলিশ কিংবা থানা পুলিশের চোখে পড়েনি। কারণ, এসব সড়কের কোথাও পুলিশের চেকপোস্ট ছিল না। এমনকি হাইওয়ে পুলিশের টহলও ছিল না।

বৃহস্পতিবার (৪ আগস্ট) দুপুরে ওই বাসের চালক, দুজন যাত্রী, ঈগল এক্সপ্রেসের পরিচালক ও হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ অবস্থায় বাসচালক, যাত্রী ও ঈগল এক্সপ্রেসের পরিচালক এবং সচেতন মহল প্রশ্ন তুলেছেন ওই সময় কোথায় ছিল হাইওয়ে পুলিশ?।

ডাকাতদের কবলে পড়া বাসের যাত্রী ছিলেন কুষ্টিয়া শহরের দুই ব্যক্তি ও দৌলতপুরের এক নারী। নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। তারা বলেন, ‘সিরাজগঞ্জ মহাসড়কের পাশে জনতা হোটেলে রাত সাড়ে ১১টার দিকে যাত্রীদের রাতের খাবারের জন্য যাত্রাবিরতি দেয় বাসচালক। খাওয়া-দাওয়া শেষে রাত ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাড়ের কাছাকাছি পৌঁছালে ১০-১২ জন যুবক বাসে ওঠে। বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পাড়ে পৌঁছালে রাত ১টার দিকে চালককে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বাসের নিয়ন্ত্রণ নেয় ওই যুবকরা। যাত্রীদের হাত-পা ও মুখ বেঁধে টাকা, স্বর্ণালংকার এবং মোবাইল লুট করে নেয়। এ সময় এক নারী প্রতিবাদ করলে তাকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। ফলে সবাই প্রাণভয়ে আতঙ্কে ছিলাম।’

তারা বলেন, ‘রাতের ১টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত বাসটি মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে ঘোরানো হয়েছে। ডাকাতদের একজন বাস চালিয়েছিল। এ সময় মহাসড়কের কোথাও পুলিশকে দেখিনি আমরা। কোনও চেকপোস্ট ছিল না। আমরা তখনও ভাবছিলাম, হয়তো পুলিশের চোখে পড়বে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কারও দেখা পাইনি। এর মধ্যে দু’একজন চিৎকার করেছিল। তাদের হাত কিংবা গলা কেটে দেওয়া হয়েছে। আবার মারধরও করা হয়েছে।’

বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা টাঙ্গাইল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান আজাদ বলেন, ‘যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে সড়কের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশি টহল ও চেকপোস্ট বসানো জরুরি। আমরা এতদিন জানতাম, মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশের টহল ও চেকপোস্ট থাকে। কিন্তু এখন না থাকার কথা শুনে আমরা উদ্বিগ্ন।’

ঈগল এক্সপ্রেসের পরিচালক সোলাইমান হক বলেন, ‘ঘটনার পর আমরা খবর নিয়ে জানতে পেরেছি আড়াই ঘণ্টা ধরে মহাসড়কে বাসটি ঘুরিয়েছে ডাকাতরা। চালকসহ যাত্রীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে হাত-পা, মুখ ও চোখ বেঁধে মালামাল লুট করে নেয়। আগে নিয়মিত মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চেকপোস্ট বসানো হতো। কিন্তু এখন চেকপোস্ট বসানো হচ্ছে না। সড়কে চেকপোস্ট থাকলে এমন ঘটনা ঘটতো না। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল হাইওয়ে পুলিশের। কেন তারা নেয়নি, ঘটনার সময় কোথায় ছিল তারা? সড়কে আবারও চেকপোস্ট বসানোর জোর দাবি জানাচ্ছি আমরা।’

টাঙ্গাইল জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি ইকবাল হোসেন বলেন, ‘ঘটনাটি আমাদের লজ্জিত করেছে। কারণ এ ঘটনায় বাসের এক চালকও জড়িত আছে। আমরা চাই ঘটনায় জড়িত সবার শাস্তি হোক।’

তিনি আরও বলেন, ‘সড়কে আগে চেকপোস্ট বসানো হতো। কিন্তু এখন বসানো হচ্ছে না। উত্তরবঙ্গ কিংবা ঢাকা থেকে যেসব বাস মধ্যে রাতে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা দিয়ে লিংক রোড হয়ে ময়মনসিংহ শহরে প্রবেশ করে, সেসব বাস চেক করা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে সড়কের শুরুত্বপূর্ণ স্থানে চেকপোস্ট বসানো জরুরি। হাইওয়ে পুলিশের চেকপোস্টে তল্লাশির ব্যবস্থা থাকলে এমন ঘটনা ঘটতো না। এজন্য আবারও চেকপোস্ট বসানোর দাবি জানাই।’

সড়কে চেকপোস্ট না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে এলেঙ্গা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আতাউর রহমান বলেন, ‘মহাসড়কে চেকপোস্ট বসানো এখন বন্ধ আছে। কি কারণে চেকপোস্ট বসানো বন্ধ রয়েছে, তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভালো বলতে পারবেন।’

tangail

তিনি বলেন, ‘সড়কে ডাকাতির ঘটনা বন্ধ করতে হলে মাঝপথে কিংবা পথিমধ্যে যাত্রী ওঠানামা বন্ধ করতে হবে। প্রতিটি কাউন্টার থেকে যাত্রী ওঠানামা করলে ডাকাতি কিংবা এমন ঘটনা কমে যাবে।’

চেকপোস্ট বসানো হয় না কেন জানতে চাইলে গাজীপুর হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাজমুস সাকিব খান বলেন, ‘চেকপোস্ট বসানো আপাতত বন্ধ রয়েছে। কতদিন ধরে বন্ধ রয়েছে তার সঠিক তথ্য আমার জানা নেই। সুনির্দিষ্ট তথ্য না পেলে আমরা গাড়ি তল্লাশি করি না। তারপরও মাঝেমধ্যে চেকপোস্ট বসাই। চেকপোস্ট বসালে মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। চেকপোস্ট না বসানোর কারণে যানজট কিছুটা কমেছে। তবে এখন মনে হচ্ছে, মানুষের ভোগান্তি হলেও চেকপোস্ট বসানো প্রয়োজন।’

আড়াই ঘণ্টা বাসটি ডাকাতের নিয়ন্ত্রণে থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে সেখানকার দায়িত্বরত হাইওয়ে পুলিশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছেন আসলে রাতে চলন্ত বাসের ভেতরে কি হচ্ছে তা দেখা যায় না। এমনিতেই গাড়ি চলার সময় ভেতরের অবস্থা ততটা দেখা যায় না। রাতে সড়কে হাইওয়ে পুলিশের টহল তেমন বেশি থাকে না। হয়তো একটি দল টহল দিয়েছিল, কোনও কারণে তাদের চোখ এড়িয়ে গেছে। কিংবা মিস হতে পারে। এলেঙ্গা থেকে করটিয়া পর্যন্ত আমাদের এরিয়া। ঘটনার সূত্রপাত আরও পরে থেকে। এটি চার লেনের সড়ক। গাড়িটি যখন আবার ঘুরিয়ে সেতুর ওই পাড়ে গেছে তখন হয়তো টহল দল মিস করেছে। তা না হলে তো তাদের চোখে পড়তো। গাড়িটি যখন এলেঙ্গা থেকে মধুপুরের দিকে ঢুকে গেছে, আসলে ওই দিকে হাইওয়ে পুলিশের এরিয়া না। তবে এ ঘটনার পর টহল জোরদার করবো আমরা।’

মধুপুর উপজেলার রক্তিপাড়ায় বালুর স্তূপে বাসটি উল্টে দিয়ে ডাকাত দল পালিয়ে যায়
এর আগে মঙ্গলবার রাত ১টার দিকে কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল এক্সপ্রেসের চলন্ত বাসের নিয়ন্ত্রণ নেয় ডাকাতরা। আড়াই ঘণ্টা ডাকাতি ও নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ শেষে রাত সাড়ে ৩টার দিকে মধুপুর উপজেলার রক্তিপাড়ায় বালুর স্তূপে বাসটি উল্টে দিয়ে ডাকাত দল পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার ভোরে ঘটনার মূলহোতা ঝটিকা পরিবহনের চালক রাজা মিয়াকে গ্রেফতার করেছে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

eagle

টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার (এসপি) সরকার মোহাম্মদ কায়সার বলেন, ‘বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনার পর থেকে বিভিন্ন এলাকায় অভিযান শুরু করে পুলিশ। রাতে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অভিযান চালিয়ে ঘটনার মূলহোতাকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে যাত্রীদের তিনটি মোবাইল উদ্ধার করা হয়েছে। সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে তাকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।’

যাত্রীদের নিরাপত্তা ও উদ্বেগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সবসময় সড়কে নিয়োজিত থাকে পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ। প্রয়োজনে সড়কে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হবে।’

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
এম ইউ/০৪ আগস্ট ২০২২

Back to top button