ঢাকা, ২৯ জুলাই- ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রা ও রেমিট্যান্সের নিম্নমুখী প্রবণতা, মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া ও বাণিজ্য ঘাটতিসহ নানা কারণে অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেখা দিয়েছে ঘাটতি, যার প্রভাবে দেশজুড়ে পরিকল্পিতভাবে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। যদিও সরকারের তরফ থেকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে কৃচ্ছ্রসাধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের পাশাপাশি এবার জ্বালানি খাতে ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরেছে সরকার। সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ কোম্পানিগুলো এখন থেকে জ্বালানি খরচের সর্বোচ্চ ৮০ ভাগ পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারবে। আর বিদ্যুৎ খাতের বরাদ্দের ২৫ ভাগ সাশ্রয় করতে হবে। এতে করে সরকারের বেশ ভালো অংকের অর্থ বেঁচে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে বিদেশি ঋণ পেতে মরিয়া হয়ে পড়েছে সরকার। আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী সংস্থা বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকার কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের জন্য ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ডলারের দাম বেড়েই চলছে। ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’ ঋণাত্মক হওয়ায় আইএমএফের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। কোভিডের কারণে অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে। এর সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারাবিশ্বে সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। মূল্যস্ফীতি ঘটছে।
ডলার সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের তথ্যে গরমিল আছে। অর্থাৎ যে পরিমাণ আমদানির কথা বলা হয়, সেই পরিমাণ আমদানি পণ্য দেশে আসে না। আবার রপ্তানির আয় পুরোটা আসছে না। ‘আন্ডার ইন ভয়েসিং’ এবং ‘ওভার ইন ভয়েসিংয়ের’ কারণে বেশ বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে রয়ে যাচ্ছে। সাধারণত রেমিট্যান্সের মাধ্যমে এ ঘাটতি মেটানো হতো। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় এবং বাজারে চাহিদা অনুযায়ী ডলার সরবরাহ না থাকায় টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। আমদানি-রপ্তানির ফারাক নিয়ে তদন্ত হয় না। তদন্ত হলে সত্য উদ্ঘাটন হবে। দূরদৃষ্টির অভাবে বিদ্যুৎ খাতে উৎপাদনের জন্য বৈদেশিক জ্বালানি উৎসের ওপর নির্ভর করা হয়েছে। নতুন গ্যাসক্ষেত্র অন্বেষণ করা হয়নি। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় ডলারের ওপর আরেকটি ধাক্কা পড়েছে।
অধ্যাপক তিতুমীর বলেন, অর্থনীতির মৌলিক স্তম্ভসমূহ ব্যাপক চাপের মধ্যে পড়েছে। অভ্যন্তরীণ ঋণ বাড়ছে; তাল মিলিয়ে রাজস্ব বাড়ছে না। অন্যদিকে বিদেশি ঋণের হার বাড়ছে। বৈদেশিক ঋণ ৯ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
অধ্যাপক তিতুমীর বলেন, জিডিপির অনুপাতে গত কয়েক বছরে সঞ্চয়ের পরিমাণ কমেছে। আর ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ দীর্ঘদিন ধরেই স্থবির ছিল। সঞ্চয় কমে যাওয়ায় বিনিয়োগের ওপরও বড় ধরনের চাপ পড়বে। তা হলে বেকারত্ব বেড়ে যাবে। কোভিড মহামারীর আগে আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান ঋণাত্মক ছিল। একই অবস্থা ছিল শিল্প খাতে। অন্যদিকে কৃষি খাতে জনসংখ্যার তুলনায় চাল ও গমের উৎপাদন বাড়ছে না। ফলে খাদ্য নিরাপত্তায় বড় রকমের চাপ তৈরি হচ্ছে।
আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হবে কিনা- তা নিয়ে কয়েক মাস আগেও দোটানায় ছিল সরকার। কিন্তু বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকায় সরকার তাদের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরই প্রেক্ষাপটে আইএমএফের কাছ থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ আলোচনা শুরু করার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয় গত সোমবার।
সূত্র জানায়, আইএমএফের কাছ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ছাড়াও বিশ্বব্যাংক ও জাইকার কাছ থেকে ১০০ কোটি করে ২০০ কোটি ডলার পাওয়ার আশা করছে সরকার। এ ছাড়া এডিবির কাছ থেকে ৭৫ কোটি ডলার পাওয়ারও চেষ্টা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের এক সূত্র জানায়, অর্থমন্ত্রীর পক্ষ থেকে গত সোমবার আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভার কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেই চিঠিতে সংস্থাটির কাছ থেকে তিন বছর মেয়াদে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার জন্য আলোচনা শুরুর আহ্বান করা হয়েছে। বলা হয়, এই ঋণ পাওয়া গেলে তা লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষা ও বাজেট সহায়তা কার্যক্রমে ব্যবহার করা হবে। এই ঋণ আইএমএফের বর্ধিত ঋণসহায়তা (ইসিএফ), বর্ধিত তহবিল সহায়তা (ইএফএফ) এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবিলার জন্য গঠিত সহনশীলতা ও টেকসই তহবিল (আরএসএফ) থেকে চাওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, আইএমএফের পক্ষ থেকে এই ঋণ নিয়ে আলোচনা করার জন্য আগামী মাসে একটি মিশনকে বাংলাদেশে পাঠানো হতে পারে। এই মিশনের পক্ষ থেকে ঋণ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। তবে এই ঋণ পেতে হলে আইএমএফের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি শর্তের মুখোমুখি হতে হবে সরকারকে। এর মধ্যে রয়েছে তেল ও সারের ওপর সরকার যে ভর্তুকি দিচ্ছে, তা তুলে নেওয়া। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে এনে সংস্কারসাধন করা এবং বিদ্যুতের দাম বাড়ানো অন্যতম।
আইএমএফের পক্ষ থেকে ঋণ পাওয়া গেলেও তা এ বছর ছাড় নাও হতে পারে। এই ঋণের প্রথম কিস্তি পেতে পেতে সরকারকে আগামী বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে।
এদিকে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘অর্থমন্ত্রী যদিও এ মুহূর্তে টাকা না নেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু আমি মনে করি, চলতি লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষার জন্য (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া উচিত বাংলাদেশের। কারণ আমাদের সমস্যা কোনো মৌসুমি সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে কাঠামোগত।’
তথ্যসূত্র: আমাদের সময়
মুন/২৯ জুলাই