হাসি একটি সুন্নত
নগরজীবনে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা অহরহ একে অন্যের দ্বারস্থ হই। সকালে বাজারে গিয়ে কেনাকাটায় কিংবা অফিসে যাওয়ার পথে টাকা ভাঙতির মতো খুব সাধারণ প্রয়োজনেও আমরা একে অন্যের কাছে সাহায্য চাই।
মানুষ হিসেবে আমাদের এমন পারস্পারিক নির্ভরশীলতা সৃষ্টির সূচনা থেকেই চলে আসছে। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে আমাদের মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে। পরিচিত কিংবা অপরিচিত মানুষের বেলায় আমাদের উপকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় আজ স্বার্থপরতা মিশে যাচ্ছে। অপরিচিত মানুষের ডাকে সাড়া দেওয়ার মতো লোকের সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছে। চেনা মানুষের জন্যও যে সবাই মনপ্রাণ উজাড় করে এগিয়ে আসেন- সেটাও হলফ করে বলা কঠিন।
ইসলাম যে সামাজিকতা ও মানবতার সবচেয়ে সুন্দর ও পরিপূর্ণ জীবনবিধান- এ সত্য বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে সরে পড়েছি বলেই আজ আমাদের পরস্পরের মধ্যে এমন যোজন যোজন ব্যবধান। যারা ইসলামের ধারক বাহক হয়ে ইবাদতের আবহে দিনরাত কাটিয়ে দিচ্ছেন- তাদের মধ্যেও কিন্তু ইসলামের সামাজিক রূপ দিনদিন বর্ণহীন হয়ে পড়েছে। মানুষ হিসেবে একে অপরের উপকারে উৎসর্গিত হয়ে খুব সহজেই যে আমরা মহান আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে গণ্য হতে পারি- এ সহজ বিষয়টিও আজ আলোচনার বাইরে।
সুরা বাকারার ১৯৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক আদেশ করেছেন, তোমরা দয়া করো, আল্লাহ পাক দয়ালুকে ভালোবাসেন।
সুরা আরাফের ৫৬ নম্বর আয়াতে তিনি বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ পাকের রহমত দয়ালু মানুষের খুব কাছে।
হজরত ইবনে উমরের বর্ণনায় রয়েছে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে এক লোক জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর নবী! আল্লাহর কাছে কোন মানুষটি সবচেয়ে বেশি প্রিয়? নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহর কাছে ওই মানুষটিই সবচেয়ে বেশি প্রিয়, যার মাধ্যমে মানুষ বেশি উপকৃত হয়।
একজন বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অসংখ্য ফজিলত কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো অসহায় পরিবারে খুশির বার্তা এনে দিল, আল্লাহ পাক তাকে বিনিময় হিসেবে জান্নাত ছাড়া অন্য কিছু দেবেন না। (তাবারানি)
মুসলিম শরীফের বর্ণনায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন, দুনিয়াতে যে ব্যক্তি কোনো মানুষের একটি বিপদের সমাধান করে দিল, আল্লাহ পাক তাকে কিয়ামতের দিন একটি বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন। যে ব্যক্তি কোনো সংকটাপন্ন মানুষের জন্য তার বিষয়টি সহজ করে দিল, আল্লাহ পাক দুনিয়াতে এবং আখিরাতে তার জন্য সবকিছু সহজ করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলমান ভাইয়ের দোষত্রুটিগুলো গোপন রাখবে, আল্লাহ পাক দুনিয়া ও আখেরাতে তার বিচ্যুতিগুলো ঢেকে রাখবেন। আল্লাহ পাক ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো মানুষের পাশে থাকেন, যতক্ষণ সে তার কোনো ভাইয়ের সাহায্যে ব্যস্ত থাকে।
আরও পড়ুন: ধর্ষণ প্রতিরোধে ধর্মীয় মূল্যবোধ
হজরত আবু বকর (রা.) খলীফাতুল মুসলিমীন হওয়ার আগে তার এক প্রতিবেশী নারীর ছাগলের দুধ দোহন করে দিতেন। ওই নারী যখন হজরত আবু বকরের খলীফা হওয়ার সংবাদ পান, তখন বলে ওঠেন, এখন তো আর তিনি আমার ছাগলের দুধ দোহন করবেন না। হজরত আবু বকর বললেন, খেলাফতের দায়িত্ব পেয়েও আমি আশা করি তা আমার মধ্যে আগের বিষয়গুলোয় কোনো পরিবর্তন আনবে না। খলীফা হয়েও তিনি প্রতিদিন সকালে নিয়মিতভাবে ওই নারীর বাড়িতে গিয়ে ছাগলের দুধ দোহন করে দিতেন।
ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হজরত উমর (রা.) রাতের নির্জনে মদীনার বৃদ্ধাদের ঘরে পানি পৌঁছে দিতেন। এক রাতে হজরত তালহা (রা.) হজরত উমরকে (রা.) এক অপরিচিত ঘরে ঢুকতে দেখলেন। তিনি চুপি চুপি অপেক্ষা করে হজরত উমর (রা.) বেরিয়ে যাওয়ার পর ওই ঘরে যান। ভেতরে গিয়ে তিনি দেখেন যে ওই ঘরে একজন অন্ধ বৃদ্ধা একা থাকেন। তার চলাফেরার কোনো শক্তি নেই। হজরত তালহা ওই নারীকে জিজ্ঞেস করলেন, একটু আগে যে লোক এসেছিল, তিনি এখানে এসে কী করেন? নির্বিকার ভঙ্গিতে বৃদ্ধা জানালেন, এই লোক তো অনেক দিন ধরেই এখানে আসে। সে আমার ঘরের ময়লাগুলো পরিষ্কার করে দেয় এবং আমার প্রয়োজনের কাজগুলো করে দেয়। হজরত তালহা এ জবাব শুনে হতবাক হয়ে গেলেন।
যে ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের বলে গেছেন, তোমরা কোনো ভালো কাজকেই তুচ্ছ মনে করবে না। এমনকি তোমার মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করার ব্যাপারটিকেও। সে-ই ইসলামে বিপদগ্রস্থ, অসহায় ও দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোতে যে অসীম পূণ্য ও মর্যাদা বলা হয়েছে, সে বিষয়ে উদাসীন বলেই নিজেদের নিয়ে আমরা এমন ব্যস্ত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনও বলেছেন, কোনো বঞ্চিত মানুষের সঙ্গে থেকে তার অধিকার ফিরে পাওয়া পর্যন্ত যে ব্যক্তি সঙ্গ দিয়ে যাবে, আল্লাহ পাক তাকে ওইদিন অটল অবিচল রাখবেন যেদিন অনেক মানুষের পা পিছলে যাবে।
মসজিদে নববীতে ইতিকাফে বসে আছেন হজরত ইবনে আব্বাস (রা.)। এক লোক এসে নিজের প্রয়োজন জানিয়ে তার সাহায্য চাইলো। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) ইতিকাফ ছেড়ে তার সঙ্গে মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেলেন। লোকেরা তাকে স্মরণ করিয়ে দিল, আপনি তো ইতিকাফে বসেছেন। হজরত ইবনে আব্বাস তখন তাদের বললেন, মসজিদে নববীতে এক মাস বসে ইতিকাফ করার চেয়েও আমার এক ভাইয়ের সাহায্যে এগিয়ে আসাটা অনেক বেশি উত্তম।
কাজের দৌড়ে খুব বেশি বাড়তি ইবাদত করার সময় হয়ে ওঠে না অনেকের। কিন্তু চাইলে ঘরে-বাইরে চলতি পথে মানুষের ক্ষুদ্র থেকে যে কোনো বিষয়ে (হারাম কিছু বাদে) আমরা সাহায্য-সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে পারি। নিজের সাধ্যমতো স্ব স্ব অবস্থানে থেকে অপরের প্রয়োজন কিংবা বিপদে পাশে দাঁড়াতে পারি। হোক তা অর্থসাহায্য কিংবা দু’চারটি সান্ত্বনার বাক্য। স্বার্থপরতা ও বাণিজ্য মোহের এ অস্থির সময়ে আমরা যেন ভুলে না যাই যে কারো সঙ্গে কয়েক সেকেন্ড হাসিমুখে কথা বলাও আল্লাহ পাকের কাছে পূণ্যময় কর্ম হিসেবে গণ্য।
এন এইচ, ০৯ অক্টোবর