ইসলাম

নিছক রুকু সিজদার নাম নামায নয়

সেদিন আমার পাশে বসে রাগ ঝাড়ছিলেন এক ভদ্রলোক। যাকে নিয়ে তার এত রাগ আর ক্ষোভ- তার কথা বলতে গিয়ে একপর্যায়ে তিনি আমাকে বললেন, এই লোক আবার নামাজও পড়ে, কী লাভ এই নামাজের যদি ব্যবহারই ঠিক না হয়।

সেদিন আমিও থমকে গিয়েছিলাম তার উক্তি শুনে। সত্যিই তো, আমরা কত মানুষকেই তো নামাজ পড়তে দেখি- কিন্তু ক’জন নামাজের দাবি মেনে জীবনের সর্বক্ষেত্রে তা মেনে চলি। অফিস আদালতে কত নামাযি ব্যক্তিই তো দায়িত্বে ফাঁকি দিচ্ছে, ব্যবসায়ী ওজনে কম দিচ্ছে, নামাযি কত মানুষ অহরহ মিথ্যা বলছে, অন্যকে ঠকাচ্ছে।

অথচ সৎভাবে জীবনযাপন, সত্য কথা বলা, অনাচার ও অসত্য থেকে বেঁচে থাকা- এসবই তো নামাজের দাবি। শুধু দাবিই নয়, আল্লাহ পাক তো বলেছেন, নিশ্চয় নামায অশ্লীল ও নিষিদ্ধ বিষয় থেকে বিরত রাখে। (সূরা- আনকাবুত, আয়াত-৪৫) কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে নামাযের এ ফলাফল প্রকাশ হয় না কেন? নামায তো আমাদের মিথ্যা কথা ও খারাপ ব্যবহারকে বন্ধ করতে পারছেনা। তবে কেন?

আমরা বেমালুম ভুলে আছি, নামায তো তখনই সব মিথ্যা ও অসত্য থেকে দূরে রাখবে যখন তা সত্যিকারের নামায হবে। আরও সহজ ভাষায়, নিছক নিয়ত করে রুকু ও সেজদার নামই কি নামায? কয়েকটি সূরা আর দুআর সম্মিলিত রূপ দিয়েই কি নামায?

আরও পড়ুন: সত্যবাদিতা : একটি মহৎ মানবিক গুণ

আরেকটু গভীরে এসে বুঝি। আমাদের প্রত্যেকটি আমল আল্লাহর কাছে পৌঁছে- এ কথা সত্য ও অনস্বীকার্য। কিন্তু আমল করার গুণাগুণের ওপর নির্ভর করে এর পরবর্তী রিপ্লাই ও প্রতিফলন। যেমন, নামায আমাদের ওপর কর্তব্য। এখন কোন রকমে সঠিকভাবে তা আদায় করে কেউ শুধু তার কর্তব্য আদায় থেকে দায়িত্বমুক্ত হল এবং বিনিময়ে সে কিছুই পেলনা, আরেকজন দায়িত্বমুক্তির পাশাপাশি এর বিনিময়ে নির্ধারিত সওয়াবটুকুও পেল তার সঠিক আদায় পদ্ধতির জন্য।

আরেকজন এর চেয়েও বেশি, তিনি তার ভেতরের আত্মীক সংযোগের ফলে শুধু দায়িত্বমুক্তি ও সওয়াব নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িত ও ঘোষিত সব বোনাস- যেমন বিশুদ্ধ আত্মার অনুভূতি, রিযিকের গ্যারান্টি, অশ্লীল ও অনাচার থেকে বেঁচে থাকার অফুরন্ত শক্তি, প্রশান্ত চিত্ত, সবার জন্য কল্যাণকামী হৃদয়- এমন অসংখ্য গুণাবলী যা কেবল প্রকৃত নামাযিদের জন্য প্রাপ্য- সব তিনি প্রাপ্ত হলেন। আর এ শ্রেণির লোকের দু’রাকাত নামায প্রথম শ্রেণির দু’হাজার রাকাত নামাজের চেয়েও বেশি শক্তিশালী ও কার্যকর, দুনিয়াতে ও আখেরাতে। সাহাবা ও বুযুর্গদের শত শত ঘটনা এর প্রমাণ। আল্লাহ পাক বলেছেন, এসব ঈমানদাররা সফল যারা তাদের নামাযে একাগ্রচিত্ত ভিত। (সূরা মুমিনূন-১-২)

কিন্তু কিসের গুণে এ তারতম্য? কেন এ পার্থক্য? সরল কথায়, নামায আদায়ের পদ্ধতির সঠিক জ্ঞান ও ব্যবহার, সূরা কেরাতের বিশুদ্ধতা, ধির-স্থিরতা এবং নামায আদায়ের সময় একাগ্রচিত্তে স্রষ্টাকে স্মরণ ও তার বড়ত্বের গুণাবলীর হৃদয়ে সার্বক্ষণিক উপস্থিতি- এসবের সমন্বয়ে নামায তখন নিছক কেবল রুকু সিজদার নাম নয়, বরং তা হয়ে ওঠে মহান রবের সাথে সরাসরি সাক্ষাত ও কথোপকথনের অপার্থিব স্বাদ ও অনাবিল আনন্দের মাধ্যম।

এ নামাযই কেবল রুখতে পারে সব অনাচার ও অন্যায় থেকে। এজন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (সা.) বলেছেন, নামায শেষ করার পর কারো জন্য দশভাগের এক ভাগ সওয়াব লেখা হয়, কারো জন্য নয় ভাগের এক ভাগ, আট ভাগের এক ভাগ…..কারো জন্য অর্ধেক অংশ লেখা হয়। (আবু দাউদ) রাসূল (সা.) অন্যত্র বলেছেন, মানুষ যখন নামাযে অন্যদিকে মনোযোগ দেয়, আল্লাহ পাকও তখন তার থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেন। (নাসাঈ)

এজন্যই এক বুযুর্গ বলেছেন, ‘আমাকে যদি বলা হয়, তুমি জান্নাতে যাবে নাকি নামায পড়বে- আমি বলব, দু’রাকাত নামায আমার কাছে জান্নাতের চেয়েও আনন্দময় মনে হয়। কারণ জান্নাত তো নিজেকে নিয়ে মত্ত ও ফুর্তি করার জায়গা, আর নামাযে তো আমি স্বয়ং জান্নাতের স্রষ্টার সাথে কথা বলতে পারি।’ নিজের অস্তিত্বের কথা এভাবে ভুলে যাওয়া কি খুব সহজ?

এমনি কি আর আল্লাহর রাসূল বলেছেন, নামাজ মুমিনের জন্য মিরাজ সরূপ। অন্যত্র বলেছেন, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম এ নামাযের হিসেব নেওয়া হবে, যার নামায ঠিক পাওয়া যাবে- তার সব আমল ঠিক, যার নামাযে ত্রুটি দেখা দিবে- তার অন্যান্য আমলও তেমনি হয়ে পড়বে। (তাবারানী ও তারগীব)

কাজেই সংক্ষিপ্ত এ জীবনে যদি দু’রাকাত নামাযও এভাবে আদায় করতে পারি, তাহলে তখনই কেবল অনুভূত হবে আত্মীক স্বাদ ও আনন্দের অবর্ণনীয় অনুভব। যে অনুভবে ডুবে গিয়ে সারা রাত কাটিয়ে দেন জায়নামাযে কত সাধক।

এন এইচ, ০৯ অক্টোবর

Back to top button