বিচিত্রতা

অসুস্থ স্ত্রী বৃদ্ধাশ্রমে, আরেক বিয়ে করে নতুন বউয়ের সঙ্গে সংসার করছেন স্বামী

নুরজাহানের জীবন-সংগ্রাম শুরু হয় ছোটবেলায়। অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠা এই নারীকে অন্যের বাসায় ও গার্মেন্টসে কাজ করতে হয়। কষ্টের জীবনে সুখের খোঁজে একদিন তার ‘জীবনতরী’ ভেড়ে কুমিল্লার এক ব্যক্তির দ্বারে। শুরু হয় তাদের নতুন জীবন। স্বামীকে নিয়ে সুখের ঘর সাজান। তার কোলজুড়ে আলো ছড়ায় এক মেয়ে।

তবে অসুস্থতা নামের এক ‘কালো মেঘ’ একদিন ঘিরে ধরে নুরজাহানকে। ছেড়ে যান স্বামী। শুরু হয় জীবনের আরেক সংগ্রাম। অতীত ভুলে স্বপ্ন বুনতে থাকা এই নারীর শেষ জীবনে এখন পাশে স্বজনদের কেউ নেই। রাজধানীর মিরপুরে ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’-এ ১৯ নম্বর বিছানা এখন তার ঠিকানা।

নুরজাহান জানান, তাদের ঘর আলো করে আসা মেয়ে একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। তার একমাত্র ভাইও মারা গেছে। বাবা-মাও বেঁচে নেই। তার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে স্বামীও আরেক নারীকে বিয়ে করে সংসার করছেন। তাই ভাগ্যের চাকা তাকে টেনে এনেছে বৃদ্ধাশ্রমে। ২০২১ সাল থেকে তিনি সেখানেই থাকছেন। এখন বৃদ্ধাশ্রমের অনেকেই তার আত্মীয় হয়ে গেছেন।

কীভাবে বৃদ্ধাশ্রমে এলেন, গনমাধ্যম থেকে জানতে চাইলে নুরজাহান বলেন, ‘এক বছর আগে যখন বেশি অসুস্থ ছিলাম, হাঁটতে পারতাম না; তখন চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার থেকে আমার বাড়িতে যায় কয়েকজন। তারা আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। তারা আমার কষ্ট দেখে আমাকে নিয়ে যেতে চায়। আমিও রাজি হই। তখন তারা আমাকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তি করে। সেখানে পাঁচ দিন ভর্তি থাকার পর এখানে নিয়ে আসে। গত বছর কোরবানি ঈদে এখানে আসছি।’

আগের থেকে কিছুটা সুস্থ জানিয়ে এই নারী বলেন, ‘আগে বেশি অসুস্থ ছিলাম। এখন তো একটু হাঁটতে পারি, তখন হাঁটতেও পারতাম না। ঘুম থেকে উঠে নিজে নিজে উঠতে পারিনি।’

৬৫ বছর বয়সী নুরজাহান বলেন, ‘আমার সন্তান নেই। একজন মেয়ে ছিল, সে মারা গেছে। স্বামী আছে, স্বামী মরে নাই। আমি অসুস্থ এ জন্য আমাকে আর দেখাশোনা করে না। আমি বেঁচে আছি, না মারা গেছি খোঁজও নেয় না।’

স্বামীর সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্বামী গার্মেন্টসে চাকরি করে। সে বিয়ে করেছে, তার নতুন বউ আছে। আমি যতদিন সুস্থ ছিলাম, স্বামী ততদিন দেখাশোনা করেছে। আমি চাকরি করেছি, টাকা-পয়সা নিয়ে স্বামী খেয়েছে। অসুস্থ হওয়ার পর আর আসেনি। দেখাশোনাও করেনি। যখন আমি ভালো ছিলাম, তখন জমিদারের বাড়িতে চাকরি-বাকরি করছি, খাইছি। অসুস্থ হয়ে গেলে তারা আর দেখতে পারেনি।’

কষ্টের কথা জানাতে গিয়ে নুরজাহান বলেন, ‘আমার স্বামী একবারও খোঁজ নেয়নি। একবারও ভাবেনি একটা মানুষের সঙ্গে সংসার করলাম, সে কেমন আছে একটু দেখি। একবার জিজ্ঞাসাও করেনি, দেখাও করেনি।’

নোয়াখালীতে জন্ম নেওয়া নুরজাহান বলেন, ‘চট্টগ্রামের যেখানে ছিলাম, ভাড়াটিয়ারা সবাই আদর করত, দেখত। আমার আগে একজন ভাই হয়েছিল। ভাইটা মারা গেছে। এখন আমি বেঁচে আছি। এখন রক্তের কোনো আত্মীয় নেই। আছে জ্যাঠাত ভাইবোন। তারা কোনো খোঁজখবর নেয় না। ওরা একদিনও দেখেনি আছি, না মরে গেছি। জ্যাঠারা তো জায়গা-সম্পদ যা ছিল, সব খেয়ে ফেলছে। মাকে ছোট থেকেই এরা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।’

বৃদ্ধাশ্রম ছেড়ে যাওয়ার জায়গা নেই জানিয়ে নুরজাহান বলেন, ‘এখন কেউ নেই, দেখবে কে? কই যাব? কার কাছে যাব? যাওয়ার জায়গা নেই। সবাই থাকলে যেতাম, দেখতাম।’

বৃদ্ধাশ্রমে অনেকের থেকে মায়ের আদর পান জানিয়ে এই অসহায় নারী বলেন, ‘বৃদ্ধাশ্রমে মিলন বাবা আছে, মিরাজ বাবা—ওরাই দেখাশোনা করে নিজের মায়ের মতো। আমিও ওদের সন্তানের মতো দেখি। ওরাই আমার বাবা-মা, ওরাই আমার ভাইবোন।’

‍নুরজাহান বলেন, ‘৬-৭ বছর ধরে আমি অসুস্থ। এখানে আসার পর থেকে ওরাই আদর করে। মা-বাপের কাছে যতটুকু ভালোবাসা না পাইছি, এখানে এসে সেই ভালোবাসা পেয়েছি।’

চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারের ম্যানেজার মিরাজ হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম থেকে নুরজাহানকে বৃদ্ধাশ্রমে আনা হয়েছে। তিনি এক বছরের বেশি সময় ধরে এখানে থাকছেন। তিনি ভালোভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। তার কোনো আত্মীয়-স্বজন খোঁজ নিতে আসে না। বৃদ্ধাশ্রমই এখন তার পরিবার হয়ে গেছে।

এম ইউ

Back to top button