ইসলাম

সত্যবাদিতা : একটি মহৎ মানবিক গুণ

সত্যবাদিতা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের নিকট একটি প্রিয় ও কাঙ্ক্ষিত গুণ। পক্ষান্তরে অসত্য ও মিথ্যাবাদিতা ঘৃণিত সবার কাছে। সত্য-মিথ্যা প্রিয়-অপ্রিয় হওয়ার ক্ষেত্রে সকল জাতিই একমত। সত্যাবাদিতার গুণটি তাই স্বভাবতই অধিক গুরুত্বপূর্ণ ইসলাম ধর্মে। এ জন্য দেখা যায় ইসলামের নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বেই `আল-আমিন` তথা সত্যবাদী উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। নবুয়ত প্রাপ্তির পরে তাঁর সত্যনিষ্ঠতার কথা তো বলাই বাহুল্য। নবিজীবন প্রকৃত সততার উজ্জ্বল প্রমাণ।

যখন মক্কা বিজয় হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাফেরদের কতিপয় বড় বড় নেতার হত্যার পরোয়ানা জারি করলেন। তাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে আবু সারাহ ছিল অন্যতম। সে মুরতাদ হওয়ার পূর্বে ওহি লেখক ছিল। সে গা ঢাকা দিয়ে তার নিকটাত্মীয় উসমান (রা) এর নিকট এল। বলল, আমার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট সুপারিশ করুন, যাতে মুসলমানগণ আমাকে হত্যা না করে।

উসমান (রা) অনতিবিলম্বে তাকে নিয়ে রওয়ানা হলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে যে সাহাবির সঙ্গেই সাক্ষাৎ হল প্রত্যেকেই তাকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন। কিন্তু উসমান (রা) অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে জানালেন, তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে। অতঃপর যখন সে উসমান (রা) এর পিছনে পিছনে কম্পিত পদক্ষেপে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে পৌঁছল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দিকে তাকিয়ে বললেন, উসমান! লোকটি কে? উসমান (রা) উত্তর দিলেন, `আব্দুল্লাহ বিন আবু সারাহ। সে তাওবা করে আপনার দরবারে উপস্থিত হয়েছে। সে আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।` নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চুপ হয়ে গেলেন। মজলিস নীরব নিস্তব্ধ। কারো মুখে কথা নেই।

উসমান (রা) আবার বলে উঠলেন, `হে আল্লাহর রাসূল, ইবনে আবু সারাহ তাওবা করে আপনার নিকট ফিরে এসেছে।` এবারও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নীরব। পরিস্থিতি দেখে লোকটি ভয়ে-শঙ্কায় তটস্থ হয়ে উঠল। উসমান (রা) তৃতীয়বার একই কথা বললেন, এবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, `আমরা তার নিরাপত্তা দিলাম।`
ইবনে আবু সারাহ উসমান (রা) সহ বের হয়ে যাওয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবিদের দিকে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে বললেন, আমরা তাকে নিরাপত্তা দেয়ার পূর্বে তোমাদের কেউ কি তলোয়ার দিয়ে তাকে দ্বিখণ্ডিত করতে পারলে না ? জবাবে তারা বললেন, আমরা বুঝতে পারিনি আপনার এমন অভিপ্রায় ছিল। আপনি যদি আমাদের দিকে চোখে ইশারা করতেন, তবুও হত। নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাব দিলেন, `কোনোরূপ চোখের খেয়ানত করা নবীর জন্য শোভা পায় না।`

এ থেকে বোঝা যায় তিনি মিথ্যা থেকে কতটা দূরত্ব অবলম্বন করতেন। মিথ্যা তাঁর কাছে কতটা ঘৃণিত ছিল। অসত্য বলা তো দূরের কথা শুধু চোখের ইশারাকেও তিনি গণ্য করেছেন সত্যের ওপর কালিমা লেপন হিসেবে। কারণ মিথ্যার ইশারাই সরাসরি মিথ্যার দুয়ারে নিয়ে যায়। চোখে ইশারা যদি এত গুরুতর হয় তাহলে ভাষায় মিথ্যা ব্যক্ত করা কতটুকু অপরাধ ? সঙ্গে মিথ্যা কসম করলে তো আর বলার অপেক্ষাই রাখে না।

যেসব দুর্বল ব্যক্তি সরাসরি কোনো কথা সাহসিকতার সঙ্গে বলতে পারে না তারাই কেবল মিথ্যা ও খোশামুদের আশ্রয় গ্রহণ করে। রাসূল কিন্তু কখনও এমনটি করেন নি। মিথ্যাবাদী মানুষের মাঝে অপমানিত হওয়ার পূর্বে নিজে নিজেই অপমানবোধ করে। কারণ, মিথ্যার অপর নাম অপমান। নিম্নরুচির লোকেরাই কেবল মিথ্যা বলতে ও মিথ্যা বলার অভ্যাস গড়তে পারে। মুমিন ব্যক্তির আকিদা হবে পরিচ্ছন্ন। চরিত্র হবে নির্মল। সে কখনও মিথ্যা বলবে না। আশ্রয় নেবে না অসত্যের।

একবার কেউ মিথ্যা বললে, বার বার বলতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। তখন মিথ্যাই তার চরিত্র হয়ে দাঁড়ায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, `মানুষ সর্বদা মিথ্যা বলতে থাকলে আল্লাহ তাআলার নিকট তাকে কাযযাব তথা মিথ্যাবাদী নামে আখ্যা দেয়া হয়।`

মিথ্যার আপদ

কোনো ব্যক্তি মিথ্যা প্রচার করলে তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে যত লোক উক্ত মিথ্যার মাধ্যমে ধোঁকায় পড়বে সকলের গুনাহের বোঝা সে বহন করবে।

মিথ্যা সাধারণত দ্রুত ছড়িয়ে পরে। দীর্ঘ দিন গোপন থাকে না। যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বা কাজের মাধ্যমে আজ কোনো স্বার্থ উদ্ধার করছে অথবা কোনো ক্ষতি থেকে বাঁচতে চাইছে, অচিরেই সে মিথ্যা প্রকাশ পাওয়ার মাধ্যমে আরো বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে, বন্ধু হারিয়ে ফেলবে বা চাকরি চলে যাবে। অতএব বলতে হবে, সত্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট এবং শান্তিময়। অপরদিকে মিথ্যা বড্ড ঘোলাটে এবং অশান্তিময়।

মিথ্যার স্তর

মিথ্যার স্তর কয়েকটি। সবচেয়ে ভয়ানক ও নিকৃষ্টতম স্তর হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ওপর মিথ্যারোপ করা। ইরশাদ হয়েছ : ‘`তারা (কাফেররা) জেনে শুনে আল্লাহর ওপর মিথ্যারোপ করছে।`

নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমার ওপর মিথ্যারোপ করা অন্য কারো ওপর মিথ্যারোপ করার মত নয়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওপর মিথ্যারোপ করার ধরন হল, এমন কোনো কথা ও কাজকে তাঁর দিকে সম্পর্কিত করা যা তিনি বলেন নি অথবা করেন নি। আর এরই নাম হাদিসে মাওযু বা বানানো হাদিস। এ ব্যাপারে কঠোরতা করতে গিয়ে কতিপয় আলেম বলেন, ভুল-শুদ্ধ যাচাই করা ব্যতীত কোনো হাদিস সংকলন ও প্রচার-প্রসার করাও এক ধরনের মিথ্যারোপ।

মিথ্যার দ্বিতীয় স্তর

মিথ্যার মাধ্যমে অন্যায়-অন্যায্য কিছু অর্জন করা। অথবা কারো হক নষ্ট করা। যেমন মিথ্যা সাক্ষী দেয়া। এটা কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, `সাবধান মিথ্যা সাক্ষী দিও না।`

তেমনি মিথ্যা কসম করে অন্য ভাইয়ের হক নষ্ট করা। এর শাস্তি স্বরূপ তাকে জাহান্নামের অগ্নিতে দাহ করা হবে।

এমনিভাবে মিথ্যার মাধ্যমে কোনো এতিম মিসকিনের হক নষ্ট করা অথবা কারো ক্ষতি করা। যেমন, মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে কাউকে জেলখানায় ঢুকিয়ে দেয়া।

যে মিথ্যা মিথ্যা নয়

এমন কিছু ক্ষেত্র আছে যেখানে মিথ্যা বললে মিথ্যা বলে গন্য হয় না। নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- যে মিথ্যার মাধ্যমে মানুষের ঝগড়ার মীমাংসা হয় সেটা মিথ্যা নয়। হাদিসে আছে :
`মানুষের মাঝে বিবাদ মেটাতে গিয়ে অবাস্তব বললে সে মিথ্যাবাদী হবে না।` [ আলবানি: সহিহুল আদাবিল মুফরাদ: ২৯৭]

এর ওপর ভিত্তি করে উলামায়ে কেরাম বলেন, কোনো শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য মিথ্যা বললে সেটা মিথ্যা বলে গণ্য হবে না।

অনুরূপভাবে স্ত্রীর নিকট স্বামী প্রিয় হয়ে উঠবে এমন বিষয়ে মিথ্যা বলা যাবে। যেমন তার সৌন্দর্য, গুণ, পোশাক ও খাদ্যের প্রশংসা করা ইত্যাদি।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সত্য বলা ও মিথ্যা পরিহার করার তাওফিক দান করুন।

এন এইচ, ০৯ অক্টোবর

Back to top button