জাতীয়

বাণিজ্য ঘাটতির প্রভাব ডলারের বাজারে

মানিক মুনতাসির

ঢাকা, ০৭ জুলাই – দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ৫০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে ৫২ বিলিয়নে পৌঁছেছে। যদিও রপ্তানি আয় নিয়েও ছিল নানা শঙ্কা। এর পরও করোনা মহামারির প্রভাব কাটিয়ে রপ্তানি আয় একটা মাইলফলক অতিক্রম করেছে। এদিকে দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসা করোনা মহামারির আঘাতে প্রবাসী আয়ে যতটা ধাক্কা আসবে বলে ধারণা করা হয়েছিল তা আসেনি। তবে ফিরে আসা প্রবাসী বাংলাদেশিদের সবাইকে কর্মস্থলে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। দুই বছর আগে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড গড়েছিল। কিন্তু শুধু আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এবং রপ্তানি খাতের বহুমুখীকরণ ও রপ্তানির নতুন বাজার উদ্ঘাটন করতে না পারায় বাণিজ্য ঘাটতিতে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। সোজা কথা, যে পরিমাণ ডলার ব্যয় হিসেবে বিদেশে যাচ্ছে, এর প্রায় অর্ধেক পরিমাণ বিদেশ থেকে আয় হিসেবে আসছে। ফলে ডলারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, যার চাপ পড়ছে ডলারের বাজারে। ফলে ডলারের দাম বাড়ছে অব্যাহতভাবে। টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকানো যাচ্ছে না কোনোভাবেই। সর্বশেষ ২১ জুন টাকার মান কমানোর পর প্রতি ডলার ৯২ টাকা ৯০ পয়সা দরে বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সোমবার ডলারের দর ছিল ৯২ টাকা ৮০ পয়সা। অন্যদিকে খোলাবাজারে এখনো ৯৪-৯৫ টাকা।

এদিকে মে মাসে ডলারের দাম বেড়ে খোলাবাজারে ১০২ টাকা অতিক্রম করে রেকর্ড গড়েছিল। পরে কিছুটা কমে বর্তমানে খোলাবাজারে ৯৭ থেকে ৯৯ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে। সোমবার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, মে-২০২২ শেষে দেশে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩১ বিলিয়ন ডলার, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ। অর্থবছর শেষে এ ঘাটতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়েও নানা শঙ্কা কাজ করছে সরকারের মধ্যে। বিশাল পরিমাণ এ বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে না পারলে সামনের দিনগুলোয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর আরও চাপ বাড়বে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে হলে রপ্তানি বাড়াতে হবে। রপ্তানির বাজারকে বহুমুখীকরণ করতে হবে।’ প্রয়োজনে রপ্তানি খাতে আরও প্রণোদনা দেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সদ্য বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের মে পর্যন্ত ১১ মাসে রপ্তানির চেয়ে আমদানির পরিমাণ অনেক বেশি হওয়ায় এবং রেমিট্যান্সে নেতিবাচক ধারা বজায় থাকায় বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ৩০ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ঘাটতি বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ (১০ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার)। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২০ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। এর প্রভাবে দেশের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের ঘাটতিও ১৭ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। এক মাস আগেও এপ্রিল শেষে যা ছিল ১৫ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। আর গত বছরের মে থেকে এক বছরের ব্যবধানে চলতি হিসাবের এ ঘাটতি ছয় গুণের বেশি বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের মে মাসে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার।

খাদ্যপণ্য, জ্বালানিসহ অন্যান্য জিনিসপত্র আমদানিতেও রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। কেননা সব ধরনের আমদানিপণ্যের দাম বেড়েছে। এখনো বাড়ছে। সদ্য সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরের মে পর্যন্ত ১১ মাসে আমদানি খাতে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৭৫ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। এতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৯ শতাংশ। অন্যদিকে মে-২০২২ শেষে রপ্তানি আয় এসেছে ৪৪ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের মে মাসের তুলনায় বেড়েছে ৩২ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এটাও রেকর্ড। তবু বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়েছে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা দেশের ইতিহাসের অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই ডলার সংকট বেড়েছে এটা সত্যি। বাংলাদেশে অবশ্য সংকট একটু বেশিই। এর অনেক কারণও রয়েছে। আবার সরকার অনেক পদক্ষেপও নিয়েছে। যেমন বিলাসী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহকরণ, বিদেশ ভ্রমণ বাতিল ইত্যাদি। এগুলোর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।’ কিন্তু এর জন্য কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

সূত্র : বিডি প্রতিদিন
এম এস, ০৭ জুলাই

Back to top button