জাতীয়

নতুন অর্থবছরের শুরু থেকেই কৃচ্ছ্রসাধনে যাচ্ছে সরকার

মেসবাহুল হক

ঢাকা, ০৪ জুলাই – নতুন অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। গত শুক্রবার চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট বাস্তবায়ন শুরু হয়। নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহামারী পরিস্থিতি থেকে ঠিক যখন বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, ঠিক সে সময়ই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধ গোটা বিশ্বের অর্থনীতির ওপর গভীর প্রভাব রেখেছে। বেড়েছে দ্রব্যের দাম, দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক মন্দা। বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতি যেন দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব না ফেলে তাই চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন নীতি গ্রহণ করেছে সরকার।

কৃচ্ছ্রসাধনের অংশ হিসেবে এ অর্থবছরের শুরু থেকেই সরকারি প্রতিষ্ঠানে নতুন বা প্রতিস্থাপক হিসেবে সব ধরনের যানবাহন কেনা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আপ্যায়ন, ভ্রমণ ও প্রশিক্ষণ ব্যয়ের ক্ষেত্রে বরাদ্দকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ব্যয় করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া উন্নয়ন প্রকল্পের বিভিন্ন কমিটির সম্মানী স্থগিত করা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) নিম্ন অগ্রাধিকার প্রকল্পে আপাতত অর্থছাড় স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অর্থ বিভাগ থেকে গতকাল এ-সংক্রান্ত তিনটি আলাদা পরিপত্র জারি করা হয়।

সব ধরনের যানবাহন ক্রয় স্থগিতসংক্রান্ত পরিপত্রে বলা হয়, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের লক্ষ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছর সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটে কতিপয় খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ে সরকার কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে নতুন অথবা প্রতিস্থাপক হিসেবে সব ধরনের যানবাহন ক্রয় (মোটরযান, জলযান, আকাশযান) বন্ধ রাখা। শুধু জরুরি ও অপরিহার্য ক্ষেত্র বিবেচনায় আপ্যায়ন ব্যয়, ভ্রমণ ব্যয়, অন্যান্য মনিহারি, কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ও আসবাব খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ব্যয় করা যাবে।

দেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ খাতে (প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ব্যতীত) বরাদ্দকৃত অর্থের ৫০ শতাংশ ব্যয় করা যাবে বলেও পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়। এসব বরাদ্দকৃত অর্থ অন্য কোনো খাতে পুনরুপযোজন বা স্থানান্তর করা যাবে না। এছাড়া অনিবার্য কারণ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞাও বহাল রয়েছে।

এছাড়া সীমিত সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের এডিপির প্রকল্পগুলোর তিন ধরনের অগ্রাধিকার ঠিক করা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোকে ‘এ’ ক্যাটাগরি, তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পকে ‘বি’ ক্যাটাগরি এবং কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পকে ‘সি’ ক্যাটাগরির প্রকল্প হিসেবে নির্ধারণ করেছে সরকার। এডিপির ‘সি’ ক্যাটাগরির প্রকল্পে আপাতত অর্থছাড় স্থগিত করে আলাদা পরিপত্র জারি করা হয়েছে।

এ পরিপত্রে বলা হয়, মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোর ‘এ’ ক্যাটাগরি হিসেবে চিহ্নিত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকবে। ‘বি’ ক্যাটাগরি প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন অংশের ২৫ শতাংশ সংরক্ষিত রেখে অনূর্ধ্ব-৭৫ শতাংশ ব্যয় করা যাবে। আর ‘সি’ ক্যাটাগরির প্রকল্পগুলোর অর্থছাড় আপাতত স্থগিত থাকবে। তবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলো প্রয়োজন অনুসারে ‘সি’ ক্যাটাগরির প্রকল্পগুলোয় বরাদ্দকৃত অর্থ পুনরুপযোজনের মাধ্যমে ‘এ’ ক্যাটাগরির প্রকল্পগুলোয় ব্যয় করতে পারবে। এর জন্য আগে থেকে পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থ বিভাগের অনুমতি নিতে হবে।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকার এডিপি নেয়া হয়েছে। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বাজেটের আগে থেকেই এডিপির প্রকল্পের অগ্রাধিকার নির্ধারণের কাজ চলছে। প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের কাছে তাদের বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের মধ্যে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী মন্ত্রণালয়গুলো প্রকল্প বাছাই করেছে। যেসব প্রকল্প শেষ হতে সামান্য বাকি রয়েছে এবং যেসব প্রকল্পের সঙ্গে কর্মসংস্থান, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, মানবসম্পদ উন্নয়নের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে, সেগুলো ‘এ’ ক্যাটাগরি বা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেয়েছে।

এদিকে উন্নয়ন প্রকল্পের বিভিন্ন কমিটির সম্মানী বাবদ ব্যয় স্থগিত করে আরো একটি পরিপত্র জারি করেছে অর্থ বিভাগ। গতকাল জারি করা পরিপত্রে বলা হয়, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের লক্ষ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ, রাষ্ট্রায়ত্ত, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন বাজেট ও নিজস্ব তহবিলের আওতায় বাস্তবায়নাধীন সব প্রকল্প/কর্মসূচি/স্কিমের ক্ষেত্রে ‘৩২৫৭২০৬-সম্মানী’ অর্থনৈতিক কোডের বরাদ্দ থেকে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি), প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটি (পিএসসি), বিভাগীয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (ডিপিইসি), বিশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (এসপিইসি) এবং বিভাগীয় বিশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (ডিএসপিইসি) সভায় সম্মানী বাবদ কোনো অর্থ ব্যয় করা যাবে না।

সরকারের এসব সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশে গাড়ি কেনাসহ বিভিন্ন বৈঠকের সম্মানীর নামে অপব্যয় করা হয়। তাই শুধু বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্র্রেক্ষিতে নয় বরং স্থায়ীভাবে এসব খাতে বরাদ্দ কমানো উচিত।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির অবস্থা যা-ই হোক না কেন, কিছু সিদ্ধান্ত এমনিতেই নেয়া প্রয়োজন। কারণ আমাদের দেশে বেশকিছু অপব্যয় হয়। বিশেষ করে গাড়ি কেনাসহ বিভিন্ন বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের সম্মানী দেয়া হয়, যেগুলোর আসলে কোনো প্রয়োজন নেই। সুতরাং সরকারের এসব সিদ্ধান্তকে আমি সাধুবাদ জানাই। তাছাড়া আমাদের দেশে গুরুত্ব বিবেচনা না করে অনেক বেশি প্রকল্প নেয়া হয়, এতে প্রতিটি প্রকল্পে অল্প অল্প বরাদ্দ দেয়া যায়। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়ে বাড়ে, সেই সঙ্গে ব্যয়ও বাড়ে। তাই এক্ষেত্রে গুরুত্ব বিবেচনায় উচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোয় বরাদ্দ বাড়িয়ে যদি সঠিক সময় বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে সেটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য ভালো হবে।

সূত্র : বণিক বার্তা
এম এস, ০৪ জুলাই

Back to top button