জাতীয়

খুলছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু, আসছে অত্যাধুনিক লঞ্চ

সালেহ টিটু

বরিশাল, ২১ জুন – আগামী ২৫ জুন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। সেতু চালু হলে দক্ষিণের ২১ জেলার চেহারা বদলে যাবে। সড়ক পথে উঠবে গতির ঝড়। দক্ষিণের বিভিন্ন জেলার মানুষেরা এখন বাড়ি থেকে ঢাকায় গিয়ে অফিস করারও চিন্তা করছেন। এ অবস্থায় সড়ক পথের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে বরিশাল-ঢাকা নৌরুটে চলাচলকারী লঞ্চগুলোতেও লাগছে আধুনিকতার ছোঁয়া। যাত্রী টানতে নতুন ও অত্যাধুনিক লঞ্চ নামাচ্ছেন মালিকরা। এসব লঞ্চে লিফট, চলন্ত সিঁড়ি, এটিএম বুথ, হেলিপ্যাড, সুইমিং পুল, নামাজের কক্ষ, ডাইনিং, শিশুদের খেলার জোন, রেস্টুরেন্ট, ব্রেস্টফিডিং রুম ও রোগীদের জন্য আইসিইউ সুবিধা যুক্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মালিকরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বরিশাল-ঢাকা নৌরুটে যাত্রীবহরে যুক্ত হতে পাঁচ মাস আগে কীর্তনখোলা নদীর তীরে শুরু হয়েছে অত্যাধুনিক বিলাসবহুল এম খান-৭ লঞ্চের নির্মাণকাজ। কিছু দিন পর একই ডকইয়ার্ডে এম খান-১১ লঞ্চের কাজও শুরু হবে।

এম খান লঞ্চের পরিচালক প্রকৌশলী রাফি খান বলেন, পদ্মা সেতু খুলে দেওয়া হলেও লঞ্চে যাত্রীর সংকট হবে না। এর প্রধান কারণ, বেশ কয়েকজন একসঙ্গে আরামে কেবল লঞ্চেই চলাচল করতে পারে। এছাড়া ওয়াশরুম, ক্যান্টিন থেকে শুরু করে যাত্রীসেবার বিভিন্ন উপকরণ একসঙ্গে কেবল লঞ্চেই পাওয়া যায়। এছাড়া যাত্রীরা যে টাকায় বরিশাল থেকে ঢাকা এবং ঢাকা থেকে বরিশালে আসবে, ওই টাকায় সড়কপথে আসা-যাওয়া সম্ভব না। পাশাপাশি সড়ক পথের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে লঞ্চগুলোতে সর্বাধিক স্পিডি ইঞ্জিন বসানোর কাজও চলছে বলে জানান তিনি।

এদিকে কীর্তনখোলা নদীর তীরে দেশীয় প্রযুক্তিতে চলছে সুন্দরবন-১৫ লঞ্চের নির্মাণকাজ। ৩০০ ফুট লম্বা এবং ৫২ ফুট চওড়া লঞ্চটিতে বিভিন্ন ধরনের কেবিন ছাড়াও যাত্রী সেবায় অনেক কিছুই সংযোজন করা হয়েছে। তবে তা গোপন রেখেছে কর্তৃপক্ষ। আগামী ঈদুল আজহায় লঞ্চটি যাত্রীবহরে যুক্ত হবে।

লঞ্চের পরিচালক শহিদুর রহমান পিন্টু বলেন, লঞ্চটিতে কেবিনের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। লঞ্চে সিঙ্গেল কেবিন ১০০টি, ডাবল ৭০টি, ফ্যামিলি ১০টি, সেমি ভিআইপি ১০টি, ভিআইপি ৬টি এবং সোফা সিট থাকছে ৫০টি। এবার কেবিন ব্লকে নতুন সংযোজন হয়েছে এক্সেল কেবিন। এই কেবিনে দুটি ডাবল খাট থাকবে। যেখানে একটি পরিবার আরামে ভ্রমণ করতে পারবেন। সব কেবিনে থাকছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও স্মার্ট টিভি।

এছাড়া লঞ্চে একাধিক ক্যান্টিন থেকে শুরু করে শিশুদের খেলার জোন, ডাইনিংয়ের ব্যবস্থা, রোগীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা, লিফট, ওয়াইফাই জোন, খোলা বারান্দা এবং যাত্রীদের জন্য বেশি করে টয়লেটের সুবিধা রাখা হয়েছে। লঞ্চে গতি বাড়াতে ইঞ্জিনে আনা হয়েছে পরিবর্তন।

তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতু থেকে যানবাহন চলাচল শুরু হলে সেক্ষেত্রে লঞ্চেও যাত্রীদের জন্য সুবিধা বাড়ানো হবে। বিশেষ করে যারা একদিনে কাজ সেরে আবার চলে আসতে চান তাদের কোনও হোটেল ভাড়ার প্রয়োজন হবে না। লঞ্চ থেকে গোসল ও নাস্তা করে কাজে বের হবেন, সন্ধ্যায় আবার লঞ্চে ফিরে আসবেন।

সুরভী লঞ্চের পরিচালক রেজিন উল কবির বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর অল্প সময়ে রাজধানী ঢাকায় যেতে অনেকেই যাত্রীবাহী বাস বেছে নেবেন। তবে সড়ক ও নদীপথের যাত্রায় ভিন্নতা রয়েছে। বিশেষ করে রাত ৯টায় ছেড়ে যাওয়া লঞ্চগুলো রাত ৩টার দিকেই সদরঘাটে ভিড়ছে। অত্যাধুনিক লঞ্চ চালু হলে এই সময় আরও কমে আসবে। এছাড়া ডিজিটাল যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে লঞ্চে থাকছে লিফট থেকে শুরু করে ওয়াইফাই জোন, স্মার্ট টিভি, শিশুদের খেলার জোন, নামাজের স্থান, সুপরিসর বারিন্দা এবং খাবারের জন্য বিভিন্ন ধরনের রেস্টুরেন্টসহ একাধিক অত্যাধুনিক ব্যবস্থা। ভিআইপি, সেমি-ভিআইপি, সৌখিন, সিঙ্গেল, ডাবল কেবিন এবং সোফা সিটের মাধ্যমে যাত্রীসেবা আরও আধুনিক করা হচ্ছে।

কীর্তনখোলা-২ লঞ্চের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আহসান ফেরদৌস বলেন, লঞ্চের সংস্কার শেষে কাঠ, টাইলস, উন্নতমানের কাচ, ইস্পাতের সমন্বয়ে দৃষ্টিনন্দন রূপ নেবে লঞ্চটি। লঞ্চের সিঁড়িতে ব্যবহার করা টাইলস স্পেন থেকে আনা হয়েছে। দোতলা ও তিনতলার প্রথম শ্রেণির জন্য রয়েছে আলাদা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। ভিআইপি জোনের পরিধি বড় করা হয়েছে। এছাড়াও বড় করা হয়েছে ভিআইপি জোনের ডাইনিংয়ের স্থান। সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে বিশ্বমানের আসবাবপত্র। লঞ্চে ব্যবহৃত দরজা চায়না থেকে আনা হয়েছে। লঞ্চের আগের শক্তিশালী ইঞ্জিনটিকে আরও উন্নত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। লঞ্চে রয়েছে ৬২টি সিঙ্গেল কেবিন, ৭০টি ডাবল কেবিন, ৬টি বিজনেস ক্লাস, ৬টি ভিআইপি, ফ্যামিলি ভিআইপি ৪টি এবং ২টি ডিলাক্স কেবিন।

অ্যাডভেঞ্চার লঞ্চের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজাম উদ্দিন বলেন, বরিশাল-ঢাকা নৌ রুটে চলাচলকারী লঞ্চগুলোকে আরও আধুনিক ও দ্রুতগতির করতে কাজ চলছে। এতে যাত্রীরা নদীপথে চলাচলে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন। এ কারণে পদ্মা সেতু চালু হলেও লঞ্চের যাত্রী কমবে না বলে দাবি করেন তিনি।

তিনি জানান, বিশালাকার লঞ্চের দুই প্রান্তে দুটি সিঁড়ি করা হয়েছে। এছাড়া সিঙ্গেল, ডাবল ও ভিআইপিসহ ১৩০টি কেবিন রয়েছে। কেবিনের ভেতর ডেকোরেশনেও আনা হয়েছে পরিবর্তন।

এছাড়া মানামী এবং প্রিন্স অব আওলাদ কোম্পানির নতুন দুটি লঞ্চের নির্মাণকাজও চলছে ঢাকায়। তবে এক্ষেত্রে সবাই তাদের আধুনিকতার বিষয়টি গোপন রাখছেন।

নৌপরিবহন যাত্রী স্বার্থ সংরক্ষণ পরিষদের সদস্য সচিব অধ্যাপক মহসিন উল ইসলাম হাবুল বলেন, শুধু আধুনিকতার প্রতিযোগিতা থাকলেই চলবে না। লঞ্চে যাত্রী টানতে মালিকদের যাত্রীসেবার মান আরও বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।

কেন্দ্রীয় লঞ্চ মালিক সমিতির সহ-সভাপতি ও সুন্দরবন লঞ্চ কোম্পানির চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, সারা বছর নৌপথ ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে সচল রাখা হলে ব্যবসা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক যাত্রীবাহী লঞ্চ নামানো সম্ভব হবে। তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলেও লঞ্চের যাত্রীদের ওপর তার তেমন প্রভাব পড়বে না। এর প্রধান তিনটি কারণ হলো, নিরাপত্তা, আরামদায়ক যাত্রা ও স্বল্প খরচ।

তিনি আরও জানান, সড়ক পথের সঙ্গে পাল্লা দিতে গত ৮ বছরের ব্যবধানে বরিশালের চারটি ডকইয়ার্ডে নির্মিত সুন্দরবন কোম্পানির ৮টি, সুরভীর ৪টি, কীর্তনখোলার ২টি এবং অ্যাডভেঞ্চার কোম্পানির ২টি অত্যাধুনিক বিলাসবহুল লঞ্চ যাত্রীবহরে যুক্ত হয়েছে। এই রুটে এবার আরও আধুনিক লঞ্চ যুক্ত হবে।

সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন
এম এস, ২১ জুন

Back to top button