সিলেটসুনামগঞ্জ

চারিদিকে পানি আর পানি, কিন্তু খাওয়ার জন্য নেই এক ফোঁটাও

সিলেট, ১৯ জুন – শত বছরের ভয়াবহ বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় চলছে মানবিক বিপর্যয়। ঘরে-ঘরে এখন খাবার ও পানির‍ জন্য হাহাকার। পানিতেই ভাসছে মানুষ, তবু পান করার জন্য এক ফোঁটাও পানি নেই তাদের।

নলকূপসহ সুপেয় পানির সব উৎস বন্যায় নষ্ট হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে নোংরা পানি কোনো রকমে পান করতে হচ্ছে তাদের। খাবার সংকটও দিন দিন তীব্র হচ্ছে। ঘরে থাকা শুকনো খাবার শেষ হয়ে গেছে প্রায়। এখন কেবল ত্রাণের অপেক্ষা।

সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত থাকলেও তা চাহিদার তুলনায় সামান্যই।

মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সিলেটে আসবেন বলে জানিয়েছেন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ড. মুহম্মদ মোশাররফ হোসেন।

প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী। তাদের উদ্ধার ও পর্যাপ্ত খাবার পৌঁছে দেওয়া সত্যিই কঠিন চ্যালেঞ্জ।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান জানিয়েছেন, জলযান সংকটের কারণে অনেক এলাকায় উদ্ধারকাজ ও ত্রাণ বিতরণ ব্যাহত হচ্ছে। ভয়াবহ এই দুর্যোগ মোকাবিলায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবিসহ সরকারের সব সংস্থা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ রবিবার সিলেটে বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরণ করেছেন।

সিলেট নগরীর কিছু এলাকায় রবিবার পানি কিছুটা কমলেও বেশিরভাগ এলাকা এখনও প্লাবিত। এসব বাসা-বাড়ির লোকজন অবর্ণনীয় দুর্ভোগে রয়েছেন। অনেকে নগরীর আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে উঠলেও সেখানে গাদাগাদি করে দুর্বিসহ সময় কাটছে। আছে খাবারের সংকটও।

জেলার সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ। এছাড়া সিলেট সদর, বিশ্বনাথ, বালাগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জসহ সব উপজেলা এখন বন্যাকবলিত।

সুনামগঞ্জ পৌরশহর এখনও ৪ থেকে ৬ ফুট পানির নিচে। সুনামগঞ্জ জেলার প্রায় শতভাগ এলাকা বিপর্যস্ত। চারদিন ধরে সারাদেশের সঙ্গে সুনামগঞ্জের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বিদ্যুৎ নেই, মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কও কাজ করছে না। সুনামগঞ্জে হাসপাতাল, দোকানপাট, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক সব জায়গায় পানি আর পানি। নৌকা ছাড়া যাতায়াতের নেই কোনো সুযোগ। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে বানভাসি মানুষ।

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বিলাজুর গ্রামের এরশাদ মিয়া, আবদুল কাইয়ুম রবিবার বলেন, আমাদের ঘরবাড়ি এখনও পানিতে ডুবে আছে। পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে দিন যাচ্ছে, যা ছিল সবকিছু ভেসে গেছে। না খেয়েই দিন পার করছি। সাহায্য-সহযোগিতায় নিয়ে কেউ আসছে না।

গত ১০০ বছরেও এত পানি এলাকার কেউ দেখেনি বলে তারা জানান।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বর্নি, তেলিখাল, বিলাজুর, আঙ্গুরাকান্দি গ্রামের লোকজন জানিয়েছেন, রবিবার পর্যন্ত তাদের গ্রামগুলোতে কোনো প্রকার ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়নি। অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন কয়েকদিন ধরে। বন্যায় শেষ হয়ে গেছে তাদের ঘরবাড়ি, ধান, গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি। অনেকের ঘরবাড়ি রয়েছে পানির নিচে।

পানি কমার সঙ্গে এসব ঘরবাড়ি ভেঙে পড়বে বলে তারা জানান।

তখন শূন্য ভিটায় তাদের ফিরতে হবে।

সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যাদুর্গত মানুষ জানিয়েছেন, বানের পানি তাদেরকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। না খেয়েই তাদের দিন যাচ্ছে। মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে দুর্গত এলাকায়।

বেশিরভাগ মানুষই দাবি করছেন, তারা কোনো ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছেন না। কেউ খোঁজও নিচ্ছে না।

সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর গ্রামের আবুল হোসেন জানান, ৩ দিন ধরে তার ঘরে পানি। পরিবারের নারী-শিশুদের অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। ঘরের মধ্যে মাচা তৈরি করে সেখানে ধান তুলে রেখেছেন। পানি আর কয়েক ইঞ্চি বাড়লেই ধানও ভিজে যাবে। তবে রবিবার বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় পানি আর বাড়েনি।

কিছু এলাকায় পানি কমছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে সিলেট নগরীর সোবহানীঘাট, যতরপুর, উপশহর, মেন্দিবাগ, শিবগঞ্জ, মেজরটিলা, সাদাটিকর, তেরোরতন, মাছিমপুর, ছড়ারপাড়, কালীঘাট, তালতলা, জামতলা, মাছুদিঘীরপাড়, লামাপাড়, বেতেরবাজার, ঘাসিটুলা, বাগবাড়ি, শেখঘাট, টিকরপাড়া, কুয়ারপার, কাজিরবাজারসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাট, বাসাবাড়ি ও দোকানপাটে এখনও বন্যার পানি।

সিলেট জেলা শহরের সঙ্গে সদর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ ও জকিগঞ্জ উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। প্লাবিত এলাকার একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়েছে পানি। এর আগে গত ১৫ মে থেকে সিলেট নগরী ও ১৩ উপজেলায় টানা বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে বন্যা হয়েছিল। ওই বন্যায় প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানায় জেলা প্রশাসন।

সূত্র: দেশ রূপান্তর
এম ইউ/১৯ জুন ২০২২

Back to top button