মুক্তমঞ্চ

ক্ষমতার লোভ বড় ভয়ংকর

তসলিমা নাসরিন

আফ্রিকা আর এশিয়ার কিছু দেশে এসব ঘটে। রাষ্ট্রক্ষমতা যাঁদের হাতে, তাঁরা আজীবন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চান। একবার ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে গেলে সে স্বাদ অনন্তকাল পেতে চান। বাংলাদেশের মানুষ তো এমন প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্টের দেখা পেয়েছেন। সুতরাং ট্রাম্পের আচরণ তাদের কাছে খুব অচেনা ঠেকছে না। নভেম্বর ৩-এর নির্বাচনে বাইডেনের জয় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মেনে নিতে চাইছেন না। তাঁর ভাষ্য নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, কারচুপির কোনো প্রমাণ দেখাতে পারছেন না যদিও। সাধারণত আমেরিকায় ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে এমন অদ্ভুত নাটক হয় না। কিন্তু এবার হচ্ছে। ট্রাম্প ধীরে সুস্থে তাঁর পারিবারিক ব্যবসায় ফিরে যাবেন, সেটাই তো কাম্য। কিন্তু মুশকিল হলো ট্রাম্প হোয়াইট হাউজের পিলার ধরে আছেন শক্ত হাতে। কেউ কেউ বলছে, ট্রাম্প নাকি ২০২৪ এ ফের নির্বাচনে দাঁড়াবেন।

কী আছে এই ক্ষমতায়? এত হাস্যকর সব কীর্তি করার পর তাঁর তো মুখ আড়াল করে বিদেয় নেওয়ার কথা। রাজনীতিক না হয়েও, নারী নিয়ে চূড়ান্ত অশোভন উক্তি করার পরও তিনি ভোটে জিতেছেন, এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। আমেরিকার জনগণের ঘটে দু’ছটাক বুদ্ধি বেশি থাকলে ট্রাম্পকে নয়, হিলারিকেই জেতাতো। তাহলে চার বছর এক নার্সিসিস্টের অনাচার সহ্য করতে হতো না। এখন ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে বসে এমন ভাব করছেন যেন নির্বাচনে বাইডেন নয়, তিনিই জিতেছেন। প্রতিরক্ষা সেক্রেটারির চাকরি খেয়ে নিলেন। নিজের ভক্তকুলকে এনে এনে বসাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। আগামী বছরের বাজেটটাও দাবি করছেন। আরও আঁটঘাঁট হয়ে বসেছেন ওভাল অফিসের চেয়ারে।

রাজতন্ত্র বাদ দিচ্ছি, গণতন্ত্রের নামে কী হচ্ছে পৃথিবীতে? ২০ থেকে ৩০, এবং ৩০-এর চেয়েও বেশি বছর ধরে রাষ্ট্রের ক্ষমতা আঁকড়ে পড়ে আছেন নেতারা। কিছুতেই ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি নন। ক্যামেরুনের পল বিয়া, গিনির তিওডরো ম্বাসোগো, এঙ্গোলার হোসে এডুয়ারো ডস সানটস, জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবে, উগান্ডার ইওয়েরি মুসেভেনি, এরিত্রিয়ার ইসাইয়াস আফেরকি, গাম্বিয়ার ইয়াহিয়া জাম্মে, সুদানের ওমর আল-বসির, আলজেরিয়ার আবদেলাজিজ বোটেফ্লিকা, জিবুতির ইসমেইল ওমর গুয়েল্লে, গায়ানার সাম হিন্ডস, চাদের ইদ্রিস ডেবি-এঁরা অনন্তকাল ক্ষমতার স্বাদ পেতে চান। ইরানের আলি খামেনি, কম্বোডিয়ার হু সেন, কাজাখস্তানের নূরসুলতান নাজারবায়েভ, উজবেকিস্তানের ইসলাম কারিমভ-এরাঁও একই পথের অনুসারী। বেলারুসের আলেকজান্ডার লুকাসেঙ্কো, রাশিয়ার ভøাদিমির পুতিন, এঁরাও। এই সে দিন ২৭ বছর ধরে ক্ষমতায় বসে থাকা আফ্রিকার বুরকিনা ফাসোর শাসক ব্লেস কম্পাওরের বিরুদ্ধে বিরাট প্রতিবাদ মিছিল হলো। এই প্রতিবাদ শেষ পর্যন্ত কম্পাওরেকে ক্ষমতা থেকে নামাল।
ইউরোপে এসব ঘটতে দেখিনি। প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীরা গদি আঁকড়ে থাকেন না জীবন ভর। ইউরোপের কিছু মন্ত্রীকে দেখেছি নির্দ্বিধায় ক্ষমতা থেকে সরে গেছেন। এই নির্লোভ রাজনীতিকরাই নমস্য। সভ্য দেশে হেসে হেসেই বিজয়ীর হাতে পরাজিত শাসক দায়িত্বভার অর্পণ করেন। ট্রাম্প সভ্য দেশে জন্মেও চূড়ান্ত অসভ্য কী করে হলেন কে জানে। ট্রাম্পের আশেপাশে এবং গুণগ্রাহীদের মধ্যে অবশ্য অসভ্যের সংখ্যা নেহাত কম নয়।

আরও পড়ুন ::

ট্রাম্প আফ্রিকা এবং এশিয়ার সেইসব দুর্নীতিবাজ শাসকের মতোই এখন আচরণ করছেন। তাঁকেও কি হোয়াইট হাউজ থেকে টেনে বের করতে হবে? এর মধ্যেই রিপাবলিকান পার্টির অনেকেই বলেছেন নির্বাচনে কোনো কারচুপি হয়নি, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর আমেরিকার গণতন্ত্রে ঘটবে না, এ অবিশ্বাস্য। অবিশ্বাস্য ঘটনাটিই ঘটতে চলেছে। জানুয়ারির ২০ তারিখ থেকে নতুন প্রেসিডেন্ট তাঁর কাজ শুরু করবেন, কিন্তু ওভাল অফিস থেকে তো পুরনো প্রেসিডেন্টকে বেরোতে হবে। আফ্রিকা আর এশিয়ায় রাজনৈতিক মঞ্চে এসব নাটক চলে। আমেরিকায় চললে আমাদেরও অবাক লাগে। ক্ষমতার লোভ গরিব ধনী কারওর চেয়ে কারওর কম নয়। বিলিওনিয়ার ট্রাম্পের কাছেও টাকার চেয়ে ক্ষমতার দাম বেশি।

এই যে বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্র নেতাই অভিনন্দন জানালেন নির্বাচনে জিতে যাওয়া জো বাইডেনকে, তারপরও বখে যাওয়া শিশুর মতো টুইটারে চেঁচাচ্ছেন ট্রাম্প, আমরা জিতেছি, আমরা জিতব বলে। টুইটার কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছে জানুয়ারির ২০ তারিখ থেকে প্রেসিডেন্টের স্পেশাল নিরাপত্তা আর পাবেন না ট্রাম্প, যে কোনো এক্স ওয়াই জেড অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের মতোই তাঁকে ট্রিট করা হবে। শুনেছি মেলানিয়া নাকি চাইছেন ট্রাম্প পরাজয় মেনে নিয়ে বাইডেনের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন। কিন্তু ট্রাম্প কারও উপদেশ শুনতে চাইছেন না। এক সময় টেলিভিশনে তিনি রিয়ালিটি শো করতেন। পারিবারিক ব্যবসায় ফিরে যেতে না চাইলে অগত্যা টেলিভিশনেও ফিরতে পারেন। নাটক তিনি মন্দ করেন না।

কী কান্ডই না করেছেন ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকাকালীন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সারা বিশ্বে যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছে, তিনি ডাক্তারদের উপদেশ পায়ে মাড়িয়ে দিয়ে মানুষকে মাস্ক পরার বদলে না পরার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন। বর্ণবিদ্বেষী শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীর পক্ষ নিয়ে নিলেন কী সহজে। মেক্সিকোর সীমান্তে মেক্সিকোর টাকায় গড়তে চেয়েছেন দেওয়াল।

একবার মনে আছে তিনি হোয়াইট হাউজের নারীকর্মীদের বলেছিলেন, ড্রেস লাইক এ উওম্যান। মেয়েদের মতো পোশাক পরতে হবে সব মেয়েকে। আমি ভাবছিলাম মেয়েদের কোন পোশাককে মেয়েদের মতো পোশাক বলা যায়? মেয়েরা তো নভোচারীর, মিলিটারির, পুলিশের, শ্রমিকের, সাঁতারুর, কুস্তিগীরের, ফুটবলারের-সব পোশাকই পরে, এসবও তো মেয়েদের পোশাক। ট্রাম্প আসলে মেয়েদের মতো পোশাক পরা বলতে মেয়েরা যে পোশাক পরলে মেয়েদের যৌনবস্তু বলে মনে হয়, সে পোশাক পরতে বলছেন। জিন্স যদি পরেই মেয়েরা, তবে, বলে দিয়েছেন, যেন তাদের পরিচ্ছন্ন এবং ‘ঠিকঠাক’ দেখতে লাগে। ‘মিস আমেরিকা’ প্রতিযোগিতার মালিক ছিলেন ট্রাম্প। কী পোশাককে তিনি ‘মেয়েদের পোশাক’ বলে মনে করেন, তা আমরা অনুমান করতে পারি। তিনি কি পুরুষদের বলে দিয়েছেন, পুরুষের মতো পোশাক পরতে? বলেননি, কারণ পুরুষেরা পুরুষের মতোই পোশাক পরে।

‘মেয়েদের ধরতে হলে তাদের যৌনাঙ্গ খামচে ধরতে হয়। তাহলেই তুমি ওদের যা খুশি তাই করতে পার’… ট্রাম্প বলেছিলেন ২০০৫ সালে। এই নারীবিদ্বেষী ট্রাম্প এতকাল বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান পদ অধিকার করেছিলেন। আগে তো করেছেনই, প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনি আরও নারীবিদ্বেষী মন্তব্য করে গেছেন। তিনি নারীকে বিচার করেন নারী দেখতে কেমন তা দিয়ে। একবার তিনি এস্কোয়ার ম্যাগাজিনকে বলেছিলেন, “যদি তোমার একটা যুবতী আর সুন্দরী ‘পিস অফ অ্যাস’ থাকে তাহলে কারা তোমাকে নিয়ে কী লিখলো না লিখলো কিছু যায় আসে না’’। যে লোক মেয়েদের ‘শুয়োর, নোংরা, জঘন্য জন্তু’ বলেন, ‘যৌনাঙ্গ’ ছাড়া আর কিছু মনে করেন না মেয়েদের, তিনি কেন ওভাল অফিসে মেয়েরা হাই হিল আর স্কার্ট জাতীয় ‘মেয়েদের পোশাক’ পরে ঘোরাঘুরি করুক চাইবেন না? যে লোক ১৯৯৬ সালে আমেরিকার মিস আমেরিকা সুন্দরী প্রতিযোগিতায় বলেছিলেন, ‘বিকিনি আরও ছোট হতে হবে, হিল আরও উঁচু হতে হবে’, তিনি কেন চাইবেন না ওভাল অফিসেও মেয়েরা যৌনাবেদনময়ী হয়ে থাকুক। সুন্দরী প্রতিযোগিতার দিন ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আপনারা যদি কোনো রকেট সায়েন্টিস্টকে দেখতে চান, তাহলে আজ রাতে টিউন করবেন না, যদি সত্যিকারের সুন্দরীকে দেখতে চান, তবেই করবেন’। ট্রাম্প ধরেই নিয়েছেন যে মেয়েরা রকেট সায়েন্টিস্ট তারা সুন্দরী নয়। যে মেয়েরা গুণী সে মেয়েরা সুন্দরী নয়। মেয়েরা তাঁর কাছে নিতান্তই মুখ, বুক, পেট, নিতম্ব, যৌনাঙ্গ। মেয়েরা তাঁর কাছে নিতান্তই শরীর।

রিয়ালিটি টিভি শো করতেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি কি হোয়াইট হাউজে ‘দ্য রিয়্যাল হাউজওয়াইফ’ নামের রিয়ালিটি শো’র মতো শো চেয়েছিলেন, যে শো’তে মেয়েরা আসে সেজেগুজে শরীর দেখানো পোশাক পরে? ওরকম পোশাক যদি মেয়েরা পরতে চায় পরবে, কিন্তু পোশাক বিধি কেন থাকবে হোয়াইট হাউজে? মেয়েদের কেন তাদের শরীর আর পোশাক দিয়ে মাপা হবে হোয়াইট হাউজে, হোয়াইট হাউজ কি র‌্যাম্প নাকি যেখানে সুন্দরীদের কোমর বাঁকিয়ে হাঁটতে হবে? মেয়েদের তো মাপা উচিত তাদের কাজ দিয়ে। পুরুষদের মাপা হয় তাদের কাজ দিয়ে, কিন্তু মেয়েরা পুরুষ যা করতে পারে, মেয়েরাও তা পারে প্রমাণ করার পরও মেয়েদের শারীরিক সৌন্দর্যকে মেয়েদের একমাত্র পরিচয় করে তোলে নারীবিদ্বেষী লোকেরা। ঘরে তো বটেই, ঘরের বাইরে মেয়েদের যে নিষ্ঠা, দক্ষতা, সাফল্য-তা যেন কোনো ঘটনা নয়। নারীর গুণকে যারা তুচ্ছ করে, নারীর রূপকে নারীর একমাত্র পরিচয় বলে মনে করে-তাদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা সম্পর্কে আমরা জানি। তাদের আমরা শিক্ষিত করার চেষ্টা করি। কিন্তু তাদের মধ্যে একজন আমাদের চোখের সামনে ক্ষমতার শীর্ষে উঠে মানুষকে নষ্ট করতে চেয়েছেন, কথায়-বার্তায় আচার-আচরণে নারীকে যৌনবস্তু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সাধারণ মানুষ ক্ষমতাশালী শক্তিশালী বিত্তশালী-এসব মানুষ দ্বারা ভীষণ রকম প্রভাবিত হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নারীবিদ্বেষ লক্ষ মানুষের নারীবিদ্বেষে উৎসাহ জুগিয়েছে। সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে নারীবিদ্বেষ। মানবসভ্যতার ক্ষতি এর চেয়ে বেশি কী আর আছে!

যে সমাজে নারীনির্যাতন, নারীধর্ষণ, নারীহত্যাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত করা হতো না, সেই সমাজকে ধীরে ধীরে সভ্য করছি আমরা, সেই সমাজে আমরা নারীর সমানাধিকার হয় প্রতিষ্ঠিত করেছি, নয়তো সমানাধিকারের জন্য জোর আন্দোলন করছি। যে সমাজে মেয়েদের সতীদাহের আগুনে পুড়তে হতো, ইস্কুল কলেজে পড়ার অনুমতি ছিল না, সেই সমাজে মেয়েরা এখন বড় বড় শিক্ষাবিদ, বড় বড় বিজ্ঞানী, বড় বড় চিকিৎসক, বড় বড় প্রকৌশলী। পুরুষেরা যা, তার কী নয় আজ মেয়েরা? যতটুকু এগিয়েছে সমাজ, ততটুকু পেছনে টানতে ট্রাম্পের মতো মানুষের জুড়ি নেই। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যদি নারীকে যৌনবস্তু হিসেবে দেখতে পারেন, তবে আমাদের দেখতে দোষ কী! এটি ছিল অনেকের মনের কথা। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা চেষ্টা করেছেন নারীবিদ্বেষী ট্রাম্পকে শিক্ষিত করার। যে লোক বিত্তের জোরে অশিক্ষিত হয়ে থাকতে আপত্তি করেন না, তাঁকে শিক্ষিত করতে আমেরিকার আদালত অবশ্য ভালো ভূমিকা নিয়েছে। আদালত ট্রাম্পের মুসলিম বিরোধী পদক্ষেপের লাগাম টেনে ধরেছে, সাতটি মুসলিম দেশের মানুষের আমেরিকা ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন ট্রাম্প, তাঁর সেই আদেশ আদালত স্থগিত রেখেছে।

এই তো সে দিনও নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প দর্শকদের বললেন, সব পুরুষকে তিনি চুমু খেতে চান, এবং সব ‘সুন্দরী মেয়ে’কে তিনি চুমু খেতে চান। এর মানে যারা সুন্দরী নয়, তাদের তিনি আলিঙ্গন করবেন না, চুমুও খাবেন না। প্রেসিডেন্ট হয়েও তাঁর চরিত্র সামান্যও পরিবর্তন হয়নি।

ট্রাম্প বা ট্রাম্পের মতো কেউ নয়, নারী-পুরুষের সমানাধিকারে, আর মানবাধিকারে বিশ্বাস করা সভ্য কেউ আসুন ক্ষমতায়। আমরা উৎসব করবো। বাইডেন এবং কমলার জন্য থ্রি চিয়ার্স।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

আডি/ ১২ নভেম্বর

Back to top button