জাতীয়

চমেক হাসপাতালে স্বজনদের আহাজারি, রোগীদের আর্তনাদ

চট্টগ্রাম, ০৬ জুন – চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালজুড়ে আহতদের আর্তনাদ আর স্বজনহারাদের আহাজারি। কেউ বা কাঁদতে কাঁদতে প্রিয়জনকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। রোগীদের সামলাতে হিমশিম খান চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। জীবন বাঁচাতে স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে এগিয়ে আসেন অনেকে।

গত শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১১টার দিকে সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী এলাকার বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গতকাল রোববার দিনভর ছিল এই চিত্র।

বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত হয়ে চট্টগ্রাম ও ঢাকার ছয়টি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১১০ জন। এর মধ্যে চট্টগ্রামের পাঁচটি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৯৬ জন। বাকি ১৪ জন ভর্তি আছেন ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে।

রোববার দুপুরে সাংবাদিকদের কাছে ব্রিফিংয়ে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের পর এ পর্যন্ত আনুমানিক ২০০ জনকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আনা হয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন। আহতদের মধ্যে ১৫ জনকে (ফায়ার সার্ভিসের সদস্য) সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) স্থানান্তর করা হয়েছে। আইসিইউতে চারজন চিকিৎসাধীন ব্যক্তির মধ্যে দুজন চট্টগ্রাম মেডিকেলে এবং অন্য দুজন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে। আহত সাত-আটজন পুলিশ সদস্য নগরের পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এ ছাড়া আহতদের মধ্যে চমেক হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটসহ বিভিন্ন বিভাগে ৭০ জন ও চট্টগ্রামের পার্কভিউ হাসপাতালে দুজন চিকিৎসাধীন।

চমেক হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. রফিক উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘৩ থেকে ৮০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া এসব রোগীর সবার অবস্থা সংকটাপন্ন। তবে এখন পর্যন্ত আমরা সফলভাবে চিকিৎসাসেবা দিতে পারছি। প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। ’

চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, ‘আহতরা আসার খবরে অনেক চিকিৎসক নিজেরাই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত হয়ে পড়েন, যা আমি ৩২ থেকে ৩৫ বছরে দেখিনি। ’

সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোর ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় গতকাল রাত সোয়া ৮টা পর্যন্ত রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ফায়ার সার্ভিসের দুজন কর্মী, বর্তমান ও সাবেক দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ১৪ জন ভর্তি রয়েছেন।

তারা হলেন- উপপরিদর্শক (এসআই) কামরুল হাসান ও সাবেক সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) এ কে এম মাখফারুল এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মী গাউসুল আজম ও রবিন মিয়া।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সীতাকুণ্ডের ডিপোতে আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনায় যারা দগ্ধ হয়ে এই ইনস্টিটিউটে এসেছেন, তারা কেউই শঙ্কামুক্ত নন।

দায়িত্ব পালনকালে দগ্ধ এসআই

শিল্প পুলিশের এসআই কামরুল হাসান (৩৭) ছয় মাস আগে সীতাকুণ্ডে বদলি হন। গত রাতে তিনি ডিপোতে দায়িত্বে ছিলেন। অগ্নিকাণ্ডের সময় লোকজনকে ডিপো থেকে সরানোর সময় হঠাৎ বিস্ফোরণে তার আশপাশে কয়েকজন ছিন্নভিন্ন হয়ে যান। তার পা পুড়ে যায়। গতকাল সকালে তাকে ঢাকায় আনা হয়।

সাবেক এএসপি মাখফারুলের দুই চোখ ক্ষতিগ্রস্ত

ডিপোতে বিস্ফোরণে দগ্ধ সিকিউরিটি ম্যানেজার এ কে এম মাখফারুল ইসলাম। তার শ্বাসনালি পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। পরিবারের সদস্যরা উৎকণ্ঠায় হাসপাতালে অপেক্ষা করছিলেন।

রোববার বিকেল পর্যন্ত ৪৯ জনের মৃত্যুর বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াস চৌধুরী। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।

শনিবার রাত ১১ টার দিকে লাগা আগুন রোববার রাত পার হলেও নিস্তার দেয়নি ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট নিরলস কাজ করে যাচ্ছে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে। সকাল থেকেই ফায়ার সার্ভিসের সাথে যোগ দেয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

এছাড়াও রোভার স্কাউট, রেড ক্রিসেন্টসহ অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরাও এগিয়ে আসে তাদের সহায়তায়। এতো মানুষের আপ্রাণ চেষ্টাও কাজে লাগেনি কন্টেইনারের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে। মাঝে মাঝে কিছু সময়ের জন্য আগুনের মাত্রা কিছুটা স্তিমিত হতে দেখা গেলেও পরে আবারও তা দাউদাউ করে জ্বলে উঠতে দেখা যায়।

কন্টেইনারগুলোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড থাকায় গতকাল রাত থেকেই একের পর এক বিস্ফোরণ হতে থাকে কন্টেইনার। এছাড়াও অন্য আরও কেমিক্যালের উপস্থিতির কারণে ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পেরিয়েও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানানো হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে।

ডিপোর গেটের সামনে ও চট্টগ্রাম মেডিকেলে ক্রমাগত ভিড় করেন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিখোঁজদের স্বজনরা। নিজেদের প্রিয়নজনকে খুঁজে ফিরছে তাদের দু চোখ। কেউ কেউ আবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে স্বজনকে না পেয়ে ডিপোর সামনে এসে অপেক্ষা করছেন। তাদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে চারপাশ।

সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের আরবান সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ টিমের প্রধান আরিফুল ইসলাম হিমেল বলেন, রোববার সকাল থেকেই আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি। এখনও পুরোপুরি নেভানো যায়নি। কিছু কন্টেইনারে এখনও আগুন জ্বলছে। সেনাবাহিনীর প্রায় ২০০ জনবল এখানে কাজ করছে।

কন্টেইনার ডিপোর আগুনের ঘটনায় হতাহতদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন বিএম ডিপোর মালিক কর্তৃপক্ষ। নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে দেয়া হবে বলে জানআনো হয় তাদের পক্ষ থেকে।

অন্যদিকে, অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে ৭ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। কমিটির প্রধান করা হয়েছে অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. রেজাউল করিমকে। এতে সদস্য সচিব হিসেবে আছেন অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগের উপপরিচালক মো. আনিসুর রহমান।

সূত্র : বাংলাদেশ জার্নাল
এম এস, ০৬ জুন

Back to top button