জাতীয়

ফ্লাইওভারের নীচের অংশ নিয়ে কোটি টাকা বাণিজ্য

শিপন হাবীব

রাজধানীর মগবাজার ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা দখল করে নির্মাণ হচ্ছে স্থাপনা। দীর্ঘদিন ধরে এই অবৈধ কার্যক্রম চললেও দেখার যেন কেউ নেই।

ঢাকা, ২৭ মে – রাজধানী ঢাকায় এখন ছয়টি ফ্লাইওভার। যানজটের ভোগান্তি কমাতে গড়া এসব ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে শাঁশাঁ গাড়ি চললেও এর নিচটা নগরবাসীর জন্য হয়ে উঠেছে আরেক ভোগান্তির কারণ। একটি ছাড়া সবকটির নিচের জায়গা চলে গেছে বেদখলে।

ভাতের দোকান থেকে শুরু করে মুরগির দোকান, মাংসের দোকান, টং, ঘোড়া রাখার স্থান, গ্যারেজ, গোডাউন, শৌচাগার-এমনকি থাকার ঘরও তৈরি করা হয়েছে এখানে। কোথাও বসেছে বালু-ইট-পাথরের মহাল, ডাম্পিং স্টেশন।

আর এসব দখলে জড়িত রয়েছে রাজনৈতিক কর্মী থেকে শুরু করে স্থানীয় কাউন্সিলর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, এমনকি এটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা সিটি করপোরেশনও।

দখলি স্থান নিয়ে চলছে নানা ধরনের বাণিজ্য, দৈনিক আদায় করা হচ্ছে কয়েক কোটি টাকা। এর ভাগ যায় পুলিশ থেকে শুরু করে প্রশাসনের কর্মকর্তা পর্যন্ত। ফলে দখলকারীদের দাপটে নানা সমস্যা পোহাতে হয় পথচারী ও এলাকাবাসীকে।

এর ওপর কোথাও কোথাও তৈরি করা হয়েছে ভাগাড়, স্থানে স্থানে জমেছে ময়লার স্তূপ। দিনে বা রাতে অনেক জায়গায়ই বসে মাদকাসক্তদের আড্ডা, চলে মাদকের বিকিকিনি, রাতের নির্জনে যৌনকর্মীদের আনাগোনা, সময়ে-অসময়ে অবস্থান নেয় ছিনতাইকারীরা।

নগরবিদরা বলছেন, দখল উচ্ছেদ করে এ অংশটুকু অনায়াসেই শিশুদের বিনোদন ও বড়দের স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক কাজে ব্যবহার করা যেত, তাহলে নগরবাসী এ থেকে উপকার পেত।

বুধ ও বৃহস্পতিবার নগরীর এসব ফ্লাইভারের নিচে ঘুরে দেখা যায় দখলের নানান চিত্র। কোনোটার নিচে সারি সারি কক্ষ বানিয়ে বসবাস করছে লোকজন। কোথাও আবার লোহা বা টিনের ব্যারিকেড দিয়ে নির্মাণকাজ চলছে। প্রকাশ্যে মাদকসেবন হচ্ছে।

যৌনকর্মীদের আড্ডাও জমছে। কোথাও রাস্তার পাশ পর্যন্ত দখল করে নির্মাণসামগ্রী রাখা হচ্ছে। কোথাও আবর্জনার স্তূপ। তবে এর মধ্যে বনানী-মিরপুর ফ্লাইওভারের চিত্র শুধু ভিন্ন। স্থানটি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকায় এখানে দখলের কোনো চিহ্ন নেই। বরং এর নিচের অনেক অংশই সবুজে ঘেরা।

শনির আখড়া থেকে শুরু হয়ে সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী হয়ে বকশিবাজার পর্যন্ত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার। গুলিস্তান এলাকায় ফ্লাইওভারটির নিচে বাড়িঘর তৈরি করে রাখা হয়েছে।

বঙ্গবাজার এলাকায় ঘোড়া রাখার জায়গা তৈরি করা হয়েছে। মলমূত্র পড়ছে সড়কে। সারি সারি থাকার কক্ষ। এসব কক্ষের বাসিন্দাদের একজন জানালেন, এখানে ফ্লাইওভারসংশ্লিষ্ট লোকজনসহ নিরাপত্তাকর্মীরা থাকেন।

ভেতরে ঢুকতে চাইলেই তিনি বলেন, ‘ভেতরে গেলে নাজেহাল হবেন, চোখ খুলে দেখেন-‘সাধারণ মানুষ প্রবেশ নিষেধ’। ছবি তুললে বিরাট সমস্যায় পড়বেন।’

এছাড়া বাকি অংশে ফলের দোকান, রিকশাভ্যানের স্ট্যান্ড, চায়ের দোকান, ভাঙারির দোকান রয়েছে। যেসব জায়গা লোহার প্রাচীরে ঘিরে রাখা হয়েছে, সেখানে ভেতরে মাদকাসক্তদের অবস্থানের নানা চিহ্ন। ভাঙারির স্তূপ, বাক্স, ডাবের খোসা, পলিথিন পড়ে আছে।

কাপ্তানবাজার অংশে মুরগির খাঁচা ও বর্জ্যরে দুর্গন্ধে ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে চলাচলে দম বন্ধ হয়ে আসে। সেখানে ফ্লাইওভারের নিচে বাসচালকদের ক্লাবঘরও গড়ে উঠেছে। টিকাটুলিতে ফ্লাইওভারের নিচেই ছোট ছোট ট্রাক ও পিকআপ রাখা হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এখানকার কয়েকজন স্থানীয় ব্যবসায়ী জানান, ভাতঘর থেকে ছোট্ট গ্যারেজ, ফলের দোকান বা টং-সবকিছু থেকেই চাঁদা তোলা হয়। সবাই জানে, কেউ কিছু বলে না। পুলিশসহ সংশ্লিষ্টরা ভাগ পায়।

এ ফ্লাইওভার থেকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে নামার পথে নিচে ময়লা-আবর্জনায় ভরা। স্থাপন করা হয়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। নিচে ফেলে রাখা হয়েছে গ্যারেজের মালামাল।

স্থানীয় কয়েক ব্যবসায়ী ও স্থান ব্যবহারকারী জানান, কোনো স্থাপনাই চাঁদা ছাড়া রাখা যায় না। কখনো কখনো উচ্ছেদ হলেও তা লোক দেখানো। স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভাগ বসায়। ঘোড়া রাখার স্থান রয়েছে প্রায় অর্ধশত।

এসব স্থান থেকে বছরে ১৬ হাজার টাকা করে চাঁদা দেন ঘোড়া মালিকরা। এছাড়া ভাতঘর প্রতিদিন ৩০০ টাকা এবং গ্যারেজ প্রতিমাসে ৮ থেকে ১৬ হাজার টাকা দিতে হয়। ভাঙারি বা পুরোনো যন্ত্রাংশ স্তূপ করে রাখলেও চাঁদা দিতে হয়।

মুরগি বিক্রি করতে হলে প্রতিদিন ৪০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এসব চাঁদা তোলার জন্য নির্দিষ্ট লাইনম্যান রয়েছে। লাইনম্যানরাই চাঁদা তুলেন। চাঁদা দিতে দেরি হলে পুলিশ এসে উচ্ছেদের ভয় দেখায়। মালিবাগ ফ্লাইওভারের নিচে থাকা গ্যারেজ থেকে প্রতিমাসে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা উঠানো হয়।

মগবাজার ফ্লাইওভারের চৌরাস্তা থেকে রমনার দিকে নামার অংশে, অর্থাৎ নিচের জায়গা পুরোটাই দখলে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জব্দ করা গাড়ি সারি সারি করে রাখা হয়েছে নিচে।

চারপাশে টিন-লোহার ব্যারিকেড। এর সঙ্গে নতুন করে মজবুত করে তৈরি করা হচ্ছে টয়লেট। পাশেই রাখা হয়েছে নির্মাণসামগ্রী। বৃহস্পতিবার সেখানে ছবি তুলতে গেলে এক প্রহরী বাধা দেন।

বলেন, ছবি তোলা বা সাংবাদিক প্রবেশ একেবারেই নিষেধ। বরং সাংবাদিক পরিচয় জেনে এ সময় দখলে থাকা চক্রের সদস্যদের আরও কয়েকজন উলটা নানা প্রশ্ন করতে থাকেন।

মালিবাগ ফ্লাইওভারের নিচে অর্থাৎ পুলিশ লাইনস এলাকা থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত নিচের প্রায় সবটুকু জায়গাই দখলে। পুলিশের অস্থায়ী গাড়ি রাখার স্থান করা হয়েছে।

পাশেই সারি সারি গাড়ি রাখা হয়েছে। একাধিক পথচারী জানান, এখানে গাড়ি রাখায় এ এলাকায় যানজট সবসময়ই লেগে থাকে। অপরদিকে মগবাজার থেকে বাংলামোটর যেতে ফ্লাইওভারে নিচে দখল করে গ্যারেজ তৈরি করা হয়েছে।

ভাতের দোকান থেকে শুরু করে সারি সারি টং বসানো হয়েছে। এফডিসি এলাকায় ফ্লাইওভারের নিচে মাছ রাখার বড় বড় বাক্স, ঝুড়ি রাখা হয়েছে। লোহার বাক্স রাখা হয়েছে মাঝখানে।

ফ্লাইওভারের নিচ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত থাকবে এটাই নিয়ম-এমনটা জানিয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী সাহেদ আহমেদ বৃহস্পতিবার বিকালে বলেন, ‘আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারিনি। গতকাল (বুধবার) আমি নিজে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের নিচ এলাকায় ঘুরে দেখেছি। ঘোড়ার স্থান শুধু নয়, বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে নিচে। বিশ্বাস করার মতো না, আমার এত খারাপ লেগেছে এসব দেখে। তবে আমরা একটি প্যাকেজ করেছি-স্বনামধন্য বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আমাদের সঙ্গে অংশ নিচ্ছে। আমরা মেয়র মহোদয়ের সঙ্গে দ্রুত এ নিয়ে আলোচনা করব। আমরা সর্বোচ্চ সৌন্দর্য নিশ্চিত করব।’

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে ফ্লাইওভারের নিচ এমন করে দখল হয় না। ফ্লাইওভারের নিচে কোনো স্থাপনা থাকতে পারে না। ফ্লাইওভারের ওপর ও নিচ দুটোই গণমানুষের জন্য। জনগণের সম্পত্তি। কোনো ব্যক্তি, কোনো গোষ্ঠী, কোনো সংস্থার নয়। নিচে যদি কোনো স্থাপনা করতে হয়, তাহলে যাদের সম্পত্তি, অর্থাৎ সাধারণ মানুষের মতামত নিয়েই করতে হবে। শিশুদের বিনোদনের ব্যবস্থা হতে পারে। পুলিশ বক্স বা টয়লেট-পুরোটাই অবৈধ, অন্যায়।’

সূত্র : যুগান্তর
এন এ/ ২৭ মে

Back to top button