সচেতনতা

সুস্থ জীবনের বন্ধু রাতের আঁধার

শুধুই আলোর পথযাত্রী হলে চলবে না, অন্ধকারকে ভালোবাসাও জরুরি। এমনটাই দাবি মার্কিন চিকিৎসকদের।
বিজলি-বাতির রোশনাইয়ে নগরজীবন থেকে কার্যত হারিয়েছে দিন-রাতের ফারাক। চিকিৎসকরা বলছেন, তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মানবশরীরে। জৈবিক কিছু প্রক্রিয়া স্বাভাবিক নিয়মে চলে অন্ধকারেই। গভীর রাতে কৃত্রিম আলো, কম্পিউটার, টিভির অতিরিক্ত ব্যবহারে সেই শারীরবৃত্তীয় কাজকর্ম ব্যাহত হয়। যার জেরে হৃদরোগ বা ডায়াবেটিস তো বটেই, হতে পারে ক্যানসারও। তাদের বক্তব্য, বায়ু-জল-শব্দদূষণের মতো কৃত্রিম আলোও এক রকমের ‘দূষণ-দৈত্য’।তবে রাতে আলোর ব্যবহারে কিছুটা সতর্ক হলে বিপদ অনেকটাই এড়ানো সম্ভব।

কয়েকশো কোটি বছর ধরে আলো-আঁধারের ছন্দে ঘুরছে পৃথিবী। ওই চক্রের নিয়মে চলেছে জীবজগত। আদিম মানুষ চকমকি ঘষে আগুন জ্বালানো শিখতেই বদল শুরু। সভ্যতা যত এগিয়েছে অন্ধকারের ‘দখল’ নিয়েছে মশাল, মোমবাতি, লণ্ঠন। বিদ্যুতের বাতি আবিষ্কারের পর দেড়শো বছরে অন্ধকারের দাপট ক্রমে কমেছে। অন্ধকারকে সর্বতোভাবে ‘জয়’ করার মধ্যেই সভ্যতার অগ্রগতি বলে মানতে শিখেছে মানুষ। এখন সূর্য অস্ত গেলেও দুনিয়া জুড়ে শত-শত শহরে অন্ধকার নামে না। আর এখানেই বিপদ।

আমেরিকার চিকিৎসকদের সংগঠন ‘আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’ (এএমএ) সম্প্রতি এক রিপোর্টে জানিয়েছে, রাস্তার ভেপার-বাতি থেকে ঘরের নিয়ন, গাড়ির হেডলাইট থেকে টেলিভিশন, কম্পিউটার, মোবাইল ফোনের আলো রাতে দূষণ ছড়ায় সবই।

‘লাইট পলিউশন: অ্যাডভার্স হেল্থ এফেক্টস অফ নাইট-টাইম লাইটিং’ নামে ওই রিপোর্টের মূল বক্তব্য, রাতে উজ্জ্বল কৃত্রিম আলোয় বেশি ক্ষণ থাকলে ঘুমোতে অসুবিধা তো হয়ই, এতে মানসিক চাপ ও হতাশা বেড়ে যেতে পারে। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস বা শরীরে মেদ জমার আশঙ্কা বাড়তে পারে। এমনকি হতে পারে স্তন ও প্রস্টেট ক্যানসারও।

কী ভাবে?
মার্কিন চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, দিন-রাতের ছন্দের নিয়মে কাজ করে স্নায়ুতন্ত্র, দেহের কিছু কোষও। মানব-মস্তিষ্কের বিশেষ গ্রন্থি থেকে মেলাটোনিন নামে একটি হরমোন বেরোয় তারই ইশারায়। মেলাটোনিন শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট (শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক পদার্থ প্রশমন করে)। জৈবিক ঘড়ির (বায়োলজিক্যাল ক্লক) পরিচালকও বটে। চিকিৎসকরা বলেছেন, ওই হরমোন ঘুমের সহায়ক, হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস রোধ করতে সাহায্য করে। স্তন বা প্রস্টেট ক্যানসার রুখতেও হরমোনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।

চিকিৎসকদের বক্তব্য, রাতে ৮-১০ ঘণ্টা অন্ধকারে থাকলে মানবশরীরে স্বাভাবিক পরিমাণ মেলাটোনিন তৈরি হয়। বেশিক্ষণ উজ্জ্বল কৃত্রিম আলোয় থাকলে তার প্রতিক্রিয়ায় ওই হরমোন তৈরির প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। বিশেষত শিশু এবং অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব আরও বেশি। তবে এ নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলেও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এবং আন্তর্জাতিক ক্যানসার গবেষণা সংস্থা (ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার) কয়েক বছর আগে পৃথক সমীক্ষায় জানিয়েছিল, দিনের আলো এবং রাতের অন্ধকারের মধ্যে ভারসাম্য সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কর্মক্ষেত্রে দিনের বদলে অন্য শিফটে (নন-ডে শিফট) কাজ করলে জৈবিক-ঘড়ির স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাহত হয়। তা থেকে মানবদেহে ক্যানসার ছড়ানোরও সম্ভাবনা থাকে।

ইংল্যান্ড এবং আমেরিকার গবেষকদের পরীক্ষায় জানা যায়, মানুষের চোখের রেটিনায় বিশেষ কিছু ‘সেন্সর’ অর্থাৎ সংবেদনশীল কোষ রয়েছে। মেলাটোনিন তৈরি এবং শরীরের জৈবিক-ঘড়ির নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সেগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, রাতের ‘আলোয়’ বিশেষত নীলচে আভায় চোখের ওই কোষগুলি উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তার জেরে থমকে যায় মেলাটোনিনের উৎপাদনও। গবেষকরা জানাচ্ছেন, নাইট-ক্লাবের চড়া আলোও মেলাটোনিন গঠনের প্রক্রিয়াকে বাধা দিতে সক্ষম। বেশি রাত পর্যন্ত টেলিভিশন, কম্পিউটার, আই প্যাড, মোবাইল ফোনের নীলচে আলোও বিপদ টেনে আনতে পারে।
হারানো দিনের গান বলেছিল, তুমি যে আঁধার তাই বড় ভালোবাসি। সুস্বাস্থ্যের খাতিরে এ যুগেও তা মন্ত্র হয়ে উঠতে পারে!

সতর্কতার ৫ দফা
১. বেশি রাত পর্যন্ত টেলিভিশন,কম্পিউটারে কাজ নয়। শোয়ার ঘরে না-রাখাই ভালো।
২. রাস্তার বাতি যাতে অপ্রয়োজনীয় ভাবে আলো না-ছড়ায় সে জন্য নতুন পদ্ধতির সন্ধান।
৩. গাড়ির হেডলাইটের উজ্জ্বলতা নিয়ন্ত্রণে নয়া প্রযুক্তি।
৪. ঘরে এবং অফিসে আলোর পরিমিত ব্যবহারে গুরুত্ব।
৫. রাতে শোয়ার সময় অন্ধকার ঘর। খুব প্রয়োজনে লাল, কমলা নাইট ল্যাম্প।

আডি/ ০৯ নভেম্বর

Back to top button