জাতীয়

কঠোর নজরদারিতে এসকে সুর ও শাহ আলম

দুলাল হোসেন

ঢাকা, ১৬ মে – অর্থ আত্মসাতের মামলায় পিকে হালদার গ্রেপ্তার হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান কয়েক কর্মকর্তার নাম নতুন করে আলোচনায় এসেছে। টানা পাঁচ বছর ধরে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশ বাংকের অডিট শাখার এসব কর্মকর্তা চুপ ছিলেন। পিকে হালদার গ্রেপ্তার হওয়ার পর এসব কর্মকর্তা যেন পালিয়ে যেতে না পারেন, সে জন্য তাদের কঠোর নজরদারিতে রেখেছে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

দুদকের অনুসন্ধান সূত্র বলছে, চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতে পিকে হালদারকে সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই ডজনের বেশি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এদের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অডিট শাখার এসব কর্মকর্তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় দুদক এ অনুসন্ধানে নামে। অভিযুক্তদের বিষয়ে তথ্য চেয়ে কেন্দ্রীয় বাংকের গভর্নরের কাছে গত বছরের এপ্রিলে চিঠিও পাঠায় দুদক। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তথ্য পাঠানো হয় দুদকে। এসব তথ্য পর্যালোচনা চলছে। তবে দুদক অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম ও সাবেক ডেপুটি গভর্নর সীতাংশু কুমার সুর চৌধুরীসহ (এস কে সুর চৌধুরী) সাতজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। অন্য যারা অভিযুক্ত, তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলবি নোটিশ পাঠানো হবে বলে জানা গেছে।

দুদকের অনুসন্ধানসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্সের দুর্নীতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল কেন উদ্ঘাটন করতে পারল না, তা নিয়ে রীতিমতো প্রশ্ন উঠেছে। পরিদর্শন দলের সহযোগিতার কারণে খুব সহজে আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণে রেখে পিকে চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পিকে কেলেঙ্কারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর ও নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমের বিরুদ্ধে প্রতি মাসে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ এক আসামির জবাবন্দিতেও এসেছে।

জানা গেছে, পিকের ঋণ কেলেঙ্কারিসংক্রান্ত বিগত পাঁচ বছরের পরিদর্শন প্রতিবেদন চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে দুদকের পরিচালক বেনজীর আহম্মেদের স্বাক্ষরে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কারো ইচ্ছাকৃত গাফিলতি বা কুমতলব উদ্ঘাটিত হলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে চিঠিতে বলা হয়।

জানা গেছে, দুদকের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ একটি টিম গঠন করে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিং এবং এফএএস ফাইন্যান্স পরিদর্শন শেষে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। এরপর বিএফআইইউর প্রতিবেদন ২০২০ সালের ৭ জুলাই দুদক মহাপরিচালকের (মানিলন্ডারিং) কাছে পাঠানো হয়। ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পরই দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপপরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান ৮৩ জনের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করেন। এখন পর্যন্ত পিকে হালদার কেলেঙ্কারির ঘটনায় ৬৪ জনের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দুদক।

দুদকের অনুসন্ধানসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসকে সুর ও শাহ আলমের সহযোগিতায় পিকে হালদার একছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর। সেখানে এমডি-চেয়ারম্যান পদে কাকে বসাবেন, ঋণ কীভাবে দেওয়া হবে, সবকিছু ছিল পিকে হালদারের নিয়ন্ত্রণে। এসকে সুর ও শাহ আলম এ বিষয়ে পিকে হালদারকে পূর্ণরূপে সহযোগিতা করতেন। তাদের সহযোগিতার কারণে পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, ফাস ফাইন্যান্স, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে করেছেন।

দুদকের তথ্যমতে, গত বছরের ২৯ মার্চ শাহ আলম, তার দুই স্ত্রী শাহীন আক্তার শেলী ও নাসরিন বেগম, এস কে সুর চৌধুরী, তার স্ত্রী সুপর্ণা সুর চৌধুরী ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অভিযুক্ত কর্মকর্তাসহ ৫২ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ইমিগ্রেশনে চিঠি পাঠায় দুদক। এদের মধ্যে এস কে সুর চৌধুরীর বিরুদ্ধে আগেই হাইকোর্টের আদেশে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত পিকে হালদার কেলেঙ্কারির ঘটনায় ৬৪ জনের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দুদক।

দুদকের তথ্যমতে, পিকে হালদার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আত্মসাৎ করতে প্রথমে বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়স্বজন নিয়ে একটি পারিবারিক সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। ওইসব আত্মীয়স্বজনদের কয়েকটি লিজিং কোম্পানির স্বতন্ত্র পরিচালক বা শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার পদে বসান। এরপরই কাগুজে প্রতিষ্ঠান খুলে ঋণ অনুমোদন করান। তিনি ঋণের কমিশন হিসেবে তার ধানমন্ডির ব্যাংক হিসাবে ঢোকে ২৫০ কোটি টাকা।

দুদকের অনুসন্ধান সূত্র বলছে, পিকে হালদার শেয়ার কিনে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে বসান নাহিদা রুনাইকে। এ কাজে তার খরচ হয়েছে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর অবন্তিকা বড়ালকে ৮০০ কোটি টাকা খরচ করে পিপলস লিজিংয়ে বসান। সুস্মিতা সাহাকে দিয়েছেন ১০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ, পাপিয়া ব্যার্নাজীকে ৩০০ কোটি টাকা এবং মমতাজকে দিয়েছেন ৩০০ কোটি টাকা। দুই প্রেমিকাকে দুই লিজিংয়ের দায়িত্বে দিতে খরচ করেন দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আর তিন বান্ধবীকে দিয়েছেন ৭০০ কোটি টাকা।

দুদকের অনুসন্ধান সূত্র বলছে, পিকে হালদার ত্রিভুজ প্রেমে মগ্ন ছিলেন। তিনি দুই প্রেমিকাকে নিয়ে ৬০ বার বিদেশ ভ্রমণে করেছেন। এর মধ্যে প্রেমিকা নাহিদা রুনাইকে নিয়ে গেছেন ২২ বার। পিকে হালদার নাহিদা রুনাইকে দিয়েছেন ২০ কোটি টাকা। অবন্তিকাকে বড়ালকে দিয়েছেন ধানমন্ডিতে ৫ কোটি টাকার ফ্ল্যাট। অনন্দিতা মৃধাকে দিয়েছেন উত্তরাতে ৪০ কোটি টাকা মূল্যের বাণিজ্যিক ভবন।

দুদকের অনুসন্ধান সূত্রে জানা গেছে, দুদকের অনুসন্ধানী টিম প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষ করে এখন পর্যন্ত ৮৪ জনের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে। দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতায় এখন পর্যন্ত ৮৩ ব্যক্তির প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সম্পদ আদালতের মাধ্যমে ফ্রিজ করেছে দুদক।

অনুসন্ধান সূত্রে জানা গেছে, পিকে হালদার ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা অনুসন্ধান চলছে। প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষ করে ৩৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। দুদকের অনুসন্ধান টিম এখন পর্যন্ত ১৩ জন আসামি আসামিকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদের রিমান্ডে নিয়েছে। রিমান্ডে তারা অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। যাদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে- তাদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী, পিকে হালদারের সহযোগী শংখ বেপারী, রাশেদুল হক, অবন্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাইসহ ১১ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, পিকে হালদার বিদেশে বিপুল অর্থপাচার করেছেন। আমরা তার অর্থপাচারের বিষয়ে জানতে কানাডা, সিঙ্গাপুর ও ভারতে এমএলআর পাঠিয়েছি।

সূত্র : আমাদের সময়
এম এস, ১৬ মে

Back to top button