ইউরোপ

পুতিনের কথিত প্রেমিকা কাবায়েভা সম্পর্কে যা জানা যায়

মস্কো, ০৭ মে – রাশিয়া এরই মধ্যে নজিরবিহীন অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে আছে। এ পরিস্থিতিতে আলিনা কাবায়েভাকেও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হতে পারে। আলিনা একসঙ্গে রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যমকর্মী এবং সাবেক অলিম্পিক জিমনাস্ট। গুজব সত্যি হলে তিনি ভ্লাদিমির পুতিনের প্রেমিকা ও তার কয়েক সন্তানেরও মা।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য দেশের অবরোধের আওতায় যাদেরকে আনা হয়েছে, তাদেরকে মূলত পুতিনের সাথে ঘনিষ্ঠতার কারণে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। যাদের মধ্যে আছেন অলিগার্ক, রাজনীতিবিদ এবং সেসব কর্মকর্তা, যারা প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ হিসেবে নানা সুবিধা ভোগ করেছেন।

গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন ভ্লাদিমির পুতিনের দুই কন্যার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এদের একজন মারিয়া ভরোন্তসোভা, অপরজন কাতেরিনা তিখোনোভা। এ দুজনের মা পুতিনের সাবেক স্ত্রী লুদমিলা।

তবে পুতিনের কথিত প্রেমিকা কাবায়েভা এখন পর্যন্ত অবরোধ এড়াতে পেরেছিলেন। যদিও তিনি হয়তো বুঝতে পারছিলেন কিছু একটা আসছে।

গত মার্চ মাসে একটি অনলাইন পিটিশনে দাবি তোলা হয় কাবায়েভাকে যেন তার সুইজারল্যান্ডের নিবাস থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিছু সূত্রের মাধ্যমে বিবিসি নিশ্চিত হতে পেরেছে যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিষেধাজ্ঞার নতুন যে তালিকা তৈরি করছে তাতে কাবায়েভার নাম আছে।

বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়, তাকে লক্ষ্যে পরিণত করার কারণ ক্রেমলিনের প্রচারণা ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখা এবং ৬৯ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট পুতিনের ‘ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে’ থাকার অভিযোগ।

যদিও খসড়া তালিকায় কাবায়েভকে পুতিনের সঙ্গী হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। তালিকাটিতে আনুষ্ঠানিক সাক্ষরও করা হয়নি এখন পর্যন্ত। রুশ নেতা সবসময়ই নিজেকে কঠোর গোপনীয়তার ঘেরাটোপে রাখেন। ব্যক্তিজীবন নিয়ে করা প্রশ্নগুলো সাধারণত একেবারেই উড়িয়ে দেন তিনি। অবশ্য কাবায়েভের সাথে সম্পর্কের কথা স্পষ্টভাবে অস্বীকার করেছেন তিনি।

২০০৮ সালে মস্কোভস্কি করেসপন্ডেন্ট পত্রিকা খবর দেয়, ভ্লাদিমির পুতিন তার স্ত্রী লুদমিলাকে তালাক দিয়ে কাবায়েভাকে বিয়ে করার পরিকল্পনা করছেন। দুজনেই এ খবরের সত্যতা উড়িয়ে দেন। এর কিছুদিন পরই কর্তৃপক্ষ পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। তারও পাঁচ বছর পর পুতিন ও লুদমিলা তাদের বিবাহবিচ্ছেদের ঘোষণা দেন।

রুশ প্রেসিডেন্ট যখন কাবায়েভার সাথে সম্পর্কের কথা অস্বীকার করে যাচ্ছিলেন, আলিনা কাবায়েভা তখন সফল ক্রীড়াবিদ থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে উঠছিলেন।

তার পছন্দের শাখা ছিল রিদমিক (ছন্দবদ্ধ) জিমনাস্টিক্স। যেখানে প্রতিযোগীরা রিবন বা বল হাতে নিয়ে জিমনাস্টিক্স প্রদর্শন করেন। যখন ক্যারিয়ারের চূড়ায় ছিলেন তখন কাবায়েভাকে পৃথিবীর সেরা বলে মনে করা হত।

জিমনাস্টিক্সের একটি কৌশল তার নামে নামকরণ করা হয়েছিলেন। তিনি পৃথিবীর সেরা জিমনাস্টিক্স দলটির প্রধান চরিত্র ছিলেন। রাশিয়া ২০০০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত অলিম্পিক্সে জিমনাস্টিক্সের যত রকম ইভেন্ট আছে তার সবকটিতে স্বর্ণ জিতেছে।

আলিনা কাবায়েভার জন্ম ১৯৮৩ সালে। মাত্র চার বছর বয়সে তিনি রিদমিক জিমনাস্টিক্স শুরু করেন। তার কোচ ইরিনা ভিনার বলেন, ‘আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারতাম না। রিদমিক জিমনাস্টিক্সের জন্য যে দুটি গুণ দরকার- নমনীয়তা ও ক্ষিপ্রতা- দুটিরই এক বিরল সমন্বয় ছিল তার মধ্যে’। এক পর্যায়ে কাবায়েভা ‘রাশিয়ার সবচাইতে নমনীয় নারী’ হিসেবে পরিচিতি পান।

তিনি ১৯৯৬ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিযোগিতায় যোগ দেন। সবার মধ্যে বিস্ময় জাগিয়ে ১৯৯৮ সালে ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করেন তিনি।

দুই হাজার সালের সিডনি অলিম্পিক্সে একটি ভুলের কারণে ব্রোঞ্জ নিয়ে ফিরতে হয় তাকে, কিন্তু চার বছর পর এথেন্স অলিম্পিক্স থেকে স্বর্ণ নিয়ে ফেরেন।

অবসরে যাওয়ার আগে অলিম্পিক্স পদক ছাড়াও তিনি ১৮টি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ পদক ও ২৫টি ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ পদক জেতেন। অন্য রুশ অ্যাথলিটদের মত মাদকের কালো থাবা থেকে আলিনা কাবায়েভাও রক্ষা পাননি।

২০০১ সালের একটি প্রতিযোগিতায় তার শরীরে নিষিদ্ধ মাদকের উপস্থিতি পাওয়ার পর তার পদক কেড়ে নেয়া হয়।

রুশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে সরকারি দল ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টির হয়ে ২০০৭-২০১৪ মেয়াদে আসন গ্রহণের মাধ্যমে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তিনি ২০১৪ সালে ন্যাশনাল মিডিয়া গ্রুপের প্রধান হন। এ প্রতিষ্ঠানটির হাতে রাশিয়ার প্রায় সবগুলো প্রধান রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলোর বেশিরভাগ মালিকানা রয়েছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে এ গণমাধ্যমগুলোই নিরলসভাবে ক্রেমলিনপন্থী বার্তা প্রচার করে যাচ্ছে, যাতে অভিযোগ করা হচ্ছে ইউক্রেনিয়ানরা নিজেরাই নিজেদের শহরে গোলাবর্ষণ করছে। এসব বার্তায় রুশ সেনাদের বর্ণনা করা হচ্ছে মুক্তিদাতা হিসেবে।

পদের কারণেই একজন ধনী নারীতে পরিণত হয়েছেন কাভায়েভা। ফাঁস হওয়া নথি অনুযায়ী, তার বার্ষিক আয় এক কোটি কুড়ি লাখ ডলারের মত। এটা স্পষ্ট নয় যে, পুতিনের সাথে তার প্রথম পরিচয় কখন হয়েছিল। কিন্তু একজন শীর্ষস্থানীয় অলিম্পিয়ানের পক্ষে একটি দেশের প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করার ঘটনা অস্বাভাবিক নয়।

তাদের দুজনের ২০০১ সালে তোলা একটি ছবি পাওয়া যায়। যেখানে দেখা যাচ্ছে পুতিন তার হাতে শীর্ষ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা অর্ডার অব ফ্রেন্ডশিপ তুলে দিচ্ছেন। গুজব আছে, তাদের দুজনের সন্তান রয়েছে। তবে সন্তানের সংখ্যা এক এক খবরে এক এক রকম উল্লেখ রয়েছে।

একটি সুইস পত্রিকার খবর অনুযায়ী, কাভায়েভা ২০১৫ সালে লেক লুগানোর একটি বিশেষ ক্লিনিকে একটি ছেলে সন্তান জন্ম দেন। একই স্থানে ২০১৯ সালে তার আরেকটি ছেলে হয়। কিন্তু দ্য সানডে টাইমস এবং ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের খবর মোতাবেক মস্কোতে ২০১৯ সালে যমজ ছেলে জন্ম দেন কাভায়েভা। ক্রেমলিন এসব খবর অস্বীকার করে আসছে।

২০১৫ সালে পুতিনের মুখপাত্র বলেছিলেন, ‘ভ্লাদিমির পুতিনের ঔরসে সন্তান জন্মদানের খবরের সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই।’ পুতিন অবশ্য প্রকাশ্যে লুদমিলার সাথে তার সন্তানদের নামও কখনো উল্লেখ করেননি- শুধু এটুকু বলেছেন, তার দুজন প্রাপ্তবয়স্ক কন্যা আছে।

পুতিনের সাথে সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই পাদপ্রদীপের আলোয় রয়েছেন কাবায়েভা। ভোগ পত্রিকায় ২০১১ সালে তাকে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হয়, সেখানে তিনি ফরাসি ফ্যাশন হাউজ বালমেইনের তৈরি একটি বহুমূল্য স্বর্ণখচিত পোশাক পরেন।

তিনি ২০১৪ সালে সোচির শীতকালীন অলিম্পিক্সের একজন মশালবাহকও ছিলেন। সম্প্রতি গত এপ্রিলে তিনি মস্কোতে জুনিয়র জিমনাস্টিক্সের একটি উৎসবে যোগ দেন। এর মাধ্যমে আত্মগোপনে থাকার একটি গুজব নস্যাৎ করেন তিনি। ওই অনুষ্ঠানে তিনি রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানের প্রশংসা করেন। কোন কোন গণমাধ্যম খবর দেয় এ সময় তার অনামিকায় ছিল বিয়ের আংটি। রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানে শুরু থেকেই আলিনা কাবায়েভার উপর নিষেধাজ্ঞার দাবি রয়েছে।

দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের খবর, যুক্তরাষ্ট্র কাবায়েভার উপর নিষেধাজ্ঞা দিতে অনিচ্ছুক, তাদের আশঙ্কা এটা পুতিনের প্রতি ‘ব্যক্তিগত আক্রমণ’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, যার ফলে উত্তেজনা আরও বেড়ে যেতে পারে। যদিও নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাবনা একেবারে নাকচ হয়নি।

গত এপ্রিলে যখন হোয়াইট হাউসকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কেন আলিনা কাবায়েভা তাদের সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞার তালিকায় নেই, প্রেস সেক্রেটারি জবাব দিয়েছিলেন, ‘কেউই নিরাপদ নয়।’

সূত্র: বাংলাদেশ জার্নাল
এম ইউ/০৭ মে ২০২২

Back to top button