জাতীয়

রেলের ১০ ইঞ্জিন ক্রয়ে দুর্নীতি ও অনিয়ম

সজিব ঘোষ

ঢাকা, ০৭ মে – বাংলাদেশ রেলওয়ের বহরে সম্প্রতি যুক্ত হওয়া ১০টি মিটার গেজ লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) ক্রয়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ইঞ্জিনগুলো ক্রয়চুক্তি অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়নি। চুক্তিতে তিন হাজার হর্সপাওয়ারের ইঞ্জিন দেওয়ার কথা থাকলেও দুই হাজার হর্সপাওয়ারের ইঞ্জিন দেওয়া হয়েছে। এমন আরো দুটি ব্যত্যয় পাওয়া গেছে। তার পরও রেলওয়ে ইঞ্জিনগুলো গ্রহণ করেছে।

রেলওয়েকে ইঞ্জিনগুলো সরবরাহ করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কম্পানি। দাম ছিল ৩২২ কোটি ৬৮ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। এরই মধ্যে ৯০ শতাংশ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। যদিও তখনকার প্রকল্প পরিচালক এই ইঞ্জিন গ্রহণ এবং দাম পরিশোধের বিষয়ে আপত্তি দিয়েছিলেন।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দেওয়া সরকারের একটি সংস্থার প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে জানানোর জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দিয়েছে।

প্রতিবেদনে এই অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার জন্য যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁরা হলেন রেলওয়ের তখনকার মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান, বর্তমান অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) মো. মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী এবং ঠিকাদার আফসার বিশ্বাস।

প্রতিবেদনে এও বলা হয়েছে, রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের তত্ত্বাবধানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ও গোপনে ‘স্বাধীন পর্যবেক্ষক’ নিয়োগ করে অনিয়মগুলো আড়াল করে ইঞ্জিনগুলো গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। আর অনিয়ম ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলো প্রতিবেদন দেয়।

ওই ইঞ্জিন ক্রয় প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন নূর আহাম্মদ হোসেন। তিনি ১০ ইঞ্জিন বুঝে নিতে রাজি হননি। সরবরাহকারী হুন্দাই রোটেমকে বিল দেওয়াও বন্ধ করে দেন। এরপর নূর আহাম্মদকে বদলি করে হাসান মনসুরকে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দেয় মন্ত্রণালয়। গত বছরের ৪ অক্টোবর রেল ভবনে একটি সভা করে ইঞ্জিনগুলো ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। গত বছরের ৫ অক্টোবর ইঞ্জিনগুলো রেলের বহরে যুক্ত হয়।

২০১৫ সালে ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য লোকোমোটিভ, রিলিফ ক্রেন ও লোকোমোটিভ সিমুলেটর সংগ্রহ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প চালু করা হয়। পুরো প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় ৭৩৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এই প্রকল্পের অধীনে ৩২২ কোটি ৬৮ লাখ ৮৯ হাজার টাকায় ১০টি মিটার গেজ ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ ক্রয় করা হয়।

ইঞ্জিনগুলো প্রাক-জাহাজীকরণের দায়িত্ব দেওয়া হয় চায়না সার্টিফিকেট অ্যান্ড ইন্সপেকশন কম্পানিকে (সিসিআইসি)। ২০২০ সালের ২৫ জুলাই ইঞ্জিনগুলো প্রাক-জাহাজীকরণ সমীক্ষা (পিএসআই) সনদ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো হয়। সিসিআইসি ওই বছরের ১২ আগস্ট নিয়ম ভেঙে একই দিনে দুটি পিএসআই সনদ দেয়। ওই বছরের ৩১ আগস্ট ইঞ্জিনগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে এলে সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই খালাস করতে প্রকল্প পরিচালককে বাধ্য করা হয় বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

প্রতিবেদন বলছে, তখনকার প্রকল্প পরিচালক নূর আহাম্মদ হোসেন ক্রয় আদেশ অনুযায়ী মান ঠিক না থাকায় এসব ইঞ্জিন গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু রেলওয়ের সাবেক ডিজি মো. শামছুজ্জামান ও এডিজি (আরএস) মো. মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরীর মৌখিক নির্দেশে তা গ্রহণ করা হয়।

নূর আহাম্মদ হোসেন বর্তমানে অবসরে আছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, মন্ত্রীর নেতৃত্বে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এই বিষয়ে দফায় দফায় বৈঠক হয়। নিশ্চয়ই তাঁর সিদ্ধান্ত ছাড়া ডিজি, এডিজি এত ক্ষমতা দেখাতে পারেননি।

তবে এ বিষয়ে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁর সঙ্গে কথা বলা যায়নি।

রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) মো. মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি রাজি হননি। সাবেক ডিজি মো. শামছুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, জাহাজীকরণের আগে পিএসআই সনদ না দেওয়া, সিসিআইসি থেকে একই দিনে দুই ধরনের পিএসআই সনদ দেওয়া, কমিশনিংয়ের জন্য যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করা এবং কারিগরি ত্রুটি পাওয়ার পরেও ডিজি ও এডিজির (আরএস) আদেশে ইঞ্জিনগুলো গ্রহণ করা দুর্নীতির প্রতিফলন বলে অনুমান করা যায়।

তদন্ত প্রতিবেদন মতে, ইঞ্জিনগুলোতে নিম্নমানের ক্যাপিটাল কম্পোনেন্ট সংযোগ করার বিষয়টি সিসিআইসি ও হুন্দাই রোটেম গোপন রেখেছে। আবার কমিশনিং কমিটির প্রতিবেদনে ইঞ্জিনগুলোর বিভিন্ন ত্রুটির বিষয় তুলে ধরা হলেও ‘পারফরম্যান্স সন্তোষজনক’ বলে উল্লেখ করা হয়। এতে প্রতীয়মান হয়, সাবেক ডিজি, এডিজির প্রভাবে কমিটি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি।

ইঞ্জিনে যেসব ত্রুটি

ইঞ্জিনগুলো খালাসের পর টেস্ট, ট্রায়াল রান এবং কমিশনিংয়ের জন্য ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ইঞ্জিনগুলোর তিনটি ক্যাপিটাল কম্পোনেন্টে ভিন্নতা আছে, যা চুক্তিবহির্ভূত। চুক্তিতে তিন হাজার হর্সপাওয়ারের ইঞ্জিন দেওয়ার কথা থাকলেও দুই হাজার হর্সপাওয়ারের ইঞ্জিন দেওয়া হয়েছে। টিএ-১২ মডেলের অলটারনেটরের বদলে টিএ-৯ মডেল সংযোগ করা হয়েছে। ট্রাকশন মোটরে ২৯০৯-৯ মডেলের পরিবর্তে ২৯০৯ মডেল দেওয়া হয়েছে।

তদন্ত কমিটি গঠন করে রেল মন্ত্রণালয়ও

তখনকার প্রকল্প পরিচালক নূর আহাম্মদ হোসেনের অভিযোগের ভিত্তিতে ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করে মন্ত্রণালয়। কিন্তু এডিজির (আরএস) বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাঁকে ওই কমিটির সদস্য করা হয়। একই বছরের ৩ ডিসেম্বর তৎকালীন রেলের ডিজির সভাপতিত্বে প্রজেক্ট ইমপ্লেমেন্টেশন কমিটির (পিআইসি) সভায় প্রকল্প পরিচালককে ৬৫ শতাংশ বিল প্রদানের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক তা করেননি।

পরে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের নির্দেশে ইঞ্জিনগুলোর কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য একটি কারিগরি কমিটি করা হয়। এর আহ্বায়ক ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেকানিক্যাল বিভাগের অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রাজ্জাক। কমিটি স্বাধীন পর্যবেক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করে। কমিটি ইঞ্জিন সম্পর্কেও প্রতিবেদন দেয়। তবে তা রেল মন্ত্রণালয় প্রকাশ করেনি।

অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রাজ্জাক বলেন, ইঞ্জিনগুলো চলবে না তা নয়, এজাতীয় ঘাটতির ফলে ইঞ্জিনের সক্ষমতা কমে যাবে। ইঞ্জিনের হর্সপাওয়ার বেশি থাকলে বেশি বগি টানতে পারবে।

ইঞ্জিনের কার্যকারিতার প্রতিবেদনে কী ছিল, এমন প্রশ্নে মাহবুবুর রাজ্জাক বলেন, ‘দু-এক লাইনে বলা কঠিন। তবে ইঞ্জিনের সক্ষমতা কম। ইঞ্জিনগুলো ক্রয় প্রক্রিয়ায় অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। কারা দুর্নীতি করেছে, এটা ওপেন সিক্রেট, আমি না বলাই ভালো। তবে মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে তা উল্লেখ আছে। ’

তবে প্রকল্পের বর্তমান পরিচালক হাসান মনসুর বলেন, ‘ইঞ্জিনগুলো শুরু থেকেই ভালো চলছে। কোনো সমস্যা নেই। আমরা একাধিকবার পরীক্ষা করে দেখেছি, সব ঠিক আছে। এর আগে এই একই কম্পানি একই মানের আরো ১০টি ইঞ্জিন দিয়েছে, সেগুলো তো ভালোভাবেই চলছে। ’

তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ

প্রতিবেদনে রেলওয়ের সাবেক ডিজি মো. শামছুজ্জামান ও বর্তমান এডিজি (আরএস) মো. মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে অধিকতর তদন্তের জন্য একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করা যেতে পারে বলে মত দেওয়া হয়। চুক্তি ভঙ্গ করায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রেলের সচিবকে চিঠি দিয়েছিল গত বছরের ৮ নভেম্বর। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সেই সচিব সেলিম রেজা অবসরে চলে গেছেন। গত রাতে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘তখন কী চিঠি এসেছিল, তা এই মুহূর্তে মনে আসছে না। ’

সূত্র : কালের কণ্ঠ
এম এস, ০৭ মে

Back to top button