ঢাকা, ৮ নভেম্বর- রাজধানীর আদাবর এলাকা থেকে অস্ত্র ও ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন ভূমিদস্যু মনিরুজ্জামান মনির ওরফে কালা মনির। তার গ্রেপ্তারের খবর শোনার পর থেকেই মুখ খুলতে শুরু করেছেন অনেক ভুক্তভোগী। তাদের অভিযোগ, জমি দখল, বাড়ি দখল, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ইত্যাদি ছিল কালা মনিরের মূল পেশা। তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কাছে জিম্মি এলাকার অধিকাংশ ব্যবসায়ী ও বাসিন্দা। প্রাণে বাঁচতে ভয়ে চুপ ছিলেন তারা। অনেকে আবার ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন অন্যত্র। জমি-বাড়ি দখলের পর অনেককে আবার মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে রাজধানী ছাড়তেও বাধ্য করেছেন কালা মনির।
কালা মনিরের থাবার শিকারদের মধ্যে একজন মো. জহিরুল ইসলাম। এক যুগ আগেও ঢাকার আদাবরের স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন তিনি ও তার পরিবার। জহিরুলের বাবা মো হানিফ এবং বড় ভাই মহিউদ্দিন দুজনই ছিলেন প্রবাসী। প্রবাস জীবনের উপার্জনের টাকা দিয়ে ২০০৭ সালে এক টুকরো জমি কিনেছিলেন তারা। মোহাম্মদপুরের শ্যামলী হাউজিংয়ে মো. জহিরুল ইসলাম এবং মহিউদ্দিন দুই ভাইয়ের নামে একটি প্লট কিনে সেখানে বসবাসের জন্য টিন শেডের একটি বাড়িও করেছিলেন। কিন্তু ওই বাড়িতে বসবাস শুরু করতেই হঠাৎ এক মধ্যরাতে তাদের এক স্বজনকে তুলে নিয়ে যায় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা।
স্বজন উদ্ধারে পুলিশের সহায়তা চাইতে থানায় যান জহিরুল। এ সুযোগে তাদের ঘরটি দখল করে নেয় কালা মনিরের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। পরে থানা পুলিশের সহায়তায় সেই আত্মীয়কে উদ্ধারসহ বাড়িটি ফেরত পায় জহিরুল ইসলাম। এখানেই শেষ নয়; ওই ঘটনার ৬ বছর পরে ২০১৩ সালে আবারও এক রাতে হামলা হয় জহিরুলের বাড়িতে। জোর করে বাড়ি থেকে তাকেসহ পরিবারের সদস্যদের বের করে দেওয়া হয়। আজও নিজের বাড়িতে প্রবেশ করতে পারেননি তারা।
বাড়ি দখল কলেও শান্ত থাকেননি মনির ও তার বাহিনীর সদস্যরা। জহিরুল ও তার ভাই মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে থানায় মামলাও দায়ের করেন। এসব বিষয়ে কথা বলতে ভুক্তোভোগী জহিরুল বলেন, ‘মনির বাহিনীর সদস্য হুমায়ন ও তার অন্য সহযোগীরা মিলে আমাদের বাড়ি দখল করে। ২০১৩ সাল থেকে আমি ঘর বাড়ি ছাড়া। ওই বাড়ির জায়গাটি আমার বাবা এবং ভাই ২০০৭ সালে কিনেছিল। জায়গাটি কেনার কয়েক মাস পরেই আমাদের বাড়িটি প্রথমবার দখলের চেষ্টা করেছিল মনিরের লোকজন। আমার এক ভাইকে তারা রাতের অন্ধকারে এসে গাড়িতে করে তুলে নিয়ে গিয়ে আকটে রেখেছিল।’
ভাইকে খোঁজাখুঁজির পর বাড়ি ফিরে জহিরুল দেখেন তার ঘরে অপরিচিত কিছু মানুষ বসে তাস খেলছে। তিনি বলেন, ‘তারা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে আমাদের তাড়িয়ে দেয়। এরপর আদাবর থানায় তৎকালীন সময় আমরা একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) দায়ের করি। জিডি নাম্বার-১৩০৪, তারিখ ২৯-১০-২০০৭। তখন পুলিশের সহায়তায় আমার বাড়িটি উদ্ধার হয়। আমার ভাইকেও খুঁজে বের করে দেয় পুলিশ।’
এই ঘটনার পর থেকে টানা ৬ বছর নিজের বাড়িতে শান্তিতে বসবাস করছিলেন জহিরুল ও তার পরিবার। এর মধ্যে তার বাবার মৃত্যু হয়। ২০১৩ সালের ৬ নভেম্বর রাতের অন্ধকারে কালা মনিরের সন্ত্রাসীরা জহিরুলকে পরিবারসহ তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে দেয়। প্রাণের ভয়ে পরে তিনি ও তার ভাই পরিবারসহ নোয়াখালী চলে যান। জহিরুল বলেন, ‘বাড়িটি উদ্ধারের জন্য গত ৭ বছর ধরে আমি আদালতে এবং রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি।’
কালা মনিরের ভয়ে কেউই মুখ খোলার সাহস পায় না
কালা মনিরের জুলুমের শিকার জহিরুল আরও বলেন, ‘কালা মনিরের ভয়ে কেউই মুখ খোলার সাহস পায় না। তবুও আমি প্রাণের মায়া ত্যাগ করে নানাভাবে মনিরের সাথে নিজে থেকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। মনির গ্রেপ্তারের কিছু দিন আগেও এক পরিচিত মানুষের মাধ্যমে আমি মনিরের সাথে দেখা করেছি। সেই দিন মনির আমার সব কথা শুনে আমাকে বিদায় করে দেয়। এরপর থেকে তার লোকজন আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি প্রাণের ভয়ে বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে থাকি এখনো।’
বাড়ির সব বিল জহিরুলের নামে
ভুক্তভোগী জহিরুল ইসলাম জানান, তারা যখন বাড়িতে থাকতেন, তখন বিদুৎ বিল, গ্যাসের বিল, পানির বিল, শ্যামলী জনকল্যাণ সমিতির মাসিক চাঁদার বিল তার নামেই আসতো। ২০০৭ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনিই সব ধরনের বিল পরিশোধে করেছেন। এরপর বাড়ি দখলের পর তিনি আর কোনো বিল দেননি। দখলকারীরা পরবর্তীতে কীভাবে বিল পরিশোধ করেছেন, তা জহিরুলের কাছে এক প্রকার রহস্য। এ ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না।
আরও ১১ ভুক্তোভোগীর অভিযোগ
এসব অভিযোগের বিষয়ে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব-১) সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘কালা মনির এখন রিমান্ডে রয়েছেন। পূর্বের অভিযোগগুলো ছাড়াও গ্রেপ্তারের পর থেকে আরও ১১ জন ভুক্তভোগী আমাদের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন। তাদের কারও জমি দখল, বাড়ি দখল এবং মারধর ইত্যাদি ধরনের অভিযোগ রয়েছে।’
প্রসঙ্গত, গত ৫ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকা উদ্যান এলাকায় অভিযান চালিয়ে কালা মনিরকে গ্রেপ্তার র্যাব। একই দিনে অভিযান চালিয়ে মনিরের সহযোগী বাবুকে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। কালা মনিরের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুরের শেখেরটেক ও বেড়িবাঁধ সংলগ্ন ঢাকা উদ্যান, নবীনগর হাউজিং, চন্দ্রিমা উদ্যানসহ আশপাশের এলাকায় দখল, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজিসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে বিভিন্ন থানায় ৭০টির বেশি মামলা রয়েছে।
এ ছাড়া মনিরের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র মোহাম্মদপুর থানা ও আদালতে চাঁদাবাজি, জবরদখল, মাদক, অস্ত্র, নারী নির্যাতন, চুরিসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডের অভিযোগে অর্ধশতাধিক মামলা ও জিডি রয়েছে। বিভিন্ন মানুষের জমি দখল, বাড়ি দখল, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও বিআইডব্লিউটিএ’র জমিদখলবাজীতে অতিষ্ঠ হয়ে ভুক্তভোগীরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, পুলিশের আইজি ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন। ঢাকা উদ্যান এলাকাবাসীর কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন কালা মনির। তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কাছে জিম্মি এখানকার অধিকাংশ ব্যবসায়ী ও বাসিন্দারা।
গ্রেপ্তারের পরে মনিরুজ্জামান ওরফে কালা মনিরকে অস্ত্র মাদক আইনের মামলায় বিভিন্ন মেয়াদের রিমান্ডের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। গত শুক্রবার শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন অস্ত্র আইনে তিন দিন ও মাদক মামলায় একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ সময় মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) দুলাল হোসেন আসামিকে আদালতে হাজির করে দুই মামলায় সাত দিন করে ১৪ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত অস্ত্র মামলায় তিনদিন এবং মাদক মামলায় একদিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।
সূত্র : আমাদের সময়
আর/০৮:১৪/৮ নভেম্বর