জাতীয়

হৃদয় মণ্ডলকে মুক্তি না দিলে আমাকেও যেন গ্রেপ্তার করা হয়: জাফর ইকবাল

মুন্সীগঞ্জ, ০৮ এপ্রিল – ‌শ্রেণিকক্ষে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে করা মামলায় ১৭ দিন ধরে কারাগারে আছেন বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক তিনি। তার মুক্তি চেয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে সসম্মানে মুক্তি দিতে হবে। নইলে আমাকেও যেন গ্রেপ্তার করা হয়।

ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি এ কথা বলেন।

জাফর ইকবাল বলেন, হৃদয় মণ্ডলের সঙ্গে যা হয়েছে তা আমার জন্য অত্যন্ত দুঃখের। দুঃখের এই কারণে যে, আমি শিক্ষকতা জীবনে বিজ্ঞানই পড়িয়েছি ছাত্র-ছাত্রীদের। আরও বেশি দুঃখের কারণ এই জন্য যে, দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বইটি সম্পাদনার সঙ্গে আমি জড়িত। আমার সম্পাদনা বা রচিত একটি বই পড়ান এমন একজন শিক্ষককে করাগারে যেতে হয়েছে, এই দুঃখের কোনো শেষ নেই।

বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন গতকাল বলেন, হৃদয় মণ্ডল একজন নিরীহ মানুষ। প্রায় ২১ বছর ধরে তিনি শিক্ষকতা করেন। এর আগে কখনোই তার বিরুদ্ধে এই ধরনের কোনো অভিযোগ শুনিনি।

মুন্সীগঞ্জ জেলা শিক্ষা অফিসার বেনজীর আহমেদ বলেন, শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। শিক্ষক ও ছাত্রদের কথোপকথন পূর্বপরিকল্পিতভাবে রেকর্ড করা হয়েছে, তা বোঝা গেছে। এর বেশি বলার মতো আপাতত কিছু নেই।

প্রসঙ্গত, গত ২০ মার্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির বাংলা দ্বিতীয়পত্রের শ্রেণিশিক্ষক অনুপস্থিত ছিলেন। এ কারণে গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে ওই ক্লাসে পাঠানো হয়। তিনি বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক নিয়ে ক্লাসে আলোচনা করেন। আলোচনার সময় গোপনে তার বক্তব্যের অডিও ধারণ করা হয়। সেই অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হয়। এতে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার সময় কয়েকজন ছাত্রকে বারবার ধর্মের প্রসঙ্গ টেনে প্রশ্ন করতে শোনা যায়। হৃদয় মণ্ডল ধর্মকে ‘বিশ্বাস’ এবং বিজ্ঞানকে ‘প্রমাণভিত্তিক জ্ঞান’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।

পরে কিছু শিক্ষার্থী অভিযোগ করলে প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন আহমেদ ওই শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে তিনদিনের মধ্যে জবাব দিতে বলেন। তবে এর আগেই ২২ মার্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বহিরাগতরা শাস্তির দাবিতে স্কুলে মিছিল বের করে। প্রধান শিক্ষক বিষয়টি সদর থানা ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানানোর পর পুলিশ হৃদয় মণ্ডলকে আটক করে। এরপর ইসলাম ধর্মকে অবমাননার অভিযোগে গত ২২ মার্চ হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে মামলা করেন বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী মো. আসাদ। সেই মামলায় তিনি এখন কারাগারে আছেন।

ঘটনার পর থেকে হৃদয় মণ্ডলের পরিবার নিরাপত্তা শঙ্কায় রয়েছে বলে জানান তার স্ত্রী ববিতা হাওলাদার। তিনি বলেন, হৃদয় কোনো অপরাধ করেনি। ২২ বছর ধরে হৃদয় মণ্ডল ওই বিদ্যালয়ে গণিত ও বিজ্ঞানের ক্লাস করে আসছে। তার বিরুদ্ধে আগে কোনো অভিযোগ ওঠেনি।

ববিতা হাওলাদার বলেন, বেশ কয়েকদিন ধরে আমার ছেলেকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারছি না। ওই বিদ্যালয়ে ছাত্ররা আমার ছেলেকে আসামির ছেলে বলে ডাকছে। তারপর থেকে বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আমাদের বাসায় কেউ এলে আশপাশের লোকজন বিরূপ মন্তব্য করে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমার স্বামী কারাগারে আছেন। তিনি ডায়াবেটিসের রোগী। এখন ওষুধও খাচ্ছেন না। কয়েকদিন আগে কারাগারে গিয়েছিলাম। তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। তার চাকরির মেয়াদ আরও ৬ বছর আছে। দ্রুত জামিনে মুক্ত হয়ে যাতে বিদ্যালয়ের ফিরতে পারেন সে বিষয়ে সবার সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।

জেলার সিরাজদীখান উপজেলার মৃত নন্দলাল মণ্ডলের ছেলে হৃদয় মণ্ডল। তিনি ১৯৮২ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখান উপজেলার কুচিয়ামোড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও পরে শ্রীনগর কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পাস করেন। হৃদয় মণ্ডল তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা জগন্নাথ কলেজ থেকে গণিত বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন।

আইনজীবীরা জানিয়েছেন, ২৩ ও ২৮ মার্চ দুই দফা জামিনের আবেদন করা হলে জামিন নামঞ্জুর করেন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। এতে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের জামিন নামঞ্জুরের আদেশের বিরুদ্ধে গত ৫ এপ্রিল জেলা দায়রা জজ আদালতে জামিন চেয়ে ফৌজদারি মামলা দায়ের করেন তার আইনজীবী। এতে আদালতের বিচারক ও মুন্সীগঞ্জ সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মো. আমজাদ হোসেন আগামী ১০ এপ্রিল আসামির জামিন আবেদনের শুনানির দিন ধার্য করে আদেশ দেন।

হৃদয় মণ্ডলকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ এবং তার মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিন্দা জানিয়েছেন। এছাড়া আগামীকাল শনিবার বিকেলে রাজধানী ঢাকার শাহবাগে সমাবেশের আয়োজন করেছে নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ।

সূত্র: সমকাল
এম ইউ/০৮ এপ্রিল ২০২২

Back to top button