ইসলাম

যুগে যুগে রোজার বিধান ও ইতিহাস

কোরআনুল কারিমের ঘোষণা থেকে প্রমাণিত যে, আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে নবি-রাসুলদের ওপর রোজার বিধান দিয়েছিলেন। এ রোজা পালনের বিধান তাদের জন্যও ফরজ ছিল। আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে বিষয়টি

এভাবে তুলে ধরেছেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ کَمَا کُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ
‘হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য রোজার বিধান দেওয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববতীদের দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়ার অধিকারী হতে পারো।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)

মুসলিম উম্মাহর প্রতি রোজা ফরজ হওয়ার নির্দেশটি একটি বিশেষ দৃষ্টান্তসহ উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের প্রতি রমজানের রোজা পালনের নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, রোজা শুধু তোমাদের উপরই ফরজ করা হয়নি, বরং তোমাদের আগের নবি-রাসুলগণের উম্মতের উপরও ফরজ করা হয়েছিল।

এ নির্দেশ দ্বারা যেমন রোজার বিশেষ গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে; তেমনি মুসলিমদের এ মর্মে একটি সান্ত্বনাও দেয়া হয়েছে যে, রোজা একটা কষ্টকর ইবাদাত সত্য, তবে তা শুধু তোমাদের উপরই ফরজ করা হয়নি, যুগে যুগে তোমাদের আগের জাতিগুলোর উপরও ফরজ করা হয়েছিল। কিন্তু যুগে যুগে রোজার বিধান ও ইতিহাস কেমন ছিল?

যুগে যুগে রোজার বিধান ও ইতিহাস কেমন ছিল; তা কোরআন-সুন্নাহ ও প্রাগৈতিহাসিক বর্ণনায় ফুটে ওঠছে। ইসলামের অনুসারীদের জন্য তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-

১. পৃথিবীর প্রথম রোজা পালন
পৃথিবীতে প্রথম রোজা কে রেখেছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তরেই ওঠে এসেছে হজরত আদম আলাইহিস সালামের নাম।
কিন্তু দুনিয়ায় প্রথম কে রোজা রেখেছিলেন বা এর সংখ্যা কত ছিল? সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট দলিলভিত্তিক নির্দেশনা অস্পষ্ট হলেও কোরআনের নির্দেশনা এমন-
‘হে ঈমাদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমারে আগের লোকদের (নবি-রাসুল ও তাদের উম্মত) ওপর। যাতে তোমরা পরহেজগার হতে পার।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)

এ আয়াত দ্বারা বোঝা যায় যে, রোজা হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগের নবি-রাসুলদের জন্যও ফরজ ছিল। সে হিসেবে প্রথম নবি ও প্রথম মানুষ হজরত আদম আলাইহিস সালামই হবেন প্রথম রোজা পালনকারী। কিন্তু প্রথম রোজা রাখা এবং এর সংখ্যা কয়টি ছিল এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট দলিলভিত্তিক ঘোষণা না থাকলেও হজরত আব্দুল কাদের জিলানি রাহমাতুল্লাহি আলাইহিসহ সুফি-সাধকরা কিছু তথ্য তুলে ধরেছেন। তাহলো-

> সুফি-সাধকদের মতে, হজরত আদম আলাইহিস সালাম যখন নিষিদ্ধ ফল খেয়েছিলেন এবং তারপর তাওবাহ করছিলেন, তখন ৩০ দিন পর্যন্ত তার তাওবা কবুল হয়নি। কারণ তাঁর দেহে নিষিদ্ধ ফলের নির্যাস রয়ে গিয়েছিল। এরপর তাঁর দেহ যখন তা থেকে পাক-পবিত্র হয়ে যায়, তখন তাঁর তাওবাহ কবুল হয়। তারপর তাঁর সন্তানদের ওপরে ৩০ রোজা ফরজ করে দেওয়া হয়।

> হজরত ইবনে হাজার আসকালানি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, এ বর্ণনার প্রমাণে সনদ নেই। এর কোনো দলীল পাওয়াও কঠিন ব্যাপার। (ফতহুল বারি)

> তবে দুনিয়ায় প্রথম রোজা পালন সম্পর্কে হজরত আব্দুল কাদের জিলানি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, হজরত যির ইবনে হুবাইশ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদিন আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে আইয়্যামে বিজ (চন্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা আদম আলাইহিস সালামকে একটি ফল খেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু আদম আলাইহিস সালাম সেই ফল খেয়ে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় নেমে আসতে বাধ্য হন। সে সময় তাঁর শরীরের রং কালো হয়ে যায়। ফলে তাঁর দুর্দশা দেখে ফেরেশতারা কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন-

‘হে আল্লাহ! আদম আপনার প্রিয় সৃষ্টি। আপনি তাঁকে জান্নাতে দিয়েছিলেন। আমাদের দ্বারা তাঁকে সেজদাও করিয়েছেন। আর একটি মাত্র ভুলের জন্য তার দেহের রং কালো করে দিলেন?
তাদের এ আবেদনে আল্লাহ তাআলা হজরত আদাম আলাইহিস সালামের কাছে ওহি পাঠালেন- তুমি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা রাখ। আদম আলাইহিস সালাম তাই করলেন। ফলে তাঁর দেহের রং আবার উজ্জ্বল হয়ে যায়। এ জন্যই এ তিনটি দিনকে আইয়্যামে বিজ বা উজ্জ্বল দিন বলা হয়।’ (গুনইয়াতুত ত্বলিবিন)

এ ঘটনায়ও কোরআন-সুন্নাহর কোনো ব্যাখ্যা বা মতামত সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপিত হয়নি। তবে হাদিসে এসেছে-
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘরে কিংবা সফরে থাকাকালীন সময়ে আইয়্যামে বিজ-এর রোজা রাখা থেকে বিরত থাকতেন না।’ (নাসাঈ, মিশকাত)

তবে এ কথা সুস্পষ্ট যে, রোজা শুধু উম্মতে মুহাম্মাদির ওপরই ফরজ হয়নি বরং আগের নবি-রাসুলদের ওপরও রোজার বিধান ছিল। কোরআনুল কারিমের ঘোষণাই এর প্রমাণ।

২. হজরত নূহ আলাইহিস সালামের রোজা
আদম আলাইহিস সালামের পর নবুয়ত ও রেসালাতের মহান দায়িত্ব নিয়ে পৃথিবীতে আসেন হজরত নুহ আলাইহিস সালাম। তিনি দুনিয়ার প্রথম রাসুল ছিলেন। তাঁকে দ্বিতীয় আদমও বলা হয়। তাঁর ওপরও রোজার বিধান ছিল।

মুসলিম উম্মাহর জন্য শুধু রমজান মাস রোজা পালন করা ফরজ। অথচ হাদিসের বর্ণনা থেকে জানা যায়, নুহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বছরে ২ দিন ছাড়া সারা বছর রোজা পালন করতেন। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘হজরত নূহ আলাইহিস সালাম শাওয়াল মাসের ১ তারিখ (ইয়াওমুল ফিতর) এবং জিলহজ মাসের ১০ তারিখ (ইয়ামুল আজহা) ছাড়া গোটা বছর রোজা রাখতেন।’ (ইবনে মাজাহ)

হজরত নুহ আলাইহিস সালামের সময় রোজার বিধান সম্পর্কে তাফসিরে ইবনে কাসিরে একটি তথ্য এসেছে-
হজরত মুয়াজ, ইবনে মাসউদ, ইবনে আব্বাস, আতা, কাতাদাহ ও যাহহাক রাদিয়াল্লাহু আনহুম বর্ণনা করেন, নুহ আলাইহিস সালামের যুগে প্রত্যেক মাসে ৩টি রোজা রাখা ফরজ ছিল। পরে আল্লাহ তাআলা রমজানের এক মাস রোজার বিধান দেয়ার মাধ্যমে তা (প্রত্যেক মাসের ৩ দিনের রোজা) রহিত করে দেন।’ (ইবনে কাছির)

অন্য বর্ণনায় এসেছে-
হজরত নুহ আলাইহিস সালামের যুগ থেকে হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ পর্যন্ত রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে কমপক্ষে ৩টি করে রোজা ফরজ ছিল।’ (ইবনে কাছির)

৩. হজরত ইবরাহিম আলাহিস সালাম ও পরবর্তী যুগের রোজা
হজরত নূহ আলাইহিস সালামের পর সর্বাধিক পরিচিত নবি ছিলেন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম। কোরআনের ঘোষণায় তিনি মুসলিম জাতির পিতা। আল্লাহ তাআলা তাকে খলিল তথা বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, তাঁর যুগেও ৩০টি রোজা রাখা আবশ্যক ছিল।

তাঁর পরের যুগকে বলা হতো বৈদিক যুগ। সে ধারাবাহিকতায় বেদের অনুসারী ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যেও ব্রত তথা উপবাস প্রথা চালু ছিল। তারা প্রত্যেক হিন্দি মাসের ১১ তারিখে ব্রাহ্মণদের ওপর একাদশী’র উপবাস করতো।

পরবর্তী যুগে মূর্তি পূজারী ব্রাহ্মণরাও ব্রত বা উপবাস করতেন। তারা কার্তিক মাসের প্রত্যেক সোমবার উপোস থাকতেন। মূর্তি পূজারি হিন্দু যুগীরা ৪০ দিন পানাহার ত্যাগ করে চল্লিশে ব্রত পালন করতো।

মূর্তি পূজারী হিন্দুদের মতো জৈন সম্প্রদায়ের লোকেরাও উপবাস করতো। তাদের মতে, ৪০ দিন ধরে একটি করো উপবাস হয়। গুজরাট ও দাক্ষিনাত্যের জৈনরা কয়েক সপ্তাহ ধরে একটি করে উপবাস করে।

প্রাচীন মিসরীয়রাও উপবাস করতো। প্রাচীন গ্রীসে শুধু নারীরা থিমসোফিয়ার ৩ তারিখ উপবাস করতো। ফার্সিয়ানতের ধর্মগ্রন্থের এক শ্লোক দ্বারা জানা যায়, তাদের ধর্মেও উপবাস ছিল। বিশেষ করে তাদের ধর্মগুরুদের জন্য পাঁচ সালা উপবাস আবশ্যক ছিল। (ইনসাইক্লোপেডিয়া অফ ব্রিটেনিকা)

৪. হজরত মুসা আলাইহিস সালামের রোজা
হজরত ইবরাহিম আলাহিস সালামের পর সর্বাধিক পরিচিত আসমানি কিতাবধারী নবি ছিলেন হজরত মুসা আলাইহিস সালাম। তাঁর যুগেও রোজার বিধান ছিল। তিনিও রোজা পালন করেছেন। আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা আলাইহিস সালামকে আসমানি কিতাব ‘তাওরাত’ নাজিল করার আগে ৪০ দিন রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। হজরত মুসা আলাইহিস সালাম তুর পাহাড়ে রোজা পালনে ক্ষুধা ও পিপাসায় ৪০ দিন অতিবাহিত করেছিলেন।

সে হিসেবে মুসা আলাইহিস সালামের অনুসারীরা ৪০ দিন পর্যন্ত রোজা পালনকে উত্তম বলে বিবেচনা করতেন। ৪০তম দিনে রোজা রাখাকে তারা ফরজ তথা আবশ্যক মনে করতো। আর তা ছিল তাদের সপ্তম মাসের (তাশরিন) দশম তারিখ। এ দশম দিন ছিল তাদের কাছে আশুরা।

আশুরার দিনে আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা আলাইহিস সালামকে ১০ আহকাম দান করেছিলেন। আর এ কারণেই তাওরাতে ১০ তারিখ রোজা পালনের জন্য জোর তাগিদ করা হয়। এছাড়াও ইয়াহুদিদের অন্যান্য ছহিফাগুলোতেও অন্যান্য দিনে রোজা পালনের হুকুম পাওয়া যায়।

এছাড়াও হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ বুখারি ও মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে-
হজরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় (হিজরত করে) এসে ইয়াহুদিদের আশুরার দিন (মুহররমের ১০ তারিখ) রোজা অবস্থায় দেখতে পেলেন। তাই তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, আজকে তোমরা কিসের রোজা করছো?
তারা বলল, এটা সেই মহান দিন; যেদিন মহান আল্লাহ হজরত মুসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর কাওমকে মুক্ত করেছিলেন। আর ফেরাউন ও তার জাতিকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন।
ফলে শোকরিয়া স্বরূপ মুসা আলাইহিস সালাম ঐদিন রোজা রেখেছিলেন। তাই আমরা আজকে ঐ রোজা করছি।’ (বুখারি ও মুসলিম)

আর তাতেও প্রমাণিত হয় যে, মুসা আলাইহিস সালামের যুগে এবং তার আগে ও পরে ইয়াহুদিদের মধ্যে রোজার প্রচলন ছিল।

৫. হজরত দাউদ (আ.)-এর রোজা
হজরত দাউদ আলাইহিস সালাম সবচেয়ে বেশি রোজা পালনকারী নবি ছিলেন। যুগে যুগে যত নবি-রাসুল রোজা পালন করেছেন, তাদের মধ্যে হজরত দাউদ আলাইহিস সালাম অন্যতম। হজরত মুসা আলাইহিস সালামের পর তাঁর কিতাবের অনুসারী নবি ও শাসক হজরত দাউদ আলাইহিস সালাম রোজা পালন করেছেন। তাঁর রোজা পালন ছিল আল্লাহর কাছে অধিক পছন্দনীয়। কেমন ছিল তাঁর রোজা পালন? কেন তাঁর রোজা পালন ছিল আল্লাহর কাছে সর্বাধিক পছন্দের?

হজরত মুসা আলাইহিস সালামের শরিয়তকে নতুন জীবন দান করেছিলেন হজরত দাউদ আলাইহিস সালাম। তিনি একাধারে নবি ও শাসক ছিলেন। কেননা হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের নবুয়তের আগে বনি ইসরাইলের এক বংশের কাছে থাকত নবুয়তের দায়িত্ব আর অন্য বংশ পালন করতো রাজত্ব। হজরত দাউদ আলাইহিস সালামই একমাত্র নবি; যিনি সর্বপ্রথম একসঙ্গে নবুয়ত ও রাজত্ব লাভ করেছিলেন।

হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের রোজা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি পছন্দনীয় ছিল। তাঁর কণ্ঠে ছিল সুরের জাদু। তাঁর কণ্ঠে আসমানি কিতাবের তেলাওয়াত ছিল চমৎকার। তার রোজা পালন সম্পর্কে হাদিসে পাকে সুস্পষ্ট বর্ণনা ওঠে এসেছে-

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে সবচেয়ে প্রিয় রোজা হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের রোজা। তিনি একদিন রোজা রাখতেন এবং একদিন বিনা রোজায় থাকতেন।’ (নাসাঈ, বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)

অর্থাৎ হজরত দাউদ আলাইহিস সালাম সবচেয়ে বেশি রোজা পালন করতেন। তিনি বছরের অর্ধেক দিন রোজা রাখতেন। একদিন পর একদিন তিনি রোজা পালন করতেন। এ জন্য আল্লাহর কাছে হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের রোজা সবচেয়ে বেশি প্রিয় ছিল বলে উল্লেখ করেছেন স্বয়ং বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

৬. হজরত ঈসা (আ.)-এর রোজা পালন
হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের পর আসমানি কিতাবধারী বিশিষ্ট নবি ও রাসুল ছিলেন হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম। তাঁর যুগে এবং তাঁর জন্মের আগেও রোজা বিধান প্রচলনের প্রমাণ পাওয়া যায়। হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম রোজা পালন করতেন। ঈসা আলাইহিস সালামের যুগে রোজার রাখার প্রমাণ কোরআনের বর্ণনায় প্রমাণিত-

‘فَقُولِي إِنِّي نَذَرْتُ لِلرَّحْمَنِ صَوْمًا فَلَنْ أُكَلِّمَ الْيَوْمَ إِنسِيًّا
‘তবে বলে দাও, আমি আল্লাহর উদ্দেশে রোজা মানত করছি। সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলব না।’ (সুরা মারইয়াম : আয়াত ২৬)

তিনি জঙ্গলে বা বনে ৪০ দিন রোজা পালন করেছেন। নিজেকে আসমানি কিতাবের ধারক হিসেবে তৈরি করতে হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম কিতাব আসার আগে দীর্ঘ ৪০ দিন পর্যন্ত রোজা রেখেছিলেন।

৪০ দিন রোজা পালনের পর আল্লাহ তাআলা হজরত ঈসা আলাইহিস সালামকে আসমানি গ্রন্থ ইঞ্জিল দান করেন। আর খ্রিস্টান ধর্মে এখনও রোজা রাখার প্রভাব বিদ্যমান রয়েছে।

হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের সঙ্গীরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে- ‘আমরা পবিত্র আত্মাকে কিভাবে বের করব? উত্তরে তিনি বলেছিলেন- তা দোয়া এবং রোজা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে তা কখনো বের হতে পারে না।’

হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের রোজা সম্পর্কে সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী উল্লেখ করেছেন যে-
‘হজরত মুসা আলাইহিস সালামের যুগে যে রোজা ফরজের পর্যায়ে ছিল ঈসা আলাইহিস সালাম নিজের রোজার ব্যাপারে নতুন করে কোনো বিধিনিষেধ দিয়ে যাননি। তিনি শুধু সিয়ামের নীতি ও কিছু নিয়ম বর্ণনা করেছেন এবং তার ব্যাখ্যা ও সমন্বয়ের ভার গির্জাওয়ালাদের ওপর ছেড়ে দেন।

খ্রিস্টীয় ২য় থেকে ৫ম শতকের মধ্যে খ্রিস্টানদের রোজার নিয়ম-কানুন তৈরির বেশিরভাগ কাজ সম্পন্ন হয়। ওই সময় ইস্টারের আগে দুইদিন রোজা রাখার জন্য নির্দিষ্ট ছিল। ওই দুইটি রোজাই অর্ধেক রাতে এসে শেষ হতো। আর ওই দিন যারা অসুখে থাকতো; তারা শনিবার রোজা পালন করতে পারতো।

খ্রিস্টীয় ৩য় শতকে রোজার দিন নির্দিষ্ট করা হয়। সে সময় আবার ইফতারের সময় নিয়েও মতভেদ ছিল। কেউ মোরগ ডাক দিলে ইফতার করতো। আবার অন্ধকারে খুব ছেয়ে গেলে ইফতার করতো।

আবার খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকে এসে ৪০টি রোজা পালনের তথ্য পাওয়া যায়। রোমানদের রোজা, আলেকজান্দ্রিয়া লাসানদের গির্জাগুলো রোজা দিন নির্দিষ্ট করে। কিন্তু রোজা নিয়মাবলী ও বিধিনিষেধ রোজাদার ব্যক্তির বিবেক ও দায়িত্বানুভূতির ওপর ছেড়ে দেয়া হয়।

তবে ইংল্যান্ডে ষষ্ঠ এর্ডওয়াড ও প্রথম ইলিজাবেথের যুগে তাদের দেশে রোজার সময় গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ করে। তার এর কারণ হিসেবে বর্ণনা করেন যে- ‘মাছ শিকার ও সামুদ্রিক বাণিজ্যের বিষয়ে উপকৃত হওয়া একান্ত দরকার।

রোজার গুরুত্ব সম্পর্কে হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের বর্ণনা
হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে তার অনুসারীরা জিজ্ঞাসা করতো যে, আমরা আমাদের অপবিত্র আন্তরসমূহকে পূতপবিত্র করতে কী করতে পারি? বা কিভাবে অন্তরসমূহকে অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করতে সক্ষম হবো?

হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম তাদেরকে বলেছিলেন, ‘অন্তরসমূহের কলুষতা ও অপবিত্রতাকে পবিত্র রাখতে রোজা এবং দোয়ার বিকল্প নেই। অন্তর পবিত্র করতে রোজা রাখার নসিহত করেছিলেন।

৭. হজরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালামের রোজা
হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের সমসাময়িক নবি ছিলেন হজরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম। তিনি নিজে রোজা রাখতেন এবং তার অনুসারীগণের মধ্যেও রোজা রাখার রীতি বিদ্যমান ছিল।

যুগে যুগে রোজা পালনের ধরণ যেমনই হোক না কেন, ইসলাম দিয়েছে রোজার সুন্দর ও যুযোগযোগী বিধান। কোরআন-সুন্নায় ঘোষিত হয়েছে রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাত পাওয়ার উপায়।

প্রিয়নবির ঘোষণায় রোজার গুরুত্ব
রোজার গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি সিয়াম পালন করেও মিথ্যা কথা বলা, পরনিন্দা ও অন্যান্য পাপাচার থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলো না; তার পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বুখারি)

এ কারণে পূর্ববর্তী যুগের সব নবি-রাসুলদের সময়ও এ কথার ঘোষণা ছিল যে, তোমরা যখন রোযা রাখবে তখন লোক দেখানো মনোবৃত্তি নিয়ে মানুষের মত নিজেদের মুখমন্ডলকে উদাস করে রাখবে না। কেননা, এই শ্রেণীর মানুষ নিজেদের মুখমন্ডলের আসল রূপ বিকৃত করে রোজাদার রোজাদার ভাব গ্রহণ করতো। যাতে মানুষ মনে করে যে তারা রোজাদার।

প্রাক ইসলামি যুগে আরবাসীরাও রোজা সম্পর্কে ওয়াকিফ হাল ছিল এবং তা পালনে সক্রিয় ছিল। মক্কার কুরাইশরা জাহেলিয়াতের যুগে ১০ মহররম রোজা রাখতো। এ দিনে পবিত্র কাবায় নতুন কিসওয়া বা গিলাফ পরিধান করানো হতো। (মুসনাদে আহমদ)

‘প্রাক ইসলামি যুগে মদিনার ইয়াহুদিরাও পৃথক পৃথকভাবে আশুরার উৎসব ও রোজা পালন করতো।’ (বুখারি)

তাদের রোজা পালনের দিনক্ষণ ছিল তাদের নিজেদের গণনার সপ্তম মাসের ১০ম দিন। প্রিয়নবি মদিনায় হিজরতের পরও ইয়াহুদিরা রোজা পালন করতেন। যা দেখে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, তোমাদের চেয়ে আমরাই এ রোজ রাখার হকদার বেশি।

সুতরাং মুমিন মুসলমানের আত্মায় তাকওয়ার বীজ বপনে রোজার বিকল্প নেই। রোজা রাখলেই মানুষ মুত্তাকি হয়ে যায়। রোজা মানুষকে মুত্তাকি হতে প্রস্তুত করে। আল্লাহর ভয় অর্জন করে পরিশুদ্ধ জীবন গঠনের অন্যতম প্রশিক্ষণও এ রোজা পালন।

যেভাবে যুগে যুগে সব নরি-রাসুল রোজা পালনের মাধ্যমে নিজেদেরকে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে তৈরি করেছিলেন। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা রোজার বিধানে আগের লোকদের ওপর রোজা ফরজে কথা উল্লেখ করেছেন এবং তাকওয়ার অধিকারী হওয়ার বিষয়টিই ওঠে এসেছে কোরআনে-
‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেভাবে তোমাদের আগের লোকদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে তোমার তাকওয়াবান হতে পার।’ (সুরা বাক্বারা : আয়াত ১৮৩)

যুগে যুগে রোজার বিধানের ধারাবাহিকতায় উম্মতে মুসলিমদের ওপর একটানা এক মাস রোজা পালন ফরজ করেছেন মহান আল্লাহ। যে মাসে তাদের হেদায়েত পাওয়ার জন্য দান করেছেন কোরআন। কোরআনের অনুসারী প্রাপ্ত বয়স্ক মুমিন মুসলমান এ মাসটি পেলেই রোজা রাখতে হবে মর্মে ঘোষণা এসেছে এভাবে-

‘রমজান মাসই হলো সে মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসব্যাপী রোজা রাখবে।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)

কোরআন-সুন্নাহর বর্ণনায় এ কথা সুস্পষ্ট যে, রোজা শুধু উম্মতে মুহাম্মাদির ওপরই ফরজ হয়নি বরং আগের নবি-রাসুলদের ওপরও রোজার বিধান ছিল। শুধু তা-ই নয়, হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের পরবর্তী যুগে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এ রোজা রাখার প্রচলন অব্যাহত ছিল। যারা নিজ নিজ ধর্মানুসারে ব্রত বা উপবাস করতো।

আল্লাহ তাআলা উম্মতে মুসলিমার জন্য এ রোজার বিধান ফরজ করেছেন। আর রমজানের উম্মতে মুহাম্মাদির জন্য রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাতের মাস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রমজান মাসের রোজা পালনের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন করার তাওফিক দান করুন। রমজানের রোজা থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে চূড়ান্ত রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাত পাওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এম এস, ০২ এপ্রিল

Back to top button