অপরাধ

অ্যামাজন-আলীবাবার মতো ব্যবসার আইডিয়া, প্রতারণা ইভ্যালির মতো

ঢাকা, ২১ মার্চ – একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ার সময় ব্যবসা করার পরিকল্পনা করে মো. মশিউর রহমান ওরফে সাদ্দাম। তার মাথায় অনলাইনে ই-কমার্স ব্যবসার আইডিয়া আসলে অ্যামাজন, আলীবাবার মতো অনলাইনে ব্যবসার ইচ্ছা হয়। এর জন্য ২০১৯ সালে আকাশনীল কোম্পানি নামে ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেইজ তৈরি করে রাজধানীর কাঠাল বাগান এলাকায় একটি অফিস চালু করে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং কৃষকদের কাছ থেকে শাকসবজি কিনে অনলাইনে হোম ডেলিভারি দেয়ার ব্যবসা শুরু করে। তবে করোনা মহামারীর কারণে তার ব্যবসা সচল রাখতে পারেনি। এরপর তার চিন্তারও পরিবর্তন হয়।

ইভ্যালিসহ অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন মোটরসাইকেলের অফার দিয়ে যখন রমরমা ব্যবসা শুরু করেছিল তখন সে এই ধরনের ব্যবসা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০২১ সালের জুন মাসে মোটরসাইকেলভিত্তিক অফারে ব্যবসা দিয়ে পুনরায় তারা যাত্রা শুরু করে। এরপর লোভনীয় অফারের গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে লাপাত্তা হয়ে যায়।

লোভনীয় অফার দিয়ে গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে লাপাত্তা হওয়া ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘আকাশ নীল’ এর প্রতারণার মূলহোতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান ও প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান রনি’কে ফরিদপুর ও রাজধানী ঢাকা থেকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।

রোববার রাতে রাজধানী ঢাকা ও ফরিদপুর থেকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আকাশনীলের এমডি মো. মশিউর রহমান ওরফে সাদ্দাম (২৮) এবং পরিচালক ইফতেখাইরুজ্জামান রনিকে (৩২) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযানের সময় ২টি মোবাইল ফোন, ২টি ল্যাপটপ এবং ১টি প্রাইভেটকার উদ্ধার করা হয়।

সোমবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদে র‍্যাব জানায়, আকাশনীলের কারসাজির মূলহোতা গ্রেপ্তার মো. মশিউর। তার ব্যবসায়িক অবকাঠামো সম্পর্কে জানায় যে, তার মাথায় অনলাইনে ই-কমার্স ব্যবসার আইডিয়া আসলে অ্যামাজন, আলীবাবার মত অনলাইনে ব্যবসা করার ইচ্ছা হয়। এরপর ২০১৯ সালে আকাশনীল কোম্পানী নামে ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেইজ তৈরি করে এবং ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করে। প্রথমে তারা রাজধানীর কাঠাল বাগান এলাকায় একটি অফিস চালু করে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং কৃষকদের কাছ থেকে শাকসবজি কিনে অনলাইনে হোম ডেলিভারি দেয়ার ব্যবসা শুরু করে। তবে করোনা মহামারীর কারণে তার ব্যবসা সচল রাখতে পারেনি। সে ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ এর মে মাস পর্যন্ত ব্যবসা না করার কারণে তার যে পুঁজি দিয়ে অফিস সাজিয়ে ছিল তাতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, পরবর্তীতে সে মানুষের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে অর্থ নিয়ে তার কোম্পানিকে লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করে কাঠাল বাগান থেকে পান্থপথে স্থানান্তরিত করে। তার লিমিটেড কোম্পানি ছিল পরিবারকেন্দ্রিক ব্যবসা যাতে তার নিজের নামে ৭৭%, বোনের নামে ১০%, মাতার নামে ৮% এবং তার স্ত্রীর নামে ৫% শেয়ার রেখেছিল। তার এই পরিবারকেন্দ্রিক ব্যবসায় সে ছিল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, মা ছিলেন চেয়ারম্যান এবং তার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত বন্ধু ইফতেখাইরুজ্জামান রনি ছিল ডিরেক্টর।

তিনি বলেন, ইভ্যালিসহ অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন মোটরসাইকেলের অফার দিয়ে যখন রমরমা ব্যবসা শুরু করেছিল তখন সে এই ধরনের ব্যবসা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০২১ সালের জুন মাসে মোটরসাইকেলভিত্তিক অফারে ব্যবসা দিয়ে পুনরায় তারা যাত্রা শুরু করে। গ্রাহকদের আকৃষ্ট হওয়ার মূল কারণ ছিল স্বল্প মূল্যে বা ডিসকাউন্টে প্রতিটি মোটর সাইকেলে সর্বোচ্চ ৩০% পর্যন্ত মূল্য ছাড় দিয়ে থাকেন। এই ডিসকাউন্টের জন্যই সাধারণত গ্রাহকরা আকৃষ্ট হতো এবং গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার জন্য হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ মেইনটেন করতো। গ্রুপে সে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন সময়ে আশার বাণী, লোভনীয় অফার এবং মোটিভেশনাল বক্তব্য প্রদান করত।

র‍্যাব মুখপাত্র বলেন, গ্রেপ্তাররা ১ম ক্যাম্পেইন করেছিল গত বছরের মে মাসে যাতে ৩০% ছাড়ে ২ মাসের মধ্যে ডেলিভারির আশ্বাসে ২ শতাধিক মোটর সাইকেলের অর্ডার পায়। পরবর্তী ক্যাম্পেইনে জুলাই মাসে ২৫% ডিসকাইন্টে ৪৫ দিনের মধ্যে ডেলিভারির নিশ্চয়তায় ১ হাজারের অধিক মোটর সাইকেলের অর্ডার পায়। এরপর গত আগস্ট মাসে সে মোটর সাইকেলের ৩য় ক্যাম্পেইনে ২৩% ছাড়ে ২৫ দিনের মধ্যে সরবরাহের আশ্বাসে ৯ হাজারের বেশি মোটর সাইকেলের অর্ডার পায়। মোটর সাইকেলের পাশাপাশি সে লোভনীয় ছাড়ে মোবাইল, ইলেকট্রনিক্স পন্য, গৃহস্থলির অন্যান্য পণ্য বিক্রি নিয়েও অফার দেয়। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইভ্যালিসহ অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযানের ফলে গ্রাহকরা তাদের প্রদানকৃত অর্থ ফেরত চাইতে থাকে। গ্রাহকদের এমন চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় গত নভেম্বরে গ্রেপ্তার মশিউর অফিস বন্ধ করে দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়।

র‍্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, তার এই কোম্পানিতে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার গ্রাহক ছিল তবে সর্বশেষ যে মোটর সাইকেলের অফারটি দিয়েছিল সেখানে ছাত্র বা যুব সমাজের গ্রাহকরাই মোটর সাইকেলের অফারটি গ্রহণ করেছিল। তার ব্যবসার মধ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন ইলেক্ট্রনিক দ্রব্য, পাওয়ার ব্যাংক, হেডফোন, মোবাইল সেট এবং মোটর সাইকেল ছিল। তার সাপ্লাই দেয়ার সিস্টেম ছিল ডিলার থেকে নগদ টাকায় মালামাল কিনে সরাসরি তার নিজের অফিসে নিয়ে আসতো। তার প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোন গোডাউন ছিল না। তার অফিস থেকে বিভিন্নভাবে কুরিয়ার সাভির্সের মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে পণ্য পৌঁছে দেয়া হতো।

র‍্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, গ্রাহকদের টাকাগুলো সরাসরি তার ব্যাংকের একাউন্টে জমা হতো এবং সেখান থেকে তা উত্তোলন করত। অন্যান্য ই-কমার্স ব্যবসার মতো গেটওয়ে সিস্টেম থাকলেও সরাসরি গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হতো। ই-কমার্স নীতিমালার কারণে পণ্য ডেলিভারি না হলে টাকা গেটওয়েতে আটকে থাকার কারণে সেসব টাকা গ্রাহকদের রিফান্ড করা হতো।

সরাসরি ব্যাংক একাউন্টে প্রদানকৃত অর্থ নিয়ে তারা প্রতারণা করত তারা-

গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে র‍্যাব জানায়, এই প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ৪০ জন অস্থায়ী কর্মচারী নিয়োগ ছিল। যাদের মাসিক ৪-৫ লাখ টাকা বেতন দেয়া হতো। তারা কোম্পানির অর্থে ধানমন্ডিতে একটি ফ্ল্যাট আছে যার বর্তমান মূল্য ৩ কোটি টাকা, ২টি দামি গাড়ী, একটি প্রিয়াশ ও একটি সিএইচআর ব্যবহার করেন। এছাড়া কোম্পানির প্রায় ৪টি টাটা পিকআপ রয়েছে। বর্তমানে গ্রাহকদের কাছে দেনা প্রায় ৩০ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্যাংকে তার ৪টি একাউন্টের তথ্য পাওয়া গেছে। কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে লোকসানী কোম্পানী; কোন ব্যবসায়িক লাভ করতে পারেনি। গ্রাহকের অর্থ দিয়েই যাবতীয় ব্যয় ও খরচ নির্বাহ করা হত। ফলে দেনা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।

ব্যবসায়িক বিক্রি বাড়াতে গ্রাহকদের প্রতিনিয়ত চাহিদা তৈরী হয়। যেমন- মোবাইল, টিভি, ফ্রিজ, মোটরবাইক, গাড়ী, গৃহস্থলীপণ্য, ইত্যাদি। জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, এহেন পণ্যের মূল্য ছাড়ের ফলে ব্যাপক চাহিদা তৈরী হয়।

গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে খন্দকার মঈন জানান, ব্যবসায়িক অপকৌশল ছিল নতুন গ্রাহকের উপর দায় চাপিয়ে দিয়ে পুরাতন গ্রাহক ও সরবরাহকারীর দায়ের আংশিক করে পরিশোধ করা। অর্থাৎ “দায় ট্রান্সফার” এর মাধ্যামে দুরভিসন্ধিমূলক অপকৌশল চালিয়ে যাচ্ছিল আকাশনীল প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির নেটওয়ার্কে যত গ্রাহক তৈরী হত, দায় তত বৃদ্ধি পেত। গ্রেপ্তার মশিউর জেনেশুনে এই নেতিবাচক এগ্রেসিভ স্ট্র্যাটিজি গ্রহণ করেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন।

র‍্যাব আরও জানায়, আকাশনীলের অন্যতম কর্ণধার মশিউর ও তার সহযোগী ইফতেখাইরুজ্জামান রনি। আকাশনীল পরিকল্পিতভাবে একটি পরিবার নিয়ন্ত্রিত ব্যবসায়িক গঠনতন্ত্র। একক সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বেচ্ছাচারিতা করার অবকাশ রয়েছে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি রয়েছে। ফলে ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠানের দায় বৃদ্ধি হতে হতে বর্তমানে প্রায় অচলাবস্থায় উপনীত হয়েছে। আকাশনীলের নেতিবাচক ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটিজি উন্মোচিত হওয়ায় অনেক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও অর্থ ট্রানজেকশন গেটওয়ে আকাশনীল থেকে সরে এসেছে। ব্যবসায়িক উত্তরণ নিয়ে সন্ধিহান গ্রেপ্তাররা। এখন পর্যন্ত উত্তরণের কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি তারা।

র‍্যাব মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেন, আকাশনীলের কারসাজির মূলহোতা মো. মশিউর যিনি প্রতিষ্ঠানটির এমডি এবং তার সহযোগী গ্রেপ্তার ইফতেখাইরুজ্জামান রনি (পরিচালক)। গ্রেপ্তার মো. মশিউর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ অধ্যায়নরত থাকাকালীন সময় সে একটি ব্যবসা করার পরিকল্পনা করে। ব্যবসা হিসাবে সে প্রথমে গার্মেন্টস থেকে রিজেক্টেড টি-শার্ট/গার্মেন্টস পণ্য এনে নিউ মার্কেট এলাকায় বিক্রি করত।

সূত্র : বাংলাদেশ জার্নাল
এন এইচ, ২১ মার্চ

Back to top button