জাতীয়

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ: বাংলাদেশী কিছু গণমাধ্যমকে দুষলেন রুশ রাষ্ট্রদূত

ঢাকা, ১৪ মার্চ – গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা চালায় রাশিয়া। এরপর ১৭ দিন হয়ে গেলো যুদ্ধ এখনো চলছে। যুদ্ধের খবর প্রকাশ করছে পশ্চিমা অনেক সংবাদমাধ্যম। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমও দিচ্ছে খবর।

তবে দেশের কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন সংক্রান্ত খবরগুলো নিয়ে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশে অবস্থিত রুশ দূতাবাস। তারা বলছে, বাংলাদেশের কয়েকটি সংবাদমাধ্যম পশ্চিমা গণমাধ্যমের মতো পক্ষপাতদুষ্ট খবর প্রচার করছে।

রোববার (১৩ মার্চ) বাংলাদেশে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার ভি মানতিতস্কি সই করা এক খোলা চিঠিতে এই অভিযোগ করা হয়। একই সঙ্গে ওই চিঠিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান নিয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।

চিঠিতে রুশ রাষ্ট্রদূত বলেন, আমি ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমা সংবাদ সংস্থা, প্রকাশনা ও ইউরোপ-আমেরিকার লেখা সংগ্রহ করেছি। সেসব লেখায় রয়েছে রুশবিরোধী প্রোপাগান্ডা। কখনো কখনো ওই সব লেখায় এমন কিছু প্রচার করা হয়েছে, যেগুলো পক্ষপাতমূলক।

তিনি আরও বলেন, পশ্চিমারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমের দেখাদেখি বাংলাদেশেও নির্দিষ্ট কয়েকটি সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে এ ধরনের প্রচারণা চালাচ্ছে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার ভি মানতিতস্কি বলেন, কিয়েভে বসবাসরত রুশ ভাষাভাষীদের ওপর দীর্ঘ আট বছর ধরে গণহত্যা চালাচ্ছে ইউক্রেন। আমরা তা প্রতিহত করতে চাই। অবসান চাই নব্য ফ্যাসিবাদের। ইউক্রেনে পরমাণু অস্ত্রের বিস্তার রোধ করতে চাই। সেই সঙ্গে দেশটিতে ন্যাটোর সামরিক ঘাঁটি স্থাপন রুখতে চাই।

জাতিসংঘ সনদের ৫১ ধারার সপ্তম অধ্যায় অনুসরণ করে এবং রাশিয়ার পার্লামেন্টের অনুমতি নিয়ে ইউক্রেনে রুশ বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে বলে চিঠিতে দাবি করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত।

তিনি চিঠিতে লিখেন, ইউক্রেনের সঙ্গে আমরা যুদ্ধে লিপ্ত নই। রাশিয়ার নিরাপত্তা হুমকির মুখে থাকায় আমরা এই অবস্থান নিয়েছি।

যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে রুশ রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার ভি মানতিতস্কি বলেন, তারা সামরিক অস্ত্র আমাদের সীমান্তের কাছে নিয়ে আসছে। এতো কিছু সত্ত্বেও, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আমরা ইউরোপীয় নিরাপত্তা ও ন্যাটোর অ-সম্প্রসারণের নীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমাদের চেষ্টা বৃথা ছিল। যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান পরিবর্তন করেনি।

তিনি আরও লেখেন, ৩০ বছর ধরে আমরা ইউরোপে সমান এবং অবিভাজ্য নিরাপত্তার নীতির বিষয়ে ন্যাটো দেশগুলোর সঙ্গে একটি চুক্তিতে আসার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমরা সব সময়ই নিষ্ঠুর প্রতারণা, মিথ্যাচার অথবা ব্ল্যাকমেইলের মুখোমুখি হয়েছি। আমাদের প্রতিবাদ এবং উদ্বেগ সত্ত্বেও উত্তর আটলান্টিক জোট এই অঞ্চলে সম্প্রসারিত হয়েছে।

রাশিয়ার নিরাপত্তা-হুমকির দিক নিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, শেষ পর্যন্ত, ন্যাটো দাবি করেছে যে, ইউক্রেনকে ব্লকে যোগদানের জন্য স্বাধীন হতে হবে। ইউক্রেনে স্থাপন করা হচ্ছে নৌঘাঁটি। এমনকি রাশিয়ান ফেডারেশনের জন্য সরাসরি হুমকি হতে পারে এমন ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এছাড়া ইউক্রেনকে পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র করার পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল।

চিঠিতে আরও বলা হয়, বিশেষ সামরিক অভিযানের সময়, রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এমন নথি তুলে ধরেছিল যে, যা নিশ্চিত করে ইউক্রেনের কিয়েভ, লিভভ, খারকভ, ডিনিপ্রো, খেরসন, টারনোপোল, উজগোরড, ভিনিতসিয়াতে কমপক্ষে ৩০টি জৈবিক পরীক্ষাগার এবং গবেষণা কেন্দ্রের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। পেন্টাগনের ন্যাশনাল সেন্টার ফর মেডিকেল ইন্টেলিজেন্সের স্বার্থে যেগুলোর অর্থায়ন করছে যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স থ্রেট রিডাকশন এজেন্সি (ডিটিআরএ)।

রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বলেন, উল্লিখিত ইউক্রেনীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো অত্যন্ত বিপজ্জনক জৈবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকে। যার লক্ষ্য- প্লেগ, অ্যানথ্রাক্স, টুলারেমিয়া, কলেরার জীবাণু বৈশিষ্ট্য বাড়ানোর পাশাপাশি পরিযায়ী পাখির মাধ্যমে বিপজ্জনক সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা নিয়ে অধ্যয়ন করা। এর মধ্যে রয়েছে অত্যন্ত প্যাথোজেনিক এইচ৫এন১ ইনফ্লুয়েঞ্জা (৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে মানুষের জন্য প্রাণঘাতী) এবং সিনথেটিক জীববিজ্ঞানের সাহায্যে নিউক্যাসল রোগ।

ইউক্রেনের এসব গবেষণাগারে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাল প্যাথোজেনগুলোর অধ্যয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল বলে জানান রাষ্ট্রদূত।

তিনি বলেন, যা বাদুড় থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ হতে পারে। যেমন- প্লেগ, লেপ্টোস্পাইরোসিস, ব্রুসেলোসিস, করোনাভাইরাস ও ফিলোভাইরাসের প্যাথোজেন।

বর্তমানে যারা ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ করছে তারাই এর জন্য দায়ী বলে উল্লেখ করেন রুশ রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার ভি মানতিতস্কি।

চিঠিতে বলা হয়, আমরা চাই না ইউক্রেন একটি নব্য নাৎসি রাষ্ট্রে পরিণত হোক। যেখানে এসএস স্ট্রাইপ পরা ব্যাটালিয়নরা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সামনে মিছিল করে এবং যেখানে সেই জঙ্গিদের সন্ত্রাসী হামলা চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

রাশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, আমাদের ইতিহাসের সব পর্যায়েই আমরা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। আমি আপনাদের নিশ্চিত করতে পারি যে, এইবার আমরা একটি সুস্থ মানসিকতা নিয়ে এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসবো। পশ্চিমা বিশ্ব যে প্রয়োজনে তার নিজস্ব মূল্যবোধ ছাড়তেও দ্বিধা করে না এই বিষয়ে এখন আমাদের আর কোনো বিভ্রান্তি থাকবে না। আমরা আমাদের জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে কখনোই পশ্চিমের ওপর নির্ভর না করতে সব কিছু করবো।

চিঠির শেষে রুশ রাষ্ট্রদূত লেখেন, আমি বলতে চাই, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান নিয়ে বাংলাদেশি গণমাধ্যমের পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গি সেই অপশক্তির ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টার ফল, যারা সবসময় রাশিয়ান ফেডারেশন এবং বাংলাদেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ককে ক্ষুণ্ণ করতে চেয়েছিল।

এসময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেন রুশ রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার ভি মানতিতস্কি।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সক্রিয় সমর্থনে অবাঙালি প্রভুদের আধিপত্য, বাঙালি জনগণের বিরুদ্ধে হয়রানি, বৈষম্য ও সহিংসতা বন্ধ করতে বাংলাদেশিদের নয় মাস সময় লেগেছিল, যাতে তারা স্বাধীনতা পায়, স্থানীয় ভাষায় কথা বলার অধিকার পায়। পূর্ব ইউক্রেনের দনবাসের রুশভাষী লোকেরা গত চার বছর ধরে একই অধিকার পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করছে।

সূত্র : জাগো নিউজ
এন এইচ, ১৪ মার্চ

Back to top button