সচেতনতা

মৃগী: চিন্তা ছেড়ে নিয়মিত ওষুধ খান

মৃগী বা এপিলেপ্সি। রাস্তাঘাটে চলতে গিয়ে এ ধরনের রোগী অনেক সময় চোখে পড়ে। তবে তুলনামূলকভাবে খুবই কম। এমন রোগ কোনো পরিবারের সদস্যের হলে স্বাভাবিকভাবেই চিন্তার বিষয়। বিশেষ করে শিশুকন্যা বা মহিলাদের ক্ষেত্রে। পরিণত বয়সে এদের কী হবে, এই সমস্যাই সবার আগে বিশাল প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়ায় সেই সন্তানের বাবা-মায়ের কাছে। একজন ডাক্তার হিসেবে বলছি রোগ হলে বেশি চিন্তা করবেন না। চিন্তা করলে রোগ আরো বেড়ে যেতে পারে। বরং সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের কাছে যান। তারপর চিকিৎসা করান। নিয়মিত চিকিৎসা করলে অনেক জটিল রোগও নিরাময় সম্ভব।

মৃগী আসলে স্নায়ুর রোগ। এই রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলার আগে একটি গল্প বলি। এটি কোনো কাল্পনিক ঘটনা থেকে নয়, একেবারে বাস্তব ঘটনা। আমার চোখে দেখা। বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। পথচলতি রাস্তায় খুব জটলা দেখেছিলাম। অন্যদের মতো আমিও এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখলাম ভয়ঙ্কর অবস্থা। বছর ১৪-১৫ বছর বয়সী একটি মেয়ের ওপর প্রায় সকলেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। রয়েছেন পুরুষ ও মহিলারা। মেয়েটির মুখ দিয়ে ফেনা বেরচ্ছে। গোঁঙানির শব্দ। শরীরটা বেঁকে যাচ্ছে। এই অবস্থাতেই সেই মেয়েটির ওপর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।

কেমন পরীক্ষা জানেন? কেউ চোখে-মুখে জল দিচ্ছেন। কেউ পায়ের চামড়ার চটি খুলে নাকের সামনে ধরেছেন। কেউবা চামচ দিয়ে চেপে যাওয়া দাঁত খোলার চেষ্টা করছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, এক মহিলা এগিয়ে এসে বললেন, গোটা হলুদ পুড়িয়ে এনে ‘ওর’ নাকে শোঁকাও তাহলে জ্ঞান ফিরে আসবে। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ চললো। কিন্তু কেউ একবারও বললেন না ‘ভাই সবাই সরে যাও, ওই মেয়েটির শরীরে একটু বাতাস লাগুক বা কেউ বাতাস দিক’। ভ্যাগিস, মেয়েটির এক আত্মীয় সঙ্গে ছিলেন তাই বাঁচোয়া— তিনি হস্তক্ষেপ করে বললেন: আপনারা সরে যান। ততক্ষণে মেয়েটির জ্ঞান ফিরেছে। স্থির দৃষ্টিতে আশেপাশের দৃশ্য বোঝার চেষ্টা করছে সে। কেন না সে জানে তার মাঝে মাঝে এমন ঘটে। আমজনতার এমন কৌতুহল স্বাভাবিক।

এ ধরনের রোগীর ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ তাদের অজ্ঞতার কারণে কী ক্ষতি করলেন তা এবার পর্যায়ক্রমে জানাচ্ছি। এপ্রসঙ্গে একটি কথা উল্লেখ করছি, মৃগী রোগীদের অনেকে ‘প্রাকৃতিক অভিশাপ’ বলে থাকেন। আমি একজন ডাক্তার হিসেবে বলছি, ওসব বাজে কথা। এর সঙ্গে ধর্মীয় কোনো সংস্কারের সম্পর্ক নেই। অশিক্ষিতদের কথা বাদ দিয়েও বলা যায়, বহু শিক্ষিত মানুষ এই সংস্কারের শিকার হয়ে রোগীর জীবনকে বিপন্ন করে তোলেন। এর থেকে আমাদের বিরত হতে হবে, নাহলে সমাজে আরও বিপদ ডেকে আনবে এই সংস্কার।

মৃগী বা এপিলেপ্সি এমন একটি স্নায়ুঘটিত রোগ যা যে কোনো বয়সে হবার সম্ভাবনা থাকে। যদি নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ মতো ওষুধ খাওয়া যায় তবে শতকরা ৭০%নিরাময় সম্ভব।

প্রশ্ন হচ্ছে মৃগী আসলে কী?

অনেকে একে খিঁচুনি রোগও বলেন। মৃগী হলে হঠাৎ করে ঘন ঘন খিঁচুনি হয়। আমাদের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মস্তিষ্কের নির্দেশ অনুযায়ী চলে। আমাদের অজান্তেই মস্তিষ্ক ক্রমাগতভাবে নির্দেশ পাঠাতে থাকে। কোনো কারণে মস্তিষ্ক ঠিক মতো নির্দেশ না পাঠিয়ে যদি পরিবর্তিত, মাত্রাতিরিক্ত বা শৃঙ্খলাবিহীনভাবে নির্দেশ পাঠাতে থাকে তখন এই রোগটি দেখা দেয়।

শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় যদি মাথায় আঘাত পায়, তীব্র শ্বাসকষ্ট বা ইনফেকশন হয় তাহলে সেই সব ক্ষেত্রে মৃগী রোগের সূত্রপাত হতে পারে। বড়দের ক্ষেত্রে মাথায় আঘাত পাওয়া, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, অ্যালকোহল অথবা মস্তিষ্কের রক্তনালীর কিছু রোগের কারণে মৃগী হতে পারে। ডায়াবেটিক থেকেও মৃগী হতে পারে। হৃদযন্ত্রের সমস্যা, সিনকোপ, ব্রেনের রক্ত চলাচল কমে গেলেও মৃগী হয়। তবে অনেক সময়ই এই রোগের সঠিক কারণ জানা যায় না।

মৃগী হচ্ছে স্নায়ুতন্ত্রের জটিল রোগ। মানুষের স্নায়ুতন্ত্র দু’টি বড়ভাগে বিভক্ত। একটি সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম ও অন্যটি পেরিফেরিয়াল নার্ভাস সিস্টেম। এই দু’টি সিস্টেমের গোলযোগ দেখা দিলে মৃগী হয়। মৃগী হলে মানসিক রোগও দেখা দেয়। লক্ষ্য করে দেখবেন একজন সুস্থ মানুষ যদি হঠাৎ খিঁচুনি বা কাঁপুনির শিকার হয়, চোখ মুখ উল্টে ফেলে, অস্বাভাবিক আচরণ করে, চোখের পাতা স্থির হয়ে যায় তখন বুঝবেন তাঁর মৃগী হয়েছে। এই রোগের নির্দিষ্ট কোনো বয়স নেই। পরিসংখ্যানে জানা গেছে, এই রোগে পুরুষদের থেকে মহিলারাই বেশি আক্রান্ত হন বেশি। এই জটিল আকার নিলে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। রোগীর স্মৃতিভ্রম হয়।

মৃগী রোগীদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে খিঁচুনি সাময়িক সময়ের জন্য হয়। ঘাবড়াবেন না। শান্ত থাকুন। ঘাড়ের চারপাশে আঁটোসাঁটো পোশাক বা কাপড় ঢিলে করে দিন। রোগী যাতে মাটিতে পড়ে না যায় সেদিকে নজর রাখুন। কাছে শক্ত বা ধারালো কিছু থাকলে সরিয়ে রাখুন। মাথায় বালিশের মতো কিছু দিন। সেই সময় হাতের কাছে কিছু পাওয়া না গেলে কাপড় বালিশের মতো করে মাথায় দিন। রোগী যদি মেঝেতে পড়ে যায় তাহলে একবার খিঁচুনি শেষ হলেই তাকে ডান পাশ করে শুইয়ে দিন। যতক্ষণ না পর্যন্ত খিঁচুনি বন্ধ না হচ্ছে ততক্ষণ তাঁর পাশে থাকুন। আশেপাশের লোকজনকে সরিয়ে দিন। পর্যাপ্ত বাতাস যেন রোগীর শরীরে লাগে সেদিকে নজর দিন। রোগীর মুখে গরম হাড়, লোহার শিক, চামড়ার জুতো কখনই চেপে ধরা উচিত নয়। এতে রোগীর বিপদ বাড়ে। ঘাবড়ে না গিয়ে অভিভাবক হিসেবে আপনি সংযত থাকুন।

কেন না রোগীর খিঁচুনি ৩-৪মিনিট পর্যন্ত হয়। তারপর রোগী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। জেনে রাখা ভালো খিঁচুনি হলে ১৫মিনিটের বেশি কোনো রোগী অজ্ঞান হয়ে থাকতে পারে না। তারপর স্বাভাবিকভাবে জ্ঞান ফিরে আসে। যদি না আসে তবে দেরি না করে কাছে পিঠের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। সেই সময় রোগীকে অক্সিজেন দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। খিঁচুনির সময় দাঁত চেপে যায়। তখন কখনই চামচ বা আঙুল দিয়ে দাঁত খোলার চেষ্টা করবেন না। চামচ দিয়ে দাঁত খুলতে গেলে দাঁত ভেঙে যেতে পারে। যিনি আঙুল দিয়ে দাঁত খোলার চেষ্টা করবেন রোগীর খিঁচুনিতে তাঁর আঙুল কেটে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থেকে যায়।

আরো জেনে রাখুন, খিঁচুনির সময় চারপাশ থেকে লোকজন সরিয়ে দেবেন। রোগীর শরীরে বাতাস লাগার পরিবেশ তৈরি করুন। কিংবা বাতাস দেবেন। চোখে মুখে কখনই জল দেবেন না। হাত-পা চেপে ধরা কিংবা সেই সময় ওষুধ খাওয়ানোর কোনো দরকার নেই। রোগীর জ্ঞান ফিরলে তাঁকে তাঁর মতো ছেড়ে দিন। দেখবেন আপনা থেকেই ঘুমিয়ে পড়বেন। গভীর ঘুমের পর স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

মৃগী রোগীর ক্ষেত্রে প্রতিদিন রুটিন মেনে চলা উচিত। ঘুম খুব জরুরী। রাত ১০টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লে খুব ভালো। ৮ঘন্টা ঘুম বিশেষ দরকার। রাত জেগে বই পড়া কিংবা সিনেমা দেখা, অহেতুক গল্প গুজব করার দরকার নেই। রাতে হালকা খাবার খেলে ভালো হয়। ঋতু অনুসারে খাদ্যাভ্যাস করতে হবে। মৃগী রোগীদের কাটা ফল খাওয়া অনুচিত। কাটা ফল থেকে মস্তিষ্কে কৃমিজাতীয় রোগ দেখা দেয়।

মৃগী রোগীদের ক্ষেত্রে ওষুধ খাবার পাশাপাশি সতর্কতাই বেশি প্রয়োজন। যেমন-বাথটাব, সুইমিং পুল, পুকুর, নদীতে স্নান করার চেয়ে বাথরুমে বসে স্নান করাই ভালো। তবে বাথরুমের দরজা কখনই বন্ধ করবেন না। দরজায় চিহ্ন রেখে দিন। বাথরুমে শ্বেতপাথর না থাকলেই ভালো। হিটার, গ্যাসের থেকে মাইক্রোওভেনে রান্না করুন। নিরুপায় হলে উনুন বা হিটারে রান্না করলে চুল ভালো করে বেঁধে রাখুন। রান্না বসিয়ে নিরাপদ দূরত্বে থাকুন। পাশে সহকারী কেউ থাকলে ভালো হয়।

ঘরে কার্পেট থাকলে ভালো হয়। বিছানায় অ্যালার্ম ব্যবহার করা যেতে পারে। ঘুমের মধ্যে খিঁচুনি হলে বিছানার চারপাশে তোষক রাখা যেতে পারে। রোগী যাতে মাটিতে পড়ে না যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। একা ভ্রমণের সময় সঙ্গে সবসময় পরিচয়পত্র, ছবি, কাছের মানুষের মোবাইল নম্বর রাখাটা জরুরী। তবে অসুখ দেখা দেবার অন্তত দুই বছর একা একা রাস্তাঘাটে চলাফেরা না করাই ভালো। ওষুধ খাওয়ার পর খিঁচুনি কমলে তারপর কাছে পিঠে যাওয়া যেতে পারে। দূরে ভ্রমণের ক্ষেত্রে সব সময় সহকারী যেন থাকেন। খেলাধুলো বলতে পাহাড়ে ওঠা একদম নিষিদ্ধ। অন্য খেলাধুলো করা যেতেই পারে। তবে শারীরিক ক্ষমতা বুঝে।

আরও পড়ুন: যেসব খাবার খেলে দূর হয় অবসাদ

টিভি দেখার ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অন্ধকার ঘরে বসে কখনই টিভি দেখা কারোর উচিত নয়। মৃগী রোগীদের ক্ষেত্রে মোটেই নয়। টিভি-র পিছন দিকে সাদা আলো জ্বলা অবস্থায় টিভি দেখা উচিত। বেশিক্ষণ কম্পিউটার ব্যবহার না করাই ভালো। তাতে স্নায়ুর ওপর চাপ বাড়ে। ফলে সিস্টেম গোলমাল হলে খিঁচুনি দেখা দিতে পারে। অনেকে হতাশ হয়ে বলেন, অভিভাবক ছাড়া মৃগী রোগীরা অসহায়! মোটেই তা নয়। চিন্তামুক্ত হয়ে নিয়মিত ওষুধ খেয়ে যেতে হবে। মনকে সর্বদা স্ফূর্তিতে রাখলেই চলবে। পরিশেষে আবার বলি, সংস্কারের বশবর্তী হয়ে কোনো কিছু করবেন না। বিজ্ঞান মেনে চলুন, দেখবেন রোগ নিরাময় হবেই।

আডি/ ০৪ নভেম্বর

Back to top button