ক্রিকেট

এখন বাংলাদেশ দল শক্তিশালী, গভীরতাও দারুণ: স্টুয়ার্ট ল

চট্টগ্রাম, ২৮ ফেব্রুয়ারি – বাংলাদেশ-আফগানিস্তান সিরিজ বাংলাদেশের জন্য দুই সাবেক প্রধান কোচের সঙ্গে পুনর্মিলনের মঞ্চও। যেখানে আনন্দের সঙ্গে আছে বিরহও। জেমি সিডন্স আনন্দিত হয়ে বাংলাদেশের ব্যাটিং কোচ হয়েছেন। ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার ইচ্ছায়’ স্টুয়ার্ট লকে আফগানিস্তান নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ সিরিজের ঠিক আগে। বিরহ হয়ে তিনি এবার এসেছেন বাংলাদেশে।

নয় মাস বাংলাদেশে কাজ করা ল বাংলাদেশের ক্রিকেটের বাঁক বদলের অন্যতম রূপকার। তার হাত ধরে ২০১২ সালে এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলেছিল বাংলাদেশ। সেবার ভাগ্য সহায় হলে বাংলাদেশ ফাইনালও জিততে পারত। ইতিহাসে যুক্ত হয়ে যেতে পারতেন ল। হয়নি বলে আক্ষেপ নেই, তবে গর্ব বুক জুড়ে।

ঠিক এখনো সাকিব, তামিম, মুশফিকদের নিয়ে তার অনেক গর্ব। পাশাপাশি অধিনায়ক তামিমকে দেখেছেন ভিন্ন চোখে। তরুণ মিরাজকে মনে করছেন বাংলাদেশের ভবিষ্যতের নেতা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব ক্রিকেটে পরাশক্তি হয়ে ওঠায় দারুণ উচ্ছ্বসিত ল। প্রতিবেদকের মুখোমুখি হয়ে বাংলাদেশের সাবেক প্রধান কোচ কথা বললেন বিভিন্ন বিষয়ে। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইয়াসিন হাসান।

বাংলাদেশ সিরিজের আগে হঠাৎ আফগানিস্তান দলের দায়িত্ব গ্রহণের পেছনের কারণ কী ছিল?

স্টুয়ার্ট ল: তরুণদের নিয়ে কাজ করা সবসময়ই আনন্দের। সঙ্গে অভিজ্ঞদেরও যদি পাওয়া যায় তাহলে সোনায় সোহাগা। নবী, রশিদ, মুজিব ও জাদরানের সঙ্গে আমার আগে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। যুক্তরাজ্য ও মিডলসেক্সে তাদের নিয়ে কাজ করেছি। এবার দায়িত্ব নেওয়ার আগে খুব বেশি চিন্তা করিনি। মনে হলো ওদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ এসেছে, ঠিক আছে… করে আসি। ঘরে বসে শীত উপভোগ করার চেয়ে এখানে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারা আনন্দের।

বিরতির পর চিরচেনা পেশায় ফিরে কেমন লাগছে?

স্টুয়ার্ট ল: এই বছর এশিয়ান দলগুলোর ব্যস্ততা প্রচুর। শ্রীলঙ্কায় এশিয়া কাপ আছে সেপ্টেম্বরে। এরপর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপও আছে অস্ট্রেলিয়াতে। ব্যস্ত থাকতে হবে বেশিরভাগ সময়। এমন সময়ে কোচ হিসেবে যে কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত হতে পারা দারুণ বিষয়। চার-পাঁচদিন হলো এখানে যুক্ত হয়েছি। যেভাবে সময় কাটছে ছেলেদের সঙ্গে তা উপভোগ করছি। ছেলেরা শিখতে মুখিয়ে থাকে এবং নিজেদের খেলার উন্নতি চায়। এটা খুবই ভালো দিক।

কিন্তু সিরিজ হারে সেই আনন্দ খুব একটা নেই মনে হচ্ছে….

স্টুয়ার্ট ল: প্রথম ম্যাচে লড়াইয়ের যে তীব্র প্রচেষ্টা তারা দেখিয়েছিল… যদিও আমরা ম্যাচটা হেরেছিলাম কিন্তু তাদের মনোভাব আমার পছন্দ হয়েছিল। শেষ ওভারের আগ পর্যন্ত তারা লড়েছিল। বড় দলগুলোর বিপক্ষে আফগানিস্তানের ভালো ফল পেতে হলে দ্রুত কিছু জায়গায় উন্নতি করতে হবে। তরুণ দুয়েকজনকে সেই দায়িত্বও নিতে হবে। যেমন ফজলহক ফারুকি। দুর্দান্ত বোলিং করেছে সে। প্রথম ম্যাচে তার প্রথম স্পেল ছিল চোখ ধাঁধানো। দ্বিতীয় ম্যাচেও একই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছিল। দলের সঙ্গে প্রথমবার সফরে এসে প্রথম সুযোগটিকেই সে শতভাগ কাজে লাগিয়েছে। একজন খেলোয়াড়ের কাছ থেকে তো এটাই চাওয়ার আছে।

২-০ ব্যবধানে ওয়ানডে সিরিজে পিছিয়ে আফগানিস্তান। ওয়ানডেতে একটি জয় অবশ্যই স্বস্তি এনে দিতে পারে। আফগানিস্তান শেষ ম্যাচে নিশ্চয়ই সেদিকে তাকিয়ে আছে?

স্টুয়ার্ট ল: হ্যাঁ আমাদের কাছে শেষ সুযোগ ওয়ানডেতে একটি ফল পাওয়ার। ছেলেরা অবশ্যই আত্মবিশ্বাসী। বাংলাদেশ ভালো খেলছে বলেই হয়তো তাদের প্রচেষ্টা নজরে আসছে না। কিন্তু তারা চেষ্টা করছে। তৃতীয় ম্যাচে নিশ্চিত করতে হবে যেন আমরা জয়ের সুযোগ তৈরি করি এবং ওই লাইনটা ক্রস করতে পারি।

যদি বাংলাদেশের কথা জিজ্ঞেস করি, অবশ্যই সাবেক কোচ হিসেবেই জানতে চাইব, আইসিসি ওয়ানডে সুপার লিগের পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে থাকা বাংলাদেশকে এখন কেমন লাগছে?

স্টুয়ার্ট ল: এখন বাংলাদেশ দল শক্তিশালী। সঙ্গে দলের গভীরতা দারুণ। আমার অধীনে থাকার সময় খেলোয়াড়রা যে পরিমাণে নিজেদের মেলে ধরেছিল, এখন নিজেদের পরবর্তীতে ধাপে নিয়ে গেছে। এজন্য ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের অবদানকে খাটো করলে চলবে না। শুধু তাই নয়, বাইরের দেশে বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবমূর্তি পাল্টে গেছে। খেলোয়াড়দের মানসিকতা পরিবর্তন এবং খেলার ধরনের আমূল পরিবর্তন আনায় এটা সম্ভব হয়েছে।

দলে সাকিব আল হাসানের মতো বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার আছে। তামিম ইকবালের মতো বিধ্বংসী ওপেনার আছে। যদিও এখনো সে এই সিরিজে নিষ্প্রভ আছে। মিরাজের মতো তরুণ, প্রতিশ্রুতিশীল ক্রিকেটার আছে যার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। তাকে একবার দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল কিন্তু বাইরে থেকে এমন কিছুই সে করেছিল যে, তাকে ফেরাতে হয়েছে এবং সেই ধারাবাহিকতা এখনো ধরে রেখেছে।

লিটনকে দেখছি। এই ধরনের কন্ডিশনে তার মতো দৃঢ় ব্যাটসম্যান কমই আছে। মুশফিক দিনকে দিন নিজের কাজটা আরো ভালোভাবে করছে। মোস্তাফিজ সীমিত পরিসরে সময়ের অন্যতম সেরাদের একজন। তাসকিনকে আমরা আগেও দেখেছি। দ্রুত গতিতে এখন বল করে। বলে বৈচিত্র্য আছে। বাউন্সও দিতে পারে। সব মিলিয়ে আমি যা দেখছি, বাংলাদেশ ক্রিকেটের গভীরতা আগের থেকে অনেক উঁচুতে। যদি এখন কেউ ইনজুরিতেও পড়ে কিংবা কাউকে বিশ্রাম দিলেও যারা আসবে তারা অসাধারণ খেলবে। এটাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসল প্রতিযাগিতা।

বাংলাদেশের ক্রিকেট থেকে আফগানিস্তান কী গ্রহণ করতে পারে?

স্টুয়ার্ট ল: আমি মনে করি বাংলাদেশ ক্রিকেটের গভীরতা আফগানিস্তান ক্রিকেট দল অনুসরণ করতে পারে। ১০-১৫ বছর আগে বাংলাদেশ যেখানে ছিল সেখানেই আজ আফগানিস্তান দাঁড়িয়ে। খেলাধুলার সুযোগ কম, আর্থিক বিষয়সহ নানা ঝামেলায় আফগানিস্তানের ক্রিকেট। তাদের থেকে সেরাটা আনতে হলে ৫-১০ বছরের সময় বেঁধে দিতে হবে। এ সময় তরুণরা অভিজ্ঞ হয়ে উঠবে। প্রতিভাবানরা সুযোগ পাবে। কীভাবে এই প্রক্রিয়া চালু হতে পারে সেজন্য আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের অফিসিয়ালরা বিসিবির সঙ্গে কথা বলতে পারে।

২০১৬ সালে যুব দলের পরামর্শক হয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। বিশ্বকাপে দায়িত্বও পালন করেছিলেন। মিরাজ ওই দলের দলের সবচেয়ে প্রতিভাবান ক্রিকেটার ছিলেন। তাকে এখন দেখে কতটা ভালো লাগে এবং ভবিষ্যতে তিনি কী বাংলাদেশের জন্য ম্যাচ উইনার হতে পারবেন?

স্টুয়ার্ট ল: সিরিজ শুরুর আগে আমরা ওই টুর্নামেন্ট আলোচনা করেছিলাম। আমরা সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হেরে যাই। আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচটার কথা বলতে চাই, যেভাবে সে ম্যাচটা বের করে এনেছে সত্যিই অসাধারণ ছিল। দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশকে ম্যাচটা জিতিয়েছে। যুব ক্রিকেটে সে অসাধারণ নেতা ছিল। উদাহরণ দেওয়ার মতো একজন নেতা। একজন উদ্যমী তরুণ যে কি না লড়তে জানে। দারুণ তার সামর্থ্য। ব্যাটিং করতে পারে। ফিল্ডিংয়ে তুখোড় এবং স্পিনার হিসেবে বৈচিত্র্যময়। আমি বিশ্বাস করে বলতে পারি, সে এমন একজন যাকে কি না বাংলাদেশ ভবিষ্যতের নেতা হিসেবে ভাবতে পারে। যদি সত্যিই সে পরবর্তী অধিনায়ক হয় তার সাফল্যের মুকুটে নতুন পালক যুক্ত হবে।

অধিনায়ক তামিমকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

স্টুয়ার্ট ল: তামিমের নেতৃত্বগুণ অসাধারণ। আপনি একটা ম্যাচ থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করতে পারবেন। কিন্তু খেলাটা বুঝতে হলে, প্রতিটা খেলোয়াড়ের ভেতরের অবস্থা জানতে হলে আপনাকে খেলার ভেতরে ডুব দিতে হবে। তামিম সেই কাজটাই করে নিজের থেকে। এটাকেই নেতৃত্বগুণ বলে।

মাঠের বাইরে তারা যে পরিকল্পনা করে সেটা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব তামিমের। সে অবশ্যই সবজান্তা নয়। তবে শিখতে পছন্দ করে। জানতে পছন্দ করে। দলগতভাবে সবাইকেই লড়তে হয়। অধিনায়ক সিদ্ধান্ত নেবেন কিন্তু ইনপুট সবাইকেই দিতে হবে। দেখে মনে হচ্ছে তামিম তার খেলোয়াড়দের অবদান রাখার জন্য জায়গা করে দিয়েছে। এটি দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার একটি দুর্দান্ত উপায় এবং প্রত্যেকে সাফল্যের জন্য নিজেকে দায়িত্ববান ভাবে যা দুর্দান্ত একটি সংস্কৃতি।

তামিম, মুশফিক, সাকিব, মাহমুদউল্লাহ একসঙ্গে ২০২৩ বিশ্বকাপ খেলবে। এর আগে তারা একসঙ্গে তিনটি বিশ্বকাপ খেলছে। আপনার কি মনে হয় ২০২৩ বিশ্বকাপেই তাদের সেরাটা দেওয়ার সময়?

স্টুয়ার্ট ল: দেখুন বাংলাদেশের শেষ কয়েকটি বিশ্বকাপ নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলে। কারণ বাংলাদেশ পারফর্ম করে সমীহ আদায় করে নিয়েছে। শেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কথাই ভাবুন। বাংলাদেশ কয়েকটি ম্যাচে গভীরে পৌঁছে গিয়েছিল। আমি কয়েকটি ম্যাচে ধারাভাষ্য দিয়েছি। সেগুলোতে তারা ভালো খেলেছিল। ম্যাচ ক্লোজ করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিততে পারেনি। ভাগ্য যদি আপনার সহায় হতো এবং একটু এদিক-সেদিক হলেই ম্যাচগুলো জেতা যেত।

পরবর্তী ওয়ানডে বিশ্বকাপ উপমহাদেশে হবে, যেখানে খেলে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই স্বস্তি পাবে। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের ওই আবহাওয়া মানিয়ে নিতে কষ্ট হবে না। আমি ২০১২ এশিয়া কাপে তাদেরকে ভারত ও শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিপক্ষকে হারাতে দেখেছি। একই ফল না পাওয়ার কোনো কারণ দেখি না। এই সিরিজে তারা যেভাবে পারফর্ম করেছে ঠিক এভাবেই যদি তারা পারফর্ম করতে পারে তাহলে ভালো কিছুই হবে। নিশ্চিত করে বলতে পারি কয়েকটি দলকে নাড়িয়ে দিতে পারবে। মাঠে গিয়ে জয় পাওয়া হবে স্বপ্নের মতো। আগে ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলতে গেলে একটা ভীতি কাজ করতো। কিন্তু তাদেরকে একাধিকবার হারানোর কারণে সাহস নিয়ে মাঠে নামতে পারে বাংলাদেশ। তারা যদি ফ্রন্টফুটে খেলতে পারে তাহলে তাদের হারানো কঠিন।

পুনরায় এই দলটির সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা আছে?

স্টুয়ার্ট ল: এই মুহূর্তে আমার এবং আমার পরিবারের জন্য যেটা ভালো সেই কাজটি করছি। পাশাপাশি একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি, যা দিয়ে আমার কাজকে আরো সহজ করতে পারে। এই মুহূর্তে আফগানিস্তান ক্রিকেট দলই আমার ঠিকানা। তাদের পরামর্শক হয়েই কাজ করতে চাই। স্বল্প সময়ের জন্য করলেও ইতিবাচক দিকগুলো বড় পরিবর্তন এনে দিতে পারে। একই বার্তা থাকবে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার জন্য। আমি যদি সত্যিকার অর্থে স্বল্প সময়ে বড় পরিবর্তন আনতে পারি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে যা ক্রিকেটার, দলগুলোর উপকারে হবে… তাহলে সেই কাজটাই করতে চাই। ঢাকায় টি-টোয়েন্টি সিরিজ শেষে আমি ফ্রি এজেন্ট।

সূত্র : রাইজিংবিডি
এন এইচ, ২৮ ফেব্রুয়ারি

Back to top button