নারায়নগঞ্জ

‘জাতীয় চার নেতার মতো বঙ্গবন্ধুপ্রেমী হওয়া অসম্ভব’

রাজু আহমেদ

নারায়ণগঞ্জ, ০৪ নভেম্বর- ‘আমরা জানতাম বাবা বেঁচে নেই, জাতীয় ৪ নেতার সঙ্গে বাবাকেও মেরে ফেলেছে ঘাতকরা। কারণ শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী চাচা আর আমার বাবা একই সেলে বন্দি ছিলেন। প্রায় আড়াই বছর পর বাবার হাতে লেখা একটি চিরকুট আসে -‘আমি বেঁচে আছি’। ফিরে আসার পর বাবার মুখে শুনেছি কিভাবে ঘাতকের বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েও জাতীয় ৪ নেতা চিৎকার করে বলেছিলেন,‘আমরা মরে গিয়েও প্রমাণ করতে চাই আমরা বঙ্গবন্ধুর ছিলাম,আছি, থাকব’।

বাবার মুখে শোনা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী চাচার শেষ কথা আজও আমাকে শিহরিত করে। তিনি বাবার নাম ধরে বলেছিলেন, ‘জোহা ,ওরা আমাকে ওযু করার পানিও দিল না’।

আমার জীবনে ৭৫ এমন একটি সময় যা আমাকে সেই কৈশোর বয়সেই শিখিয়েছিল – বঙ্গবন্ধু মানেই দেশ প্রেম, বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ।

এ প্রতিবেদকের কাছে জেলহত্যা দিবসে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এভাবেই নিজের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেন আওয়ামী লীগের এমপি ও ঐতিহ্যবাহী ওসমান পরিবারের সন্তান একেএম শামীম ওসমান।

শামীম ওসমান বলেন, ‘১৯৭৫ এ আমার বয়স তখন ১৩ কি ১৪ হবে। বড় ভাই জাতীয় পার্টির সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসিম ওসমানের বিয়ের দিন ছিল ১৪ আগষ্ট। ঢাকার একটি কমিউনিটি সেন্টারে চলছিল বিয়ের অনুষ্ঠান। রাতে বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন প্রয়াত শেখ কামাল ভাই ও তার বন্ধুমহল। খুব সকালেই আমরা জানতে পারি বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। নবপরিনিতা বধুকে রেখেই আমার ভাবি, বোনদের সমস্ত সোনার গহনা নিয়ে বড় ভাই নাসিম ওসমান তার কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে বেড়িয়ে পরেছিলেন বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিশোধ নিতে।’

শামীম ওসমান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরদিনই আমাদের বাসায় একটি ফোন করেন খুনী খন্দকার মোশতাক। আমার মা প্রয়াত ভাষা সৈনিক নাগিনা জোহার কাছে খুনী মোশতাক আমার বাবাকে তার মন্ত্রী পরিষদে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

আমার মা তখন বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর দিয়ে আমার স্বামী যদি আপনার মন্ত্রী পরিষদে যোগ দেয় তবে চেষ্টা করব তাকে হত্যা করতে, না হয় তাকে ত্যাগ করতে’।

এই ফোনালাপের আধঘন্টা পরেই আমাদের বাসায় পুলিশের রেইড পরেছিল। ১৭আগষ্ট আমার বাবা একেএম সামসুজ্জোহাকে( মরোনত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত) গ্রেফতার করা হয়। এরপর কেটে যায় প্রায় আড়াই বছর।

১৯৭৮সালে আমি এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম। একদিকে বাবা নেই অন্যদিকে বড় ভাই নাসিম ওসমান তখনও বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে প্রতিরোধ যুদ্ধে।

আমরা জানতাম বাবাকেও হত্যা করা হয়েছে কিন্তু হঠাৎ একটি চিরকুট আসে ‘আমি বেঁচে আছি’। অসুস্থ্যাবস্থায় আমার বাবা মুক্ত হন ১৯৭৮সালের শেষ দিকে।

ওই সময় বিএনপির এমপি মরহুম জালাল উদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন আমাদের বাসায় এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘাতক জিয়াউর রহমানের প্রস্তাব নিয়ে।

জিয়াউর রহমান আমার বাবাকে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্ত আমার বাবা ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছিলেন। এই ঘৃণার পরও আমার বাবাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করা হয়েছিল। হাজার হাজার মানুষ সেই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়।

শামীম ওসমান বলেন, ‘বাবার কাছে শুনেছি সেদিন জেলখানায় কি করে ঘাতকরা ৪ জাতীয় নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে আরও একটি কালো ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল। ঐ ঘটনার পর আমার বাবা প্রয়াত সামসুজ্জোহা একটি দিনও জেলে শান্তিতে ঘুমাতে পারেননি। একপর্যায়ে জেলে থাকা অবস্থাতেই তিনি স্ট্রোক করেছিলেন।’

বাবা আমাদের বলেছিলেন,‘শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী আর তিনি একই সেলে বন্দি ছিলেন। ঘাতকরা যখন মনসুর আলী চাচাকে নিয়ে যেতে এসেছিল তখন তিনি নামাজ পড়ার জন্য ওযুর পানি চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটিও করতে দেয়নি নরপশুরা। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী যাওয়ার সময় আমার বাবার নাম ধরে বলেছিলেন, ‘জোহা, ওরা আমাকে ওযুর পানিও দিল না। তোমরা বেঁচে থাকলে বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিশোধ নিও।’ এসব বলে বাবা প্রায়শই কাদঁতেন আর বলতেন বঙ্গবন্ধুর প্রতি এত ভালোবাসা আর আনুগত্য আর দেখা যাবে না। ’

শামীম ওসমান বলেন, ‘বাবার মুখে শুনেছি জাতীয় ৪ নেতাকে খুন করার আগে সম্ভবত কোনো প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা চিৎকার করে বলেছিলেন, আমাদের হত্যা কর কিন্তু মরেও আমরা প্রমাণ করতে চাই আমরা বঙ্গবন্ধুর লোক ছিলাম,আছি এবং থাকব। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী জীবদ্দশায় সেনাবাহিনীর দক্ষ্য অফিসার ছিলেন। ঘাতকরা যখন গুলি ছুড়ে তখন তিনি উল্টো ক্রলিং করে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। তাই গুলি তার বুকে লাগতে পারেনি। হত্যাযজ্ঞ শেষ করে ঘাতকরা যখন প্রধান ফটকে অপেক্ষা করছিলো তখনও মনসুর আলী চাচা জীবিত ছিলেন। তার ঘোঙানির শব্দ ভেসে আসছিল তখনও। খবর পেয়ে ঘাতকের দল আবারও ফিরে এসে মনসুর আলীকে ব্যানটে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।

শামীম ওসমান এসময় আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেন, ‘জাতীয় ৪ নেতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা আর আনুগত্যের যে বাঁধনে জড়িয়ে ছিলেন সেটা এখন বিরল। তাদের মত বঙ্গবন্ধু প্রেমী হওয়া অসম্ভব ।’

সূত্র: যুগান্তর

আর/০৮:১৪/৪ নভেম্বর

Back to top button