মুক্তমঞ্চ

আমি থাকব না গানটি তো থাকবে

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

আজ মহান ভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারি। এই মহান দিবস পালনের সত্তর বছর পূর্ণ হলো। আজ হৃদয়ভরা শ্রদ্ধা নিয়ে স্মরণ করি সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ ভাষা শহিদদের। বায়ান্নর রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলনকে যারা পরবর্তীকালে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন, গাজীউল হক, শহিদ মুনীর চৌধুরী, প্রয়াত অলি আহাদ প্রমুখ সব নেতাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। ভাষা আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলনকে জন্ম দিয়েছিল। আমার গর্ব আমার কৈশোর-যৌবন এ স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত ছিল। ভাষা সংগ্রামকে নিয়ে লেখা আমার একুশের গানটিরও সত্তর বছর পূর্ণ হলো। আজ আমি মহাপ্রস্থানের পথে। তাই রোগশয্যায় শুয়ে একুশের কিছু স্মৃতিচারণ করতে চাই।

একুশের শহিদ মিনার গড়ার প্রথম পর্যায় থেকে আমি তার ইতিহাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এটা আমার গর্ব। পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার কয়েক দফা এই শহিদ মিনার ভেঙেছে। বারবার ছাত্র-জনতা এই মিনার মাটি ও ইট দ্বারা আবার তৈরি করেছে। শেষ পর্যায়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসে এই মিনার তৈরি করে। কিন্তু ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদারেরা যখন বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করে, তখন তাদের বর্বরতায় প্রথম শহিদ হয় এ ভাষা শহিদ মিনার। কামান দেগে এ শহিদ মিনারটি ভেঙে দেওয়া হয়। তারপর জামায়াত নেতা গোলাম আযম কিছু সঙ্গী নিয়ে এসে ওই মিনারের ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, ‘এটি এখন থেকে হবে মসজিদ’। আমি সেই ভাঙা শহিদ মিনার দেখে হৃদয়ের উদগত অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি। ঢাকা থেকে বরিশালের এক গ্রামে গিয়ে যখন আশ্রয় নেই, তখন এ ভাঙা শহিদ মিনার নিয়ে একটি গান লিখি। গানটির প্রথম দুলাইন ছিল :

‘শহিদ মিনার ভেঙেছো আমার ভাইয়ের রক্তে গড়া

আরও পড়ুন ::

দেখো বাংলার হৃদয়ে এখন শহিদ মিনারে ভরা’।

আমার এই গানটি আমার বন্ধু প্রয়াত ওয়াহিদুল হকের খুব ভালো লাগে। তিনি সেটি কলকাতায় নিয়ে যান। আমিও তখন কলকাতায়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলছে। এ সময় আমার ডিকসন লেনের বাসায় হিজ মাস্টার্স ভয়েসের (ঐগঠ) কর্মকর্তা বিখ্যাত গায়ক সন্তোষ বাবু এসে হাজির। তিনি বললেন, আপনার এ গানটি আমরা রেকর্ড করতে চাই। আপনার অনুমতি নিতে এসেছি। আমি সানন্দে তাকে অনুমতি দিই। এই গানের সুর দেন পল্লিগীতির সম্রাট বলে পরিচিত প্রয়াত নির্মলেন্দু চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ গানটি গীত হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় পূর্বাণী হোটেলে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার তখনকার সম্পাদক এবং মালিক অশোক কুমার সরকারের এক সংবর্ধনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। নির্মলেন্দু চৌধুরী সেই সভায় এই গানটি গেয়েছিলেন। এই গানটি জনপ্রিয় হয়নি। ধীরে ধীরে হারিয়ে গিয়েছিল। বহুকাল পরে লন্ডনে বসবাসকারী সংগীতশিল্পী হিমাংশু গোস্বামী এ গানটি উদ্ধার করেন এবং বিভিন্ন সময়ে গান। এ ছাড়াও ভাষা আন্দোলনের ওপর আমি গান লিখেছি। একটি গান সুর দিয়েছেন প্রয়াত সুরশিল্পী লুৎফুর রহমান। এখন এই গান লন্ডনের বিভিন্ন সভায় তার কন্যা লুসি রহমান গেয়ে থাকেন।

ভাষা সংগ্রাম শুরু হয় প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৮ সালে। এই সময়েও আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম। সেটি পরে গান হয়। এই গানের প্রথম লাইনটি ছিল :

‘মা, তুই আমার দুঃখিনি বাংলা, আমার জননী’।

এসব গানের কথা আমি নিজেও ভুলে গিয়েছিলাম। অজয় পাল নামে আমার এক সাংবাদিক বন্ধু আজকে আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। তিনি এই ভাষার গান নিয়ে ফেসবুকে একটি লেখা দিচ্ছেন।

ভাষা দিবসে শুধু শহিদদের স্মরণ করা হয়। আমাদের ভাষাকে প্রকৃত জাতীয় ভাষা এবং আন্তর্জাতিক ভাষা করার অব্যাহত প্রচেষ্টাও দরকার। বাংলাভাষা শুধু বাংলাদেশের নয়, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা এবং বিহারের পূর্ণিয়া অঞ্চলেরও। এই ভাষার প্রতিষ্ঠাকল্পে আসামের শিলচরে ভাষা সংগ্রাম হয়েছে। সেখানেও অনেকে ভাষার জন্য আত্মাহুতি দিয়েছেন। আশির দশকে লন্ডনের বাংলাদেশিরা কমিউনিটি স্কুলগুলোতে বাংলা শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করার জন্য আন্দোলন শুরু করে এবং এই আন্দোলন সফল হয়। কমিউনিটি স্কুলগুলোতে বাংলা শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হয়েছিল। আশির দশকে প্রবাসী বাংলাদেশি তরুণরা বিলাতে ভাষা আন্দোলন করেছেন, যার ফলে আজ লন্ডন থেকেই ৫/৬টি বাংলা সাপ্তাহিক প্রকাশিত হয় এবং বাংলায় ২/৩টি টেলিভিশনও প্রচারিত হয়। বিশ্বের সর্বত্র যেখানেই বাঙালিরা আছেন, এই শহিদ দিবস সারম্ভরে পালিত হয়। আমি একুশে ফেব্রুয়ারি পালন উপলক্ষ্যে কানাডার অটোয়া, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি, সুইডেনের স্টকহোম, আমেরিকার নিউইয়র্কসহ আরও বহু স্থানে গেছি। আজ রোগশয্যায় শুয়ে সেসব দিনের কথা স্মরণ করি। একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা ঘটেছিল বাংলাদেশের ঢাকায়। কিন্তু আজ এই দিবসকে শুধু বাংলাদেশের বাঙালি নয়, পশ্চিমবঙ্গ, আসামসহ বিশ্বের যেখানে যত বাঙালি আছেন তারা পালন করেন। এটা এখন বিশ্ব বাঙালির ভাষা দিবস।

প্রশ্ন উঠেছে, এই ভাষার আন্তর্জাতিক রূপ কী হবে? কলকাতার প্রমিত বাংলা, না ঢাকার ‘ঢাকাইয়া’ বাংলা? এই ব্যাপারে শহিদ মুনীর চৌধুরী আধুনিক বাংলার গদ্যরীতি কী হবে, সে সম্পর্কে একটি বই লিখে গেছেন। বাংলা একাডেমি অনেক পরে ভাষা সংস্কার করেছে। তাতে মুনীর চৌধুরীর সংস্কারগুলোই গ্রহণ করা হয়েছে। এটি শুধু বাংলাদেশের সরকারি কাজকর্মে কিছু কিছু ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। এর ব্যাপক প্রচলন হয়নি। একবার আবুল মনসুর আহমদ প্রস্তাব তুলেছিলেন, তার ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। এই দাবির পর আবার সিলেটে দাবি উঠেছিল, তাদের ভাষা বাংলা নয়, নাগরী অথবা নাগরী থেকে উদ্ভূত তাদের ভাষা। তারা এই ভাষা ব্যবহার করতে চান। বাংলাদেশে এখন অনেক আঞ্চলিক ভাষা। বরিশাল, নোয়াখালীসহ উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক ভাষা আছে। আমাদের সাহিত্যিকরা এগুলো দেদার ব্যবহার করেন। এখন কোনটি প্রকৃত বাংলাভাষা তা নির্ণয় করা মুশকিল। এজন্য আমার ধারণা, বাংলাদেশ সরকার পশ্চিমবঙ্গের সহযোগিতাসহ বাংলার একটি প্রমিত রূপ নির্ধারণ করবেন। নইলে বাংলাভাষার উন্নয়ন ও বিস্তার সম্ভব হবে না।

আমি বারবার লিখছি, বাংলাকে কেবল সাহিত্যের ভাষা করে রাখলে চলবে না। তাকে বিজ্ঞানের এবং নবপ্রযুক্তির ভাষা করে তুলতেই হবে। একদিনে এ কাজটি হবে না। তবে বাংলাদেশ সরকার যত্নবান হলে, বাংলাকে বিজ্ঞানের ভাষা করে তুলতে পারলে, হয়তো একদিন দেখা যাবে বাংলা ইংরেজি ও ফরাসির মতো উন্নত আন্তর্জাতিক ভাষা হয়ে উঠেছে। বাংলাভাষার একটা বড় বৈশিষ্ট্য তার গ্রহণী শক্তি। আরবি, ফার্সি, ইংরেজি সব ভাষা থেকে আমরা শব্দ আহরণ করেছি। এখনো এ আহরণ চলছে।

আমাদের আঞ্চলিক ভাষাগুলোকেও সরকারের স্বীকৃতি দিয়ে উন্নয়নের চেষ্টা করা উচিত। তাতে বাংলাভাষার ক্ষতি হবে না। বরং ভাষা সমৃদ্ধ হবে। আমাদের কথাশিল্পীরা তো এখন তাদের গল্পে-উপন্যাসে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেন এবং তা সমাজের উচ্চ শ্রেণির কাছেও আদৃত। এক সময় তা ছিল না। গল্পে-উপন্যাসে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করলে অবিভক্ত বাংলার পণ্ডিতরা আঁতকে উঠতেন। বাঙালি মুসলমান লেখকরা তাদের লেখায় ‘আল্লাহ, রাসূল’ শব্দ ব্যবহার করায় আনন্দবাজার পত্রিকা তার বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় লিখে বলেছিল, ‘বাংলাভাষার জাত গেল’। আবার বাংলাদেশ ভাগ হওয়ার পরে কবি শামসুর রাহমান তার কবিতায় ‘ঈশ্বর’ শব্দ ব্যবহার করায় সরকারি কোপে পড়েছিলেন। আজ এই ভেদাভেদ অনেকটা লুপ্ত। কলকাতার পত্রিকায় যেমন ‘আল্লাহ, রাসূল’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়, তেমনি ঢাকায় কেউ ‘ঈশ্বর, ভগবান’ লিখলে তার মাথা কাটা যায় না। এক সময় বাঙালি মুসলমানরা বাংলাকে হিন্দুর ভাষা ভেবে বাংলাভাষা থেকে একটু দূরে ছিল। বিভাগ-পূর্ব বাংলায় মুসলমানদের দ্বারা প্রকাশিত সব পত্রপত্রিকার নাম উর্দু বা ফার্সিতে হতো- যেমন আজাদ, মোহাম্মদী, ইত্তেহাদ, সওগাত, সুলতান, মদীনা প্রভৃতি। আজ বাংলাদেশের মুসলমান এই মোহমুক্ত। ভাষা আন্দোলনই এই মোহমুক্তি ঘটিয়েছে এবং বাংলা যে বাঙালি মুসলমানেরও ভাষা এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করেছে।

এখন আঞ্চলিক ভাষার গানগুলোর রেকর্ড বেরোচ্ছে। লালনগীতির পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ লালনের বহু গান থেকে সুর নিয়েছেন। লালন হিন্দু না মুসলমান এটা আজ পর্যন্ত নির্ধারিত হয়নি। হিন্দুরা বলেন লালন সন্ন্যাসী। মুসলমানরা বলেন লালন ফকির। লালন কিন্তু তিনি হিন্দু না মুসলমান এই পরিচয়টি দেননি। তিনি সম্ভবত বাঙালি হিসাবে পরিচিত হতে চেয়েছিলেন।

আজকের দিনটি আমাদের বড় গৌরবের দিন। একদিকে শোক শহিদদের জন্য, অন্যদিকে সংগ্রামের সাফল্যের জন্য বাংলা ভাষাভাষী সব বাঙালি আজ আনন্দিত। সরকারিভাবে বাংলাদেশে যেমন দিবসটি পালিত হচ্ছে, তেমনি সারা বিশ্বে আজ বাঙালিমাত্রই এ দিবসটি পালন করছে। প্রতি বছর ঘুম না ভাঙতেই যখন আমার লেখা গানটি সহস্র কণ্ঠে শুনতে পাই, তখন গর্বে-আনন্দে আমার বুক ভরে যায়। আমি জানি না, এই বছরেই আমি শেষবারের মতো দিবসটি পালন করতে পারলাম কিনা। আমার গানের বয়স সত্তর বছর। গানটি হয়তো অমিতায়ু হবে। কিন্তু আমি হব না। সেজন্য আমার দুঃখ নেই। আমি থাকব না। গানটি তো রইল।

এন এইচ, ২১ ফেব্রুয়ারি

Back to top button