অপরাধ

১৭ বছর ধরে সাংবাদিকের ছদ্মবেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি

ঢাকা, ১৮ ফেব্রুয়ারি – স্ত্রীকে খুন করে ১৭ বছর গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন তিনি। করেছেন সাংবাদিকতা। সাংবাদিকদের নেতাও ছিলেন তিনি। কিন্তু তাকে ধরা যায়নি!

শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থানায় হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামি আশরাফ হোসেন ওরফে কামাল গ্রেপ্তার এড়াতে ১৭ বছর পালিয়ে বেড়িয়েছেন। এসময় তিনি আশুলিয়ার কয়েকটি স্থানীয় সংবাদপত্রেও কাজ করেন, সদস্য হন আশুলিয়া প্রেসক্লাবের।

কামালকে জিজ্ঞাসাবাদ ও চার্জশিট পর্যালোচনায় জানা যায়, ২০০৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাতে আশরাফ তার শিশুপুত্রের সামনে শ্বাসরোধে স্ত্রী সানজিদা আক্তারকে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা গোপন করার উদ্দেশ্যে মৃতের ওড়না দিয়ে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে মরদেহ ঝুলিয়ে দেন। পরে প্রচার করেন তার স্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন।

এ ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা হয়।

ঘটনাটি সন্দেহমূলক হওয়ায় আসামীকে ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়। ১২ দিন পর সে তার শ্বশুরের সহায়তায় জামিন পায়। জামিন পাওয়ার পরপরই হঠাৎ করে একদিন সে আত্মগোপনে চলে যান। এরপর তিনি আর কখনও তার স্থায়ী ঠিকানা নোয়াখালী ও কর্মস্থল, নিজ সন্তান ও আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।

এদিকে ময়নাতদন্ত রিপোর্টে উঠে আসে, শ্বাসরোধ করে সানজিদা আক্তারকে হত্যা করা হয়। এরপর সোনারগাঁও থানা পুলিশ বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করে। মামলার তদন্তে জানা যায়, সিলিং ফ্যানের নিচে খাট ছিল এবং ওই খাটের ওপর থেকে সিলিং ফ্যানের উচ্চতা খুবই কম ছিল। ওই অবস্থায় সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করা সম্ভব নয়। প্রতীয়মান হয় যে, আশরাফ হোসেন তার স্ত্রীকে হত্যা করেছেন।

সার্বিক তদন্তে প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণে তার বিরুদ্ধে দন্ডবিধি ৩০২/২০১ ধারার অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমানিত হওয়ায় সোনারগাঁও থানা পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। বিচারে তার মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়।

র‌্যাব জানায়, আশরাফ হোসেন ১৯৯৮ সালে হিসাব বিজ্ঞান বিষয়ে বি.কম (পাস) করে সোনারগাঁওয়ের একটি প্রতিষ্ঠিত সিমেন্ট কোম্পানিতে ২০০১ সালে চাকরি শুরু করে। পরে সে ২০০৩ সালে বিয়ে করে কোম্পানি স্টাফ কোয়ার্টারে থাকতে শুরু করেন।

র‌্যাব জানায়, হত্যাকাণ্ডের পর সে ছদ্মনামে আশুলিয়ায় বসবাস শুরু করে। প্রথম বিয়ের কথা করে কামাল দ্বিতীয় বিয়ে করেন। পাশাপাশি সাংবাদিকতা পেশাকে গ্রেপ্তার এড়ানোর ছদ্মবেশ হিসেবে বেছে নেয়।

তার তথ্যমতে, সে আশুলিয়া এলাকায় ২০০৬ সালে সাপ্তাহিক মহানগর বার্তার সহকারী সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হয়। ২০০৯ সালে সে আশুলিয়া প্রেসক্লাবের সদস্য হয়। পরে সংবাদ প্রতিক্ষণ পত্রিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। সে ২০১৩-১৪ মেয়াদে আশুলিয়া প্রেস ক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচন করে জয়লাভ করে। ২০১৫-১৬ মেয়াদে ক্লাবের সহ-সম্পাদক পদে নির্বাচন করে পরাজিত হয়। আবার ২০১৬-১৭ মেয়াদে সে নির্বাহী সদস্য নির্বাচিত হয়। ২০২০ সালে দৈনিক সময়ের বাংলা পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করে। সে ২০২১-২২ মেয়াদে আশুলিয়া প্রেসক্লাবে পুনরায় সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচন করে হেরে যায়।

বর্তমানে সে আশুলিয়া প্রেস ক্লাবের সদস্য এবং স্বদেশ বিচিত্রা পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছে।

এই দীর্ঘ সময়ে সে সংবাদিকতার পাশাপাশি বিভিন্ন গার্মেন্ট ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছে। নিজে কমপ্লায়েন্স সলিউশন নামে একটি কনসালটেন্সি ফার্ম খোলে। ফার্মটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিবেশ যাচাইয়ের নিরীক্ষার কনসালটেন্সি করত।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত বছেরর ২১ ডিসেম্বর কামালকে গ্রেপ্তারের জন্য র‌্যাবের সহায়তা চায় সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাকে গ্রেপ্তারের উদ্দেশ্যে র‌্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। মামলায় দেওয়া মোবাইল নম্বরের ভিত্তিতে বরিশালে একটি অভিযান চালানো হয়। নম্বরটি আসামির নামেই নিবন্ধন করা ছিল, কিন্তু তা ব্যবহার করত অন্যজন।

পরে জানা যায়, আসামি দীর্ঘদিন ওই মোবাইল নম্বর ব্যবহার না করায় কর্তৃপক্ষ সিমটি অপর ব্যক্তির কাছে রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে বিক্রি করে। শেষে র‌্যাব সাইবার টহলের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসামির ফুটপ্রিন্ট শনাক্ত করে। মাঠপর্যায়ে তথ্যের সঠিকতা যাচাই করে বৃহস্পতিবার রাতে র‌্যাব-১১ এর একটি দল ঢাকার সাভার থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে।

সূত্র: সমকাল
এম ইউ/১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২

Back to top button