অপরাধ

ফেসবুকে প্রেম, অতঃপর নিঃস্ব, রাজধানীতে ‘অভিনব ফাঁদ’

ঢাকা, ১৩ ফেব্রুয়ারি – ‘ঢাকা শহর আইসা আমার মাথা ঘুরাইছে। লাল লাল নীল নীল বাত্তি দেইখা নয়ন জুড়াইছে।’ আসলেই আজব শহর এই ঢাকা। কত রকমের মানুষ এই শহরে। জীবন-জীবিকার ঘানি টেনে চলে অহর্নিশ। কিন্তু এর আড়ালে আছে ছদ্মবেশী অপরাধ চক্র। চেনা অচেনা মুখগুলোই জড়িয়ে আছে এসব দুষ্কর্মে। দিন যত যাচ্ছে ততই ধরন বদলাচ্ছে অপরাধের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর ভর করে ‘অভিনব ফাঁদ’ গড়ে উঠছে অন্ধকার জগতে। যেখানে পা দিচ্ছেন তরুণ-তরুণীরা।

আবেগী সিদ্ধান্ত থেকে প্রেম, দেখা, তারপর অর্থকড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন কেউ কেউ। অভিযোগ গড়াচ্ছে আদালত পাড়াতেও। এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি। প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুত্ব। সেটা কিছুটা আবেগের জায়গায় পৌঁছালে দেখা করার প্রস্তাব। বিশ্বাস অর্জন করতে একসঙ্গে খাওয়া, ঘোরাঘুরি। এরপর কৌশলে বাসায় ডেকে এনে সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয়ে জিম্মি, ব্ল্যাকমেইল ও প্রতারণা।

দীর্ঘ দুইবছর এভাবে প্রতারণা করে আসছিলেন ফুয়াদ আমিন ইশতিয়াক ওরফে সানি ও তার চক্রের দুই সদস্য। ফুয়াদ নিজেকে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন পরিচয় দিতেন। সঙ্গে রাখতেন ওয়াকিটকি ও পিস্তল। যার সবই ছিল ভুয়া। আর তার কথিত স্ত্রী নিরা নিজেকে পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় দিতেন।

ট্রান্সজেন্ডার (রূপান্তরিত) নারী ছায়েদ বিন রাব্বি শান্তকে নির্যাতন ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় ২১ জানুয়ারি রাজধানীর ভাটারা থানায় একটি মামলা হয়। সেই মামলায় র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয় চক্রের মূলহোতাসহ তিনজন। এরপরই বেরিয়ে আসে তাদের বিভিন্ন অপকর্মের কাহিনী। শুধু ওই ট্রান্সজেন্ডার নারীই নন, অনেককেই বন্ধুত্ব ও প্রেমের ফাঁদে ফেলে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সর্বত্র লুটে নিয়েছেন তারা।

যেভাবে ফাঁদে ফেলা হয় আরেক যুবককে:
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মাহমুদ হাসান (ছদ্মনাম)। তাকেও বন্ধুত্বের ফাঁদে ফেলে প্রতারণা করা হয়েছিল। মাহমুদ হাসান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় হয় সাইমা শিকদার নিরা ওরফে আরজে নিরার সঙ্গে। পরিচয় পর্বের একপর্যায়ে গত ৭ ডিসেম্বর একটি রেস্টুরেন্টে দেখা করি। এসময় নিরা আমাকে নিয়ে রিকশায় ঘুরতে চায়। তাতে রাজি হলে, দু’জন একসঙ্গে ঘোরাঘুরি করি। একপর্যায়ে নিরা জানায়, তার বাসা ফাঁকা। পরবর্তীতে আমাকে নিয়ে নিরা তার বসুন্ধরার বাসায় যায়। সেখানে গিয়েই বাঁধে বিপত্তি।’

হাসান বলেন, ‘প্রথমে আমাকে একটি রুমে আটকে রাখা হয়। এসময় কোমড়ে ওয়াকিটকি ও পিস্তলসহ হাজির হয় একজন। সে নিজেকে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য পরিচয় দেয় এবং আমাকে মারধর করে। তার হেয়ারস্টাইল ও কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিল প্রশাসনে চাকরি করে। পরে জানতে পারি তার নাম ফুয়াদ আমিন ইশতিয়াক ওরফে সানি। এসময় আব্দুল্লাহ আফিফ সাদমান ওরফে রিশু নামে আরও একজন হাজির হয়ে আমাকে একটি চেয়ারের সঙ্গে হাত-পা বেঁধে রাখে। জানতে চায় কেন কীভাবে এই বাসায় এসেছি। তারা বলে, আমাকে মামলা দিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হবে। যদি মামলা থেকে বাঁচতে চাই তাহলে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হবে।’

এরপর হাসানের বাবা-মাকে ফোন করে ছেলের মুক্তির জন্য টাকা চাওয়া হয় এবং দ্রুত টাকা না দিলে একাধিক মামলা করা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়।

ভুক্তভোগী হাসান বলেন, ‘আমার বাবা-মাকে ফোন করা হয়। এসময় দ্রুত বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে বলা হয়। এমনকি আমাকে বেঁধে রাখার ছবি পরিবারের কাছে পাঠানো হয়। আমার পরিবার তাদের টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলে, আপনারা তাকে (হাসান) মামলা দিয়ে আদালতে পাঠিয়ে দেন। পরে তারা আমার বিকাশে থাকা দুই হাজার টাকা নিয়ে ছেড়ে দেন। এই বিষয় নিয়ে পরবর্তীতে কোনো ঝামেলা না করতে ভয়ভীতি দেখানো হয়। ঘটনার কয়েকদিন পরই জানতে পারি, র্যাব তাকে গ্রেপ্তার করেছে।’

তদন্ত কর্মকর্তা যা বলছেন:
ট্রান্সজেন্ডার (রূপান্তরিত) নারী ছায়েদ বিন রাব্বি শান্তকে নির্যাতন ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় ২১ জানুয়ারি রাজধানীর ভাটারা থানায় একটি মামলা করা হয়। মামলাটি তদন্ত করছেন এসআই হাসান মাসুদ। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘মামলার তদন্ত কাজ অনেকটা গুছিয়ে এনেছি। তদন্তে এখন পর্যন্ত তিনজনের বাইরে এই চক্রে কাউকে পাওয়া যায়নি। তাদের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হয়েছেন এমন কেউ এখনো আমাদের কাছে অভিযোগ দেয়নি। যদি কেউ প্রতারিত হয় তাহলে আমাদের কাছে লিখিত জানাতে পারে, তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারব।’

পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘৭ ফেব্রুয়ারি রিমাণ্ড শুনানি ছিল। কিন্তু আদালত রিমাণ্ড আবেদন না মঞ্জুর করে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছিল। আদালতের আদেশে তাকে (ফুয়াদ) জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।’

এসআই হাসান মাসুদ বলেন, ‘ট্রান্সজেন্ডার নারীর মামলায় দুইজন (ফুয়াদের কথিত স্ত্রী সাইমা নিরা ও তার সহযোগী রিশু) জামিন পেয়েছেন। তবে আদালত ফুয়াদকে জামিন দেননি।’

ট্রান্সজেন্ডার নারীর সঙ্গে যা হয়েছিল: ভুক্তভোগী ছায়েদ বিন রাব্বি বলেন, ‘ঘটনার দিন রিশু নামে এক যুবকের কথা বিশ্বাস করে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সি ব্লকে ৫ নম্বর সড়কের এক বাসার দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটে যাই। সেখানে যাওয়ার পর এক নারী ও আরেকজন পুরুষকে দেখতে পাই। ওই তিনজন আমাকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করে।’

এতে বাধা দিলে রাব্বিকে তিনজন মারধর শুরু করেন এবং বলতে থাকেন এই ভিডিও তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেবেন। এ সময় তিনজন নিজেদের আইনের লোক পরিচয় দেন। তাদের কাছে অস্ত্র ও ওয়াকিটকি ছিল।

‘পরে আমার কাছে থাকা মোবাইল ফোন, সোনার চেইন, টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। সেই সঙ্গে এক লাখ টাকা দাবি করা হয়েছিল। সেই টাকা না দিলে মেরে পূর্বাচলে ফেলে দেয়া হবে বলে ভয় দেখানো হয় । পরবর্তীতে প্রাণ ভিক্ষা চাইলে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরিয়ে রাত ৮টার দিকে রামপুরা এলাকায় একটি হাসপাতালের সামনে ফেলে যাওয়া হয়।’ বলেন ছায়েদ বিন রাব্বি।

সূত্র : ঢাকাটাইমস
এন এইচ, ১৩ ফেব্রুয়ারি

Back to top button