অপরাধ

কোথা থেকে আসে এত ডায়মন্ড

সাদ্দাম হোসেন ইমরান

ঢাকা, ০৩ ফেব্রুয়ারি – এক সময় ছিল যখন শুধু অভিজাত শ্রেণি ডায়মন্ডের অলংকার ব্যবহার করত। কিন্তু সহজলভ্যতার কারণে এখন মধ্যবিত্তদের মাঝেও এই মূল্যবান রত্নের ব্যবহার বাড়ছে।

ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে ঢাকার পাশাপাশি বিভাগীয় শহরগুলোতেও নানা ডিজাইনের ডায়মন্ডের অলংকার বিক্রি হচ্ছে। অথচ গত ২ বছরে বৈধভাবে এক ক্যারেট ডায়মন্ডও আমদানি হয়নি। এত ডায়মন্ড তাহলে দেশে আসছে কিভাবে, কোত্থেকে-তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বর্তমানে দেশে ডায়মন্ডের ব্যবসা করে ছোট-বড় অন্তত শতাধিক প্রতিষ্ঠান। এর বাইরে ঢাকার ছোট-বড় প্রায় সব জুয়েলারির দোকান ডায়মন্ডের অলংকার বিক্রি করে।

এ বিষয়ে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে ডায়মন্ড তৈরি হয় না, খনিও নেই। কাস্টমসে যদি বৈধভাবে আমদানির তথ্য না থাকে তাহলে বলা যায়, চোরাচালানের মাধ্যমেই এগুলো দেশে আনা হয়।

যারা এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত শুল্ক গোয়েন্দা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসবে। তিনি বলেন, এ খাতকে যথাযথ মনিটরিংয়ের আওতায় আনলে রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব।

কাস্টমসের তথ্যমতে, গত ২ বছরে শিল্পে ব্যবহারের জন্য ৪টি চালানে ২ কেজি ১৬০ গ্রাম ডায়মন্ড আমদানি করা হয়েছে। তবে কোনো অলংকার আমদানি হয়নি। অর্থাৎ অলংকারের বাজার পুরোটাই চোরাচালাননির্ভর।

শুল্ক গোয়েন্দা, বিমানবন্দর কাস্টমস, ইমিগ্রেশন পুলিশ, এপিবিএনসহ বিমানবন্দরগুলোতে কর্মরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হরহামেশাই স্বর্ণের চালান আটক করলেও ডায়মন্ডের চালান ধরা না পড়া বিস্ময়ের জন্ম দিচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, ডায়মন্ডের সিন্ডিকেট কি স্বর্ণের চেয়েও শক্তিশালী, নাকি দেশে যেগুলো বিক্রি হচ্ছে সেগুলো নকল?

কাস্টমস ট্যারিফ শিডিউল অনুযায়ী, এক ক্যারেট ডায়মন্ড (দশমিক ২ গ্রাম) আমদানি করতে সরকারকে ১৫০ দশমিক ৯০ শতাংশ শুল্ক-কর দিতে হয়। অর্থাৎ ১০০ টাকার ডায়মন্ড আমদানি করলে সরকারকে ১৫০ টাকা শুল্ক-কর দিতে হয়।

এর মধ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক, ৬০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর, ৪ শতাংশ অগ্রিম ট্রেড ভ্যাট ও ৪ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি আরোপিত আছে।

অন্যদিকে বিদ্যমান ব্যাগেজ রুলে স্বর্ণ ও রুপার বার-অলংকার আমদানির অনুমতি দেওয়া থাকলেও ডায়মন্ডের অলংকারের বিষয়ে কিছু বলা নেই। অর্থাৎ ব্যাগেজ রুলের আওতায় ডায়মন্ডের অলংকার আনার সুযোগ নেই।

নীতিমালায় বলা আছে, একজন বিদেশফেরত যাত্রী ১০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণালংকার এবং ২০০ গ্রাম ওজনের রুপার অলংকার বিনা শুল্কে আনতে পারবেন। আর ২০ ভরি ওজনের (২৩৪ গ্রাম) স্বর্ণ বা রুপার বার শুল্ক দিয়ে আনতে পারবেন। এ জন্য স্বর্ণের ভরিপ্রতি ২ হাজার টাকা এবং রুপার ভরিপ্রতি ৬ টাকা শুল্ক দিতে হবে।

এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, দেশে বৈধভাবে স্বর্ণ-ডায়মন্ডের অলংকার আমদানি হয় না বললেই চলে। তাহলে শপিংমলগুলোতে এত দামি অলংকার আসছে কোত্থেকে? এ খাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সরকার স্বর্ণ নীতিমালা করলেও তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, চোরাচালান বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না। বিমানবন্দরগুলোতে অত্যাধুনিক স্ক্যানিং মেশিন বসানো দরকার। কিন্তু সেটা করা হচ্ছে না। কাস্টমস আইনে যাত্রীদের আগাম তথ্য (অ্যাডভান্স প্যাসেঞ্জার ইনফরমেশন বা এপিআই) দেওয়ার বাধ্যবাধতা থাকলেও তা পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।

বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোকে এ বিষয়ে বাধ্য করা গেলে কাস্টমস কর্মকর্তারা সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রীদের চিহ্নিত করার মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে পারত। সর্বোপরি চোরাচালান কমিয়ে আনতে আন্তঃসংস্থাগুলোর (কাস্টমস, শুল্ক গোয়েন্দা, এপিবিএন, ইমিগ্রেশন, পুলিশের বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা সংস্থা) মধ্যে কো-অর্ডিনেশন ও কো-অপারেশনের বিকল্প নেই।

অনুসন্ধানের তথ্যমতে, ডায়মন্ড চোরাচালান চক্রের সঙ্গে প্রভাবশালী ও বিদেশি নাগরিক জড়িত। এসব বিদেশি নাগরিক স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বসবাস করেন। এরা বিভিন্ন ফার্মে কনসালট্যান্ট হিসাবে অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজ করেন।

এর আড়ালে জুয়েলারি মালিকদের অর্ডার সাপেক্ষে শো-রুমে খোলা (লুজ) ও ডায়মন্ডের অলংকার পৌঁছে দেন। এদের কাজই হচ্ছে ডায়মন্ড নিয়ে। এ চক্রটির সঙ্গে গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকায় অবস্থিত জুয়েলারি মালিকদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে।

চোরাচালান নির্বিঘ্ন করতে সহায়তা করছে কাস্টমসের কয়েকটি অসাধু চক্র। এর বাইরে স্থানীয় উৎস থেকে স্বর্ণের মতো ডায়মন্ডও সংগ্রহ করা হয়। অর্থাৎ কেউ ডায়মন্ডের অলংকার বিক্রয় করলে সেটিকে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে নতুন অলংকার বানানো হয়।

বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা বলেন, ২০১৯ সালে আমাদের সমিতি আয়োজিত স্বর্ণ মেলায় জুয়েলারি মালিকরা নিজেদের স্টকে থাকা ডায়মন্ড ঘোষণা দিয়ে বৈধ করে নেন।

এরপর তো করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ে। জুয়েলারি খাতে লাগে মারাত্মক ধাক্কা। চাহিদা কমে যাওয়ায় আমদানিতেও এর প্রভাব পড়ে। তাছাড়া ডায়মন্ড সংগ্রহের বড় উৎস হলো রিসাইক্লিং।

অনেকে পুরোনো গহনা দিয়ে নতুন গহনা সংগ্রহ করেন। ওই পুরোনো গহনা ভেঙে নতুন গহনা তৈরি করা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নতুন যারা ব্যবসায় এসেছে তারা কিভাবে ডায়মন্ড সংগ্রহ করেছেন সেটা তাদের জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে।

২০১৯ সালের ২৮ মে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এনবিআর অঘোষিত স্বর্ণ ও ডায়মন্ডের অলংকার বৈধ করার সুযোগ দেয়। ভরিপ্রতি সোনা ও সোনার অলংকারের ক্ষেত্রে ১ হাজার টাকা, প্রতি ক্যারেট ডায়মন্ডের অলংকারের জন্য ৬ হাজার টাকা ও রুপায় ৫০ টাকা কর ধার্য করা হয়।

সূত্র : যুগান্তর
এন এইচ, ০৩ ফেব্রুয়ারি

Back to top button