কষ্ট যাদের কাছে সফলতার মন্ত্র
জীবনে সফল হতে আমরা সকলেই চাই। তবে সেই সফলতায় পৌঁছাতে আমাদের অনেকের পথ তুলনামূলক সহজ হয় আবার অনেকেরই পার করতে হয় শত বাঁধা। এমনই কয়েকজন সফল ব্যক্তিত্ব আছেন যাদের সফলতার পেছনে রয়েছে নানা ধরনের কষ্টের গল্প। কষ্টই যেন ছিল তাদের সফলতার মূলমন্ত্র। চলুন জেনে নিই তাদের সম্পর্কে-
আব্রাহাম লিংকন
১৮০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তার জন্ম । তিনি ছিলেন একজন মার্কিন রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী। ১৮৬১ সালের ৪ মার্চ থেকে ১৫ এপ্রিল ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আমেরিকার সর্বকালের সেরা প্রেসিডেন্ট হিসেবে ধরা হয় তাকে। আমেরিকায় দাসদের স্বাধীনতা লাভের পেছনে তাঁর অবদান ছিলো সব থেকে বেশি।
তার নিজের জীবনের গল্পটা ব্যর্থতায় মোড়ানো থাকলেও পরবর্তীতে তিনিই হলেন পৃথিবীর ইতিহাসের সফলতম মানুষদের একজন। রাজনীতি ও খ্যাতির দিক দিয়েও নি:সন্দেহে তিনি ছিলেন সফল ব্যক্তি। ২৩ বছর বয়সে তার চাকরি চলে যায়। সেই সময়ে তিনি তার প্রথম নির্বাচনেও হারেন। ২৯ বছর বয়সে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ এর সদস্য হওয়ার জন্য নির্বাচন করে হারেন।
১৮৪৮ সালে, ৩৯ বছর বয়সী লিংকন ওয়াশিংটনের জেনারেল ল্যান্ড অফিসের কমিশনার হওয়ার জন্য নির্বাচন করে পরাজিত হন। ৪৯ বছর বয়সে সিনেটর হওয়ার জন্য নির্বাচনে দাঁড়িয়ে পরাজিত হন। এত ব্যর্থতার পরও তিনি রাজনীতি না ছেড়ে চেষ্টা করে যান। অবশেষে ১৮৬১ সালে ৫২ বছর বয়সে তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগের প্রায় পুরোটাই ছিল তার ব্যর্থতার গল্প। কিন্তু এরপর তিনি ইতিহাস বদলে দেন। ১৫ এপ্রিল ১৮৬৫ সালে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।
জ্যাক মা
চীনের হাংচৌ চচিয়াং প্রদেশে ১৯৬৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর জন্ম হয় জ্যাক মা-এর। জনপ্রিয় ট্রেডিং সাইট আলিবাবা ডট কম এর কর্ণধার তিনি। এর পাশাপাশি চীনের শীর্ষ ধনী ব্যক্তি। বর্তমানে তার সম্পদের পরিমাণ ২৫০০ কোটি ডলার। আলিবাবাতে তার ৭ দশমিক ৮ শতাংশ স্টেক আছে এবং পেমেন্ট প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠান আলি পে তে তার স্টেক প্রায় ৫০ শতাংশ। অসাধারণ এই মানুষটির সফলতার পূর্বের গল্প যেন একটি ট্রাজেডি সিরিয়াল। জ্যাক মা এর ব্যবসা যে একদম সাধারণ অবস্থা থেকে উঠে এসেছে তা হয়তো এখন সবারই জানা। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী আর বিখ্যাত মানুষদের মধ্যে একজন তিনি। জ্যাক মা গড়ে তুলেছেন বর্তমান দুনিয়ার সবচেয়ে বড় কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটি।
কলেজে ভর্তি হবার সময়ে ৩ বার ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করে ৪র্থ বারে সুযোগ হয় তার। এরপর চাকরিতে গিয়ে বহুবার ব্যর্থ হওয়া! পুলিশে ১০ জন পরীক্ষার্থীর ৯জন চাকরি পেলেও একজন বাদ পড়া ব্যক্তিটি ছিলেন জ্যাক। কেএফসিতে ২৪ জনের মধ্যে জ্যাক মা ছাড়া চাকরি পেলেন বাকি সবাই। হার্ভার্ডে দশ বারের চেষ্টাতেও তিনি সুযোগ পাননি। এভাবে অনেক ব্যর্থতার পর অদম্য চেষ্টায় অবশেষে লিখলেন সফলতার গল্প। প্রতিষ্ঠা করলেন আলিবাবা।
বিল গেটস
১৯৫৫ সালের ২৮ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন, সিয়াটল শহরে মাইক্রোসফ্ট কর্পোরেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস এর জন্ম। আজকের বিশ্বের কম্পিউটারের বিপ্লবের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান যাদের, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন তিনি। একজন আমেরিকান ব্যবসায়িক মহারথী, সফটওয়্যার বিকাশকারী, বিনিয়োগকারী, লেখক এবং সমাজসেবী। অধিক সময় ধরে তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনী থাকায় বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি আমাজনের জেফ বেজোস হওয়া সত্ত্বেও তার নামই সবাই ধারণা করে থাকেন।
আধুনিক বিশ্বের কম্পিউটারের বিপ্লবের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রাখা মানুষগুলোর মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। পৃথিবীর বেশিরভাগ কম্পিউটার এখনও তার কোম্পানির সফটওয়্যারে চলে।
কিন্তু বিল গেটস তার প্রথম প্রজেক্টে অপমানজনক ভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন। মাইক্রোসফট এর কো-ফাউন্ডার এবং বাল্যবন্ধু পল এ্যালেন আর বিল গেটস মিলে ‘ট্রাফ ও ডাটা’ নামে একটি মেশিন তৈরি করেছিলেন। যেটি ট্রাফিক কাউন্টারগুলো থেকে ডাটা সংগ্রহ করে সরকারি ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারদের তা গুছিয়ে সরবরাহ করবে। এই যন্ত্রটির ওপেনিং এ স্বয়ং শিয়াটলের ট্রাফিক সুপারভাইজার এসেছিলেন। কিন্তু যন্ত্রটি চালু করার পর কোনোভাবেই কাজ করেছিল না। এমন লজ্জা আর অপমান গেটসের জীবনে আর আসেনি। কিন্তু তারা থেমে যাননি। এই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়েই বিল আর পল মিলে পরে মাইক্রোসফটকে সফল করেন।
আলবার্ট আইনস্টাইন
১৮৭৯ মার্চের ১৪ তারিখ তিনি জন্মগ্রহন করেন। তিনি জার্মানিতে জন্মগ্রহণকারী নোবেল পুরস্কার বিজয়ী একজন পদার্থবিজ্ঞানী। ১৯২১ সালে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে তার বিশেষ অবদান এবং আলোক-তড়িৎ ক্রিয়া সম্পর্কিত গবেষণার জন্য তিনি এই পুরস্কার পেয়েছিলেন। বিজ্ঞানীদের নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তার নাম চলে আসবেই। বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত ও সফল বিজ্ঞানী তিনি। একটা সময় অবধি পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম সেরা মেধাবীর তকমা পাওয়া এই জার্মান জিনিয়াসকেই গর্ধভ বলা হতো। কথা বলা শিখতেই তিনি সময় নিয়েছিলেন ৪ বছর। পড়াশুনায় ছিলেন একদমই বাজে। কোন বিষয়ই তার পারদর্শীতা দেখা যায়নি। জুরিখের সুইস ফেডারেল পলিটেকনিক স্কুলের ভর্তি পরীক্ষা দেন ১৬ বছর বয়সে। সেখানে তিনি শোচনীয় ভাবেই খারার ফলাফল করেন। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়েও তার কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। বরং পড়াশুনা বাদ দেয়ার চিন্তা করেছিলেন একাধিকবার।
বাবা মারা যাওয়ার সময়ে বলে যাওয়া এই গর্ধভ ছেলে জীবনে কিছুই করতে পারবে না এমন কথায় আইনস্টাইন বহুদিন ধরে মনে কষ্ট চেপে রেখেছিলেন।
কিন্তু তারপরও তিনি কোনো কাজের সন্ধান করতে পারছিলেন না। পরে বাধ্য হয়েই ইন্সুরেন্স সেলস ম্যানের কাজ নেন। তবে তার ঠিক ২ বছর পর তিনি পেটেন্ট অফিসে কাজ পান। যেখানে নতুন ডিভাইস পেটেন্ট করার আগে পরীক্ষা করা হতো। কিন্তু কে জানতো এই গর্ধভটা এমন কিছু করবে যা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করবে, একটা সময়ে এই অপদার্থ ছেলেটাই পৃথিবীর চেহারা পাল্টে দেবে। ‘ডাল ব্রেন’ নিয়ে পদার্থ বিজ্ঞানের বেশ কয়েকটি মূল সূত্র সৃষ্টি করে গেছেন তিনি। বিজ্ঞানে অবদানের জন্য নোবেল প্রাইজ জিতেছেন। প্রমাণ করেছেন সফল হতে চেষ্টার কোনো কমতি রাখা যাবে না। ৭৬ বছর বয়সে ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনে বিশ্বের জনপ্রিয় এই বিজ্ঞানী মৃত্যুবরণ করেন।
চার্লি চ্যাপলিন
১৮৮৯ সালে জন্ম নেয়া বিশ্ব বিখ্যাত অভিনেতা ও পরিচালক চার্লি চ্যাপলিনকে চেনে না এমন মানুষকে খুঁজে পাওয়া দায়। তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ চলচ্চিত্র অভিনেতা, পরিচালক ও সুরকার। হলিউড চলচ্চিত্র শিল্পের শুরুর সময় থেকে মধ্যকাল পর্যন্ত তিনি তার অভিনয় ও পরিচালনা দিয়ে সাফল্যের শিখরে আরোহণ করেন। পৃথিবীতে সিনেমা শুরুর সময় থেকে আজ অবধি সকল সিনেমা পাগল মানুষগুলো তাকে ভালোবাসেন এবং শ্রদ্ধাও করেন। তাকে বলা হতো কমেডির রাজা।
চ্যাপলিনের বাবা দিন-রাত মদ পান করতেন। চ্যাপলিনের ২ বছর বয়সে তার বাবা তাদের রেখে চলে যান। তার মায়ের স্বল্প উপার্জনে সংসারের খরচ কোন রকমে চলতো। ৭ বছর বয়সে চার্লি বৃটেনের ‘ওয়ার্কহাউজ’এ যেতে বাধ্য হন। যেখানে গরিবদের জন্য পরিশ্রমের বিনিময়ে খাবার ও শোয়ার জায়গা দেয়া হতো। কিছুদিন পর চার্লি সেখান থেকে ফিরে আসেন।
চার্লির ৯ বছর বয়সে তার মা পাগল হয়ে যান এবং তাকে মানসিক হাসপাতালে যেতে হয়। মায়ের মানসিক হাসপাতালে যাওয়ার কারণে চ্যাপলিনকে আবারও ওয়ার্কহাউজে ফিরে যেতে হয়। তার কিছুদিন পর তার বাবা লিভার নষ্ট হয়ে মারা যান। এরপর তার মায়ের পাগলামি বেড়ে গেলে তাকে পাগলাগারদে বন্দি করে রাখার প্রয়োজন হয়। এমন কঠিন মুহুর্তে চ্যাপলিন ও তার ভাই সিডনি দিনের পর দিন না খেয়ে রাস্তায় ঘুরে কাটান।
এভাবে চলতে চলতেই এক সময়ে তিনি হঠাৎ মঞ্চে কাজ নেন। বিভিন্ন মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতে করতে নিজের কমেডি প্রতিভাকে শক্তিশালী করেন। পরে হলিউডে পাড়ি জমিয়ে সর্বকালের সেরা নির্বাক অভিনেতা হয়ে ওঠেন। একটা সময় ৮৮ বছর বয়সে ২৫ ডিসেম্বর ১৯৭৭ সালে তিনি সুইজারল্যান্ডের ভেভি শহরে মৃত্যুবরণ করেন।
এন এইচ, ০২ ফেব্রুয়ারি